রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন

 

আমাদের নিয়মিত সাহিত্য সাধনার দিন প্রতিদিন  




আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিকপত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম । আজ তাঁর ধারাবাহিক থেকে একটু চোখ ফিরিয়ে আবার স্বাদ নিই  ধারাবাহিক উপন্যাসের।এবার থেকে  প্রতি রবিবার প্রকাশিত হবে এক একটি পর্ব। কারণ কিছুই নয় সন্দীপের উপন্যাসের এক একটি অধ্যায় মানে এক একটি গল্প। তাই রবিবাসরীয় একটা সাহিত্যের আড্ডা ভরানো থাক সন্দীপের উপন্যাসে।   

ঝুলবারান্দার নীচে #৩৪



সন্দীপ চক্রবর্তী
আজ সন্ধ্যেবেলায় আসর। আমি জানি সদাশিববাবুর জরুরি কাজ আছে। কিন্তু ওর মধুসঙ্গ ছেড়ে আমার মন যেতে চাইছিল না। ইতিমধ্যেই তিনি আমার দাদা হয়ে উঠেছেন। আমি ওর কথায়, ওর দরাজ প্রাণখোলা হাসিতে এক কুলহারা নদীর কলধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু চাপা একটা অস্বস্তিও আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। একসময় বলেই ফেললাম, আপনার নিশ্চয় অনেক কাজ আছে সদাশিবদা। আমি আছি বলে করতে পারছেন না।
সদাশিবদা হেসে বললেন, যেটা করছি সেটাও কাজই ভায়া। তুমি আমার মুড বানিয়ে দিচ্ছ। আজ স্টেজে সদাশিব নন্দী ফাটিয়ে অভিনয় করবে। তুমি দু'মিনিট বোসো। মেজাজ যখন নিজে থেকেই আসছে তখন তাকে বরণ করে ঘরে না তুললে অভিমান করবে।
দেখলাম সদাশিবদা ব্যাগ থেকে বোতল বের করলেন। গ্লাসে ঢেলে পরপর দু'তিনটে চুমুক দিয়ে বললেন, এতক্ষণে নতুন বউ ঘোমটা সরিয়ে মুখ তুলে চাইল।
শুনেছি মাতালদের মদ খাওয়ার অজুহাতের অভাব হয় না। আজ নিজের চোখেই সেটা দেখলাম। মদ খাওয়ার কারণ হিসেবে সদাশিবদা যা বললেন সেটা এককথায় অসাধারণ। প্রকৃত রসিক না হলে এভাবে বলা যায় না। বললাম, নতুন বউয়ের কথায় মনে পড়ল। আপনার এই বোহেমিয়ান জীবন বউদি মেনে নেন?
সদাশিবদা চুপ করে রইলেন। গ্লাস খালি হতে থাকল। কিছুক্ষণ পর যেন কারও কানে কানে বলছেন এমনিভাবে বললেন,
হাঙ্গামা কিউ হ্যায় বড়পা
থোড়িসি যো পি লি
ডাকা তো নেহী ডালা
চোরি তো নহী কি
অবাক হয়ে বললাম, এ তো গোলাম আলির বিখ্যাত গজল। আপনি গজল জানেন নাকি সদাশিবদা?
মিনুমা মাস্টার রেখে শিখিয়েছিল। বাদলা দিনে মিনুমা গান শুনতে চাইত। আমিও গাইতাম, আজ যানে কা জিদ না করো, কিংবা আপ কি ইয়াদ আতি রহি রাতভর। পরে আর একজনও আমার কাছে কেবল গজল শুনতে চাইত। তাকেই তোমার বউদি করতে চেয়েছিলাম সন্দীপ। কিন্তু হল না।
মনে হল এক স্রোতস্বিনী চলতে চলতে হঠাৎই চরায় ধাক্কা খেয়ে আর্তনাদ করে উঠল। অস্বীকার করব না, এমনটা যে ঘটতে পারে বুঝতে পারিনি। জমিদার যতই পড়তি দশার হোন আমি তার বারমহলের হিরে-জহরতে আটকে গিয়েছিলাম। অন্দরমহলে যে কান্না থাকতে পারে ভেবে দেখিনি। বললাম, সরি। আমি আপনার মুড নষ্ট করে দিলাম।
সদাশিবদা বললেন, ঠিক তার উলটো। মুড কখন নষ্ট হয় জানো? আগুনটা নিভে গেলে। তুমি শুকনো খড়কুটো দিয়ে আগুনটাকে উসকে দিয়েছ।
অস্বস্তির পাথরটা বুক থেকে নেমে গেল। আগুন আরও উসকে দেবার জন্য বললাম, জানেন তো আমি লিখি। কারও সঙ্গে কথা বলে যদি মনে হয় তিনি আস্ত একটি গল্পের ভাণ্ডার তা হলে তাকে আর ছাড়ি না।
সদাশিবদা হো হো করে হেসে বললেন, এই কথা! বেশ তো রাখো না ধরে। আমিও তো বলতেই চাই। যাকে ভুলতে পারব না তাকে ভোলার চেষ্টা করে লাভ কী! আর তা ছাড়া কোথায় লেখা আছে ভাই, প্রেম সাকসেসফুল না হলে তাকে লুকিয়ে রাখতে হবে? বিয়েটাই তো হয়নি। তাই বলে ভালোবাসা তো মরে যায়নি। ভালোবাসি যখন, তখন নিশ্চয়ই বলব।
গ্লাস খালি হয়ে গিয়েছিল। সদাশিবদা বোতল থেকে ঢেলে গ্লাস ভরে নিয়ে বললেন, লিপিকা ঘোষের নাম শুনেছ? একসময় শরৎবাবুর গল্প নিয়ে লেখা পালায় অভিনয় করে খুব নাম করেছিলেন। ওর বিরাজ বউ দেখে লোকে চোখ মুছতে মুছতে আসর ছাড়ত। তখন আমি ওর অপোজিটে থাকতাম। তিনি বিরাজ তো আমি পীতাম্বর। তিনি বড়দিদি তো আমি শ্রীকান্ত। বছর দশেক চুটিয়ে কাজ করেছি ভাই। কাজ করতে করতেই অকাজটি হয়ে গেল। তখনও জানি না, মনে মনে অকাজটি তিনিও সেরে ফেলেছেন। যখন জানতে পারলাম সরাসরি বললাম, তবে আর কী! এবার একটা শুভদিন দেখে মিসেস নন্দী হয়ে যান। তিনি রাজিও হলেন। আমরা গঙ্গার ধারে দেখা করলাম। পান খেতে ভালোবাসেন তো, তাই নিয়ে গেলাম চিৎপুরের ইকবাল মিঞার বেনারসি পান। পান মুখে দিয়ে আর জিভের ডগায় কয়েক দানা গোপাল জর্দা ফেলে তিনি খুব খুশি। আমার আনন্দও কিছু কম না। আনন্দের চোটে গানই গেয়ে ফেললাম একখানা। মনো দিতে বধূ এসেছি আমি হে/ আঁখি মেলে দেখো চাহিয়া/ বাজিছে বাঁশরী তমালকুঞ্জে/ গাহিছে দোয়েল পাপিয়া।
নিধুবাবুর টপ্পা। তবে ততটা প্রচলিত নয়। কিছুক্ষণ গুনগুন করে সদাশিবদা বললেন, কিন্তু তখন কে জানত এই আনন্দ বেশিক্ষণ টিকবে না। সারাজীবন তিনি দৈত্যপুরীতে বন্দিনী হয়ে থাকবেন আর আমি শাপভ্রষ্ট রাজকুমারের মতো দৈত্যের প্রাণভোমরা খুঁজে বেড়াব। কিন্তু কোথাও খুঁজে পাব না।
অনুমান করেছিলাম তৃতীয় ব্যক্তি কেউ আছেন। কিন্তু তিনি কে? লিপিকার কোনও গোপন প্রেমিক? স্বামী? নাকি অন্যকেউ? কথাটা জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না। নিজের জীর্ণ প্রাসাদ নিজেই ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন সদাশিবদা। তিনিই বলবেন ঘুনপোকাটি কে!
সদাশিবদা আবার শুরু করলেন, ঘটনাটা সত্তরের দশকের শেষদিককার। সেসময় যাত্রার কিছু কিছু প্রযোজক সুন্দরী নায়িকাদের রক্ষিতা করে রাখতেন। রক্ষিতা কী তুমি নিশ্চয়ই জানো। তাই আর বিশদে যাচ্ছি না। লিপিকাও ছিলেন আমাদের দলের প্রযোজকের রক্ষিতা। সেই প্রযোজক আমাদের গল্প শুনে গোড়ায় তো খুব উৎসাহ দিলেন। কিন্তু পরের দিন মহলায় গিয়ে জানতে পারলাম, আমি আর দলের কেউ নই। রাতারাতি অন্য নায়ক ঠিক করে ফেলেছেন প্রযোজক। ওর রক্ষিতাকে আমি বিয়ে করার স্বপ্ন দেখছি তাই প্রযোজক মশাই প্রতিশোধ নেবার জন্য আমাকে বেছে নিয়েছিলেন।
তারপর?
সদাশিবদা হেসে বললেন, তারপর আর কী! খেয়েপরে বেঁচে থাকতে তো হবে। তাই অন্যদলে চেষ্টা করলাম। কিন্তু প্রযোজক মশাই এমন কলকাঠি নেড়ে রেখেছিলেন যে কেউই আমায় কোনও কাজ দিল না। দু'তিন বছর খুব খারাপ কেটেছে। সারাদিন মেসের ঘরে বসে থাকতাম আর জমানো পুঁজি ভেঙে বোতল-বোতল মদ গিলতাম।
অন্য কোনও কাজ তো জানি না ভাই, তাই ঠিক করলাম ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় করব। এখনও তাই করে চলেছি সন্দীপ। হিরো আর হতে পারিনি।
নিজের চোখে নৌকোডুবি হতে আমি কখনও দেখিনি। কিন্তু সদাশিবদার ভালোবাসার পরিণতি দেখে আমার নৌকোডুবির কথাই মনে হল। যেন এক পালতোলা বিশাল নৌকো ডুবোপাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে লণ্ডভণ্ড অবস্থায় অতলে তলিয়ে গেল। জিজ্ঞাসা করলাম, এখনও আপনাদের যোগাযোগ আছে?
যোগাযোগ থাকবে না, বলো কী! আমি পোস্টঅফিসের লেটারবক্স আর তিনি বাড়ির। এমন মধুর সম্পর্ক আর কি দুটি আছে? তা ছাড়া, সেই প্রযোজক মারা গেছেন। লিপিকা এখন গড়িয়ার কাছে ফ্ল্যাট কিনে একাই থাকেন। আমি যাই মাঝে মাঝে। মন করলে রাতেও থাকি। অবশ্য শুধু আমার মন করা নয়, তিনিও মুড়িঘন্ট আর ভুনি খিচুড়ির লোভ দেখিয়ে আমাকে আটকে দেন। পঁয়ষট্টি পেরিয়ে গেছে ভায়া। মিথ্যে বলব না। শরীরে তত কুলোয় না। কিন্তু তবুও রাত বাড়লে আদর করার ইচ্ছে হয়। সুন্দরী তো তিনি বটেই। বয়েসের ভারে আগুনের ধার কমেছে কিন্তু ঢিমে আঁচ এখনও রয়ে গেছে। ওই মিঠে ওমটুকুতে আমার শীতভাব দিব্যি কেটে যায়। কিন্তু ওই পর্যন্তই। বিয়ের কথা বললে রানিসাহেবা মুখ বেঁকান। তিনি নাকি অপবিত্র। ঘরের বউ হওয়া তাকে মানায় না। আচ্ছা, কী মুশকিল বলো দেখি ভায়া, হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার পরও রুগি যদি নিজেকে রুগি ভাবে তা হলে আমি কী করি! দেহটা পাঁঁচভূতের ভোগে লেগেছে, মনটা তো নয়। দশ টাকার সাবান কিনে এনে দেহটাতে মাখিয়ে দু'ঘড়া জল ঢেলে দিলেই তো দেহ শুদ্ধ। কিন্তু কে কাকে বোঝাবে! তার আর একটা আপত্তি, বুড়ো বয়েসে বিয়ে করলে লোকে কী বলবে! আরে বাপু, আমরা তো আর ঘটা করে বিয়ে করতে যাচ্ছি না। একগাছি করে দুটো জুঁইফুলের মালা এনে গলায় পরিয়ে দিতে আপত্তি কী! ভালোবাসি বলেই তো বিয়ে নাকি! বিয়েটা হলে লোকে আর আমাদের অকথা-কুকথা বলবে না। তিনিও নিজের সংসারের চাবিগাছটি আঁচলে বাঁধতে পারবেন। দুঃখটা কোথায় জানো, এসব কথা তিনি বুঝেও বোঝেন না। আমাকে রাজাবাবু বলে ডাকেন, আমি তাকে ডাকি রানিসাহেবা বলি-- যখন জিজ্ঞাসা করি আমরা কি চিরকাল লোকচক্ষুর আড়ালে রাজারানি সেজে থাকব? সত্যি রাজারানি কি কখনও হব না? তখন রান্নাঘরের অজুহাত দিয়ে শোবার ঘর ছেড়ে চলে যান। ফোড়নের অজুহাতে চোখ মোছেন। আর মাথা ধরার অজুহাতে চুপ করে বসে থাকেন। এদিকে আমার কোনও অজুহাত নেই। শুধু দুটো হাত আছে। হাত বাড়িয়ে তার মন পাই কিন্তু নাগাল পাই না।
বোতল খালি হয়ে গেল। সেদিকে তাকিয়ে সদাশিবদা বললেন, এই যাঃ! ইন্ধন শেষ। আঁচ তো এবার নিভে যাবে হে। তা যাক গে যাক৷ কথা আমার শেষ, এবার শুধু ব্যথা। সে না হয় আর একদিন হবে।
আমি এক চিরসবুজ বনানীর নেশায় বুঁদ হয়ে গিয়েছিলাম। চিরকাল দুঃখীকে বিলাপ করতে শুনেছি। নিজেকে ধ্বংস করতে দেখেছি। কিন্তু কারও জীবনে তার অন্তহীন দুঃখ কবিতা হয়ে উঠেছে এমনটা আগে কখনও দেখিনি। এই মানুষটার দুঃখ কি সত্যিই তাকে কোনও দুঃখ দেয়? নাকি দুঃখও তার কাছে আনন্দ? জীবন মাস্টারের টোড়ির পর সদাশিবদার গজল-- একেবারে রাজযোটক মিল। একটা উর্দু কবিতার দুটো লাইন মনে পড়ে গেল-- তুম নেহী, গ্বম নেহী, শরাব নেহী/ ইস তনহাই কা কোই জবাব নেহী। বললাম, আপনার রানিসাহেবার কাছে একদিন আমায় নিয়ে যাবেন সদাশিবদা?
সদাশিবদার চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল, যাবে তুমি! গেলে তিনি খুব খুশি হবেন। কবে যাবে বোলো, নিশ্চয়ই নিয়ে যাব।
অলস মন্থর পায়ে ফিরে গেলাম নিজের ঘরে।। আমার উপন্যাসের প্রেক্ষাপট পেয়ে গেছি। এরা দু'জন থাকতে কাহিনির ধরতাই দেবার জন্য আমার কোনও কাল্পনিক চরিত্রের প্রয়োজন নেই। এদের মর্মবেদনা স্পর্শ করতে পারলেই আমি যাত্রাজগতের অনেক মানুষের হাসিকান্নার সন্ধান পেয়ে যাব।
সন্ধ্যেবেলায় জমিয়ে পালাগানের আসর বসল। এর আগে কলকাতার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রেক্ষাগৃহে বসে যাত্রাপালা দেখেছি। কিন্তু সে দেখার সঙ্গে এ দেখার কোনও তুলনা হতেই পারে না। কলকাতায় যা হয় তাকে যাত্রানুষ্ঠান বলা যেতে পারে কিন্তু গ্রামে বসে যাত্রার আসর। মঞ্চে শিল্পীদের অভিনয় দেখে গ্রামের মানুষ হাসেন, কাঁদেন। ভিলেনের কারসাজিতে ক্ষুব্ধ হন। একুশ শতকে যদি গ্রামের যাত্রার আসরে মানুষ এমন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নিজের আবেগ প্রকাশ করেন তা হলে আজ থেকে দশ-পনেরো বছর আগে না-জানি আরও কত জীবন্ত ছিল এই পরিবেশ!
যাত্রিকের এবারের নাটকটির গল্প যদিও নেহাতই সাদামাটা। পালার নাম লালমাটির মাধবী। মাধবী গ্রামবাংলার সাধারণ মেয়ে। তার বাবা শশীপদ গ্রামের সুধখোর মহাজন অনাদি মণ্ডলের কাছ থেকে টাকা ধার করে নেশাভাং করে। টাকা শোধ করতে না পারায় অনাদি শশীপদকে শর্ত দেয় এক রাতের জন্য মাধবীকে তার কাছে পাঠাতে হবে। শশীপদ জোর করে মেয়েকে পাঠায়। তারপর গ্রামের লোকের চাপে পতিতা মেয়েকে ত্যাগ করে। মাধবী ভালো গান জানে। সেই গান সম্বল করে শহরে যায়। শহরে আলাপ হয় দীপকের সঙ্গে৷ দীপক ওকে গায়িকা হবার স্বপ্ন দেখায়। ওকে নিয়ে যায় একটা রেকর্ড কোম্পানিতে। কোম্পানির মালিক মিস্টার ঘোষাল একটি আস্ত শয়তান। সে মাধবীকে বড়ো স্টার বানাবার স্বপ্ন দেখিয়ে দিনের পর দিন ভোগ করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত দীপক কীভাবে মাধবীকে শয়তানের গুহা থেকে বের করে সামাজিক স্বীকৃতি দেয়-- এই নিয়েই গল্প।
মাধবীর ভূমিকায় ছবিরানি যথাযথ। শুভঙ্করের দীপক বেশ ভালো। তবে সবাইকে ছাপিয়ে গেছে সদাশিবদার মিস্টার ঘোষাল। মেক আপ নেবার আগেও যিনি গুনগুন করছিলেন, হোশওয়ালো কো কেয়া খবর/ বেখুদি কেয়া চিজ হ্যায়-- তিনি এত তাড়াতাড়ি এমন সাক্ষাৎ শয়তান হয়ে উঠবেন, বুঝতে পারিনি।
আসর ভাঙার পর গ্রিনরুমে গেলাম। কিন্তু বিশেষ করে যার জন্য যাওয়া সেই সদাশিবদা নেই। কোথায় গেছেন কেউ বলতে পারল না। শুভঙ্করের সঙ্গে গল্প করে গ্রিনরুম থেকে বেরিয়ে আসার সময় সদাশিবদার সঙ্গে দেখা হল। বললাম, কী ব্যাপার! কোথায় গিয়েছিলেন?
সবসময় আনন্দে থাকা মানুষটা অদ্ভুত বিষণ্ণ ভঙ্গীতে বললেন, মনটা ভালো নেই সন্দীপ। তাই প্যান্ডালের পিছনে চুপ করে বসেছিলাম।
রীতিমতো অবাক হয়ে বললাম, আপনার মন ভালো নেই! এ যে অসম্ভব ব্যাপার সদাশিবদা। কী হয়েছে?
তোমাকে সবই বলব। তবে তার আগে বলো আমার অভিনয় দেখে তুমি কিছু বুঝতে পারোনি?
একটা কথা অনেকক্ষণ ধরেই মনে হচ্ছিল। বললাম, বুঝতে পেরেছি কি না জানি না। তবে নাটক দেখে আমার মনে হয়েছে, মিস্টার ঘোষালকে আপনি মিস্টার ঘোষাল হিসেবে দেখেননি। রানিসাহেবার সেই প্রোডিউসার হিসেবে দেখেছেন। সেইজন্যেই সম্ভবত আপনার অভিনয়ে নিষ্ঠুরতার কোনও সীমা ছিল না।
আমি জানতাম তুমি বুঝবে। হ্যাঁ, লোকটা এইরকমই ছিল। একটা শয়তান। মনুষত্যহীন জানোয়ার। কিন্তু তবুও বলব আমার এত নিষ্ঠুর হওয়া উচিত হয়নি। কারণ শেষদিকে লোকটা পালটে গিয়েছিল। প্রতিশোধ নিয়েছিল সময়। প্যারালিসিসে অসাড় শরীরটা সারাদিন বিছানায় পড়ে থাকত। কথা বলতে পারত না। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকত সিলিঙের দিকে। আর মাঝে মাঝে কাঁদত। ওর ছেলের অনুরোধে আমি একদিন দেখতে গিয়েছিলাম। আজ আসর শেষ হওয়ার পর থেকে সেই অসহায় মুখটা বারবার মনে পড়ছে। জীবন যাকে শাস্তি দিয়েছে আমি তাকে কেন ক্ষমা করতে পারি না সন্দীপ? আমার মন এত ছোট কেন?
সদাশিবদা উদভ্রান্তের মতো কোথায় যেন চলে গেলেন।
আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। সকালের মানুষটার সঙ্গে এখনকার মানুষটাকে মেলাতে পারলাম না। সম্ভবত কোনওদিন পারবও না। অনেকদিন পরে যখন সদাশিবদার কথা মনে পড়বে সেদিনও এমনি করে অবাক হয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে থাকব। আর মনে মনে ধন্যবাদ দেব পথের দেবতাকে। এমন একজন অতলান্ত হৃদয়ের মানুষের সঙ্গে আমার দেখা করিয়ে দেওয়ার জন্য।
(ক্রমশ)

মন্তব্যসমূহ