সলিল চৌধুরী বিশেষ
।। গণসঙ্গীত যখন জনসঙ্গীত সলিল চৌধুরীর জাদুতে ।।
কাজল ভট্টাচার্য, কলকাতা,
মাত্র একটা গান।
আর সেই গানের কলির শব্দে শব্দে, সুরের ঠাটেই ধরা আছে একটা গোটা মানুষ।
"আজ নয় গুনগুন গুঞ্জন প্রেমে
"চাঁদ ফুল জোছনার গান আর নয়!"
কেমন সজোরে এক ঘা দিলেন রোমান্টিক বাঙালিকে! তারপরেই বললেন, "কার ঘরে প্রদীপ জ্বলেনি/ কার বাছার অন্ন মেলেনি।" সমাজের ছবিটাও তুলে ধরলেন। একবারে শেষ কলিতে লিখলেন, "তুমি হও একজন তাদেরই/ কাঁধে আজ তার ভার তুলে নাও..!"
আবার ওই গানেই সলিলবাবু কিন্তু আন্তর্জাতিক। "খুলে দাও জানালা আসুক/ সারা বিশ্বের বেদনার স্পন্দন!"
এই যে একটামাত্র গানেই, তার গীতিকার সুরকারকে ধরা, এতে কী প্রমাণ হলো? মানুষটি খর্বকায়। মোটেই না। প্রমাণ হলো, তাঁর গানের ব্যাপ্তি কী বিশাল। চিন্তাভাবনার প্রসারতা ঠিক কতদূর হলে মাত্র একটা সৃষ্টিতেই, স্রষ্টার গোটা অস্তিত্বটা ধরা পড়ে। এরকম অজস্র গান ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
১৯৭৪ সালের পুজো সংখ্যায় লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ওই রেকর্ডে উল্টোপিঠের গানটা ছিলো- "আজ তবে এইটুকু থাক!" গানের দ্বিতীয় অন্তরায় সলিলবাবু বললেন- "ভেঙ্গে পড়ে আছে রথ/ বহুদূর দূর যেতে হবে!"
এরপরেও কি সমাজ সচেতন এক শিল্পীর আরকিছু বলার থাকতে পারে? নাকি কোনও তথাকথিত গণসঙ্গীতে কেউ এরচেয়েও আরও বেশিকিছু বলতে পেরেছেন। ফারাক একটাই। সলিলবাবু সমাজবাদ, সাম্যবাদের এতগুলি কথা বলার পরেও দুটো গানই আধুনিক হিট। ঝকঝকে তকতকে। সবার পছন্দের। আজও পাড়ার জলসা হলেই হইহই করে বাজে। ভিক্টোরিয়ার বাগানে বসা যুগলের থেকে নিয়ে গড়িয়াহাটের হকার, সবার মুখে সেই গানের 'গুনগুন'। আবার সন্ধ্যায় গৃহস্থবাড়ির কিশোরী হারমোনিয়ম টেনে ওই সুর ধরে। দুটি গানেই গণসঙ্গীতের উপচে পড়া উপাদান। তারপরেও তা ছাপ্পামারা গণসঙ্গীত হলো না। হলো জনসঙ্গীত। এরজন্যই সলিল চৌধুরী। বাঙালির ড্রইংরুম থেকে নিয়ে হেঁসেলে আজও তিনি স্বমহিমায়।
আরও একটু পিছিয়ে যাই। ১৯৬৯ সালের এপ্রিলে সবিতা চৌধুরীর গলায় সলিল চৌধুরী রেকর্ড করলেন, "ও বউ কথা বলে পাখি আর ডাকিস না"। গানের স্থায়ীতেই জানিয়ে দিলেন, "বোবা বউ থাকা ভালো তাকি জানিস না!" শুধু বাংলাই না, গোটা ভারতবর্ষ তার বদলে যাওয়া সমাজ ব্যবস্থাকে নিয়ে যতোই বড়াই করুক না কেন, এই গান আজও চরম আধুনিক।
সলিলবাবুর রাজনৈতিক দর্শনের তথাকথিত ভক্তরা সারাটা জীবন আক্ষেপ করেই কাটালেন- ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না। সলিল চৌধুরী কিন্তু ফাটিয়ে গাইলেন। আজীবন। সম্ভবত সেই বঙ্গবাসী কলেজে পড়ার সময় থেকেই। সমাজ সচেতন তো ছিলেনই, কলেজ জীবনে রাজনীতি সচেতনও হয়ে উঠলেন। যোগ দিলেন ভারত ছাড়ো আন্দোলনে। স্নাতক হয়ে কলেজ থেকে বেরিয়েই নাম লেখালেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। ১৯৪৫ এর কৃষক আন্দোলনে নেমে পড়লেন তিনি। সার বুঝটা বুঝতে পারলেন, সঙ্গে চাই সাধারণ মানুষকে। সেই সাধারণ মানুষকে রাজনৈতিক সচেতন করে তোলার দিকেই মন দিলেন তিনি। যোগ দিলেন আইপিটিএতে। প্রথম দিকটায় হাতে বাঁশি তুলে নিয়েছিলেন। তারপর গান বাঁধতে শুরু করেন। ক্রমে ক্রমে নিজেকে মেলে ধরলেন সলিলবাবু।
শহর মফস্বলতো ছিলোই, অজ পাড়াগাঁয়েও নাটকের দল নিয়ে ঘুরে বেড়াতে শুরু করলেন টগবগে তরুন সলিল চৌধুরী। টাকা পয়সার দারুণ টানাটানি। ক্রোশের পর ক্রোশ দিব্য পায়ে হেঁটেই এগিয়ে যাওয়া। একদিন খাওয়া জোটেতো পরের দিন আধপেটা। উপোসও করতে হয়েছে। সলিলবাবুর রোজগার বলতে, মাস গেলে আইপিটিএ থেকে পাওয়া নামমাত্র কিছু টাকা। নুন আনতে পান্তা ফুরায়। এভাবেই চলতে লাগলো মানুষকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক বৈষম্য থেকে মুক্তি পেতে স্বাধিনতা আন্দোলনের গুরুত্ব বোঝানো। তবে সবকিছুই গান, নাটকের ছলে।
নিঃশব্দে, সবার অলক্ষ্যে তখন তৈরি হয়ে চলেছে সলিল চৌধুরীর এক নিজস্ব ঘরানা। প্রচলিত পথের থেকে একেবারেই আলাদা। সেই ছেলেবেলা থেকেই কান তৈরি হয়েছিল বাবার কিনে আনা রেকর্ডে পাশ্চাত্ত্য গানবাজনা শুনে। আর সমাজবোধ তৈরি হয়েছিল অসমে বাবার কর্মস্থলে চা বাগানের শ্রমিক, গ্রামের মানুষজনদের সমস্যা নিয়ে নাটক, গানবাজনা অনুষ্ঠানে। তারই ছাপ পড়েছিলো তরুন তুর্কি সলিল চৌধুরীর গানে, সুর সংযোজনায়।
নড়েচড়ে বসলো ব্রিটিশ পুলিস। নাটকের খবর পেলেই ছুটে যায় তারা। লাঠিপেটা করে তাড়িয়ে দেয় দর্শকদের। ধরপাকড় করে শিল্পীদের। একসময় অন্তরালে যেতে বাধ্য হন সলিলবাবু। তাঁর গোড়ার দিকের অনেক কাজই রাজরোষের শিকার হয়ে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। আবার রাজরোষে পড়ার ভয়ে কেউই সেগুলি আগলে রাখেনি। পরিণতিতে সেসব কাজ হারিয়ে গেছে চিরকালের জন্য। শোনা যায়, ১৯৪৫ থেকে ১৯৫১ সালের মধ্যে বেশকিছু অসাধারণ শিল্পসৃষ্টি করেছিলেন তিনি।
বরাবরই বামপন্থী আদর্শে বিশ্বাসী সলিল চৌধুরী। মানুষের মুক্তির উপায় খুঁজতেন কমিউনিজমে। আর তাঁর সেই একান্ত, অর্জিত জীবনদর্শনের কথা সবার কাছে পৌঁছে দিতেন কথায় সুরে। তবে অসাধারণ রসবোধ থাকলে যা হয়, তাঁর কথা কখনও শ্লোগান হয়ে ওঠেনি। প্রথমদিকের কিছু গানে প্রচলিত গণসঙ্গীতের প্রভাব থাকলেও, পরে তা উধাও হয়ে গেলো। আর সলিল চৌধুরী হয়ে গেলেন সার্বজনীন। বামপন্থীদের তো তিনি রইলেনই, কট্টর কমিউনিস্ট বিরোধীরাও দিব্য সুর ভাঁজতে লাগলেন সলিল চৌধুরীর। গণসঙ্গীত সলিলসঙ্গীত হয়ে বাজতে লাগলো জনতার দরবারে।
দেশ স্বাধীন হলো। তখনও আইপিটিএ নিয়ে মেতে আছেন সলিল। ওদিকে তলেতলে মতপার্থক্যের চোরাস্রোত বইতে শুরু করেছে কমিউনিস্ট পার্টির অন্দরমহলে। ঈর্ষা জন্ম নিয়েছে সলিলবাবুর জনপ্রিয়তা দেখে। ছড়ি ঘোরানোর চেষ্টা হয়েছিলো তাঁর ওপরেও। আর আটকানো গেলো না বেপরোয়া শিল্পীকে। এবার সলিল চলে এলেন শিল্প সংস্কৃতির মূলস্রোতে।
সাল ১৯৪৯। বাংলা সিনেমা 'পরিবর্তন'- এ সঙ্গীত পরিচালনা করলেন সলিল চৌধুরী। পরপর পাঁচটি সিনেমার কাজ শেষ হতে না হতেই বিমল রায়ের নজরে পড়ে গেলেন তিনি। ১৯৫৩ সালে শিল্পী উড়ে গেলেন আরব সাগরের তীরে। তাঁর লেখা 'রিক্সাওয়ালা' গল্প নিয়ে তৈরি হলো হিন্দি সিনেমা 'দো বিঘা জমিন'। সুরকারও তিনি। 'ধরতি কহে পুকার কে' গানের প্রিলিউডে শোনা গেলো রাশিয়ান রেড আর্মির কুচকাওয়াজের ছন্দ। প্রচলিত গানের ফর্ম ভেঙে চুরমার করে দিলেন তিনি। প্রাচ্য পাশ্চাত্য মিলেমিশে একাকার। গঙ্গা ভলগা বইলো একখাতে।
গানে এক অন্য মাত্রা যোগ করলো সলিলবাবুর কোরাস। আগে সুর, পরে লেখা হলো গান। মুম্বইয়ে কাজের সুবাদে আসমুদ্র হিমাচলের রসিক মহলে জায়গা করে নিলেন বাংলার সলিল চৌধুরী। তখনও মনের কোণে লুকিয়ে আইপিটিএ। বাণিজ্য নগরীতে গিয়েও সমান সমাজ সচেতন। ১৯৫৭ সাল। রুমা গাঙ্গুলিকে নিয়ে তৈরি করে ফেললেন 'বোমবে ইউথ কয়্যার'। এর পরের বছরেই রিলিজ করলো বিমল রায়ের 'মধুমতি'। সলিল চৌধুরীর সুর ঝড় তুললো দেশ জুড়ে। ১৯৫৮ তে পেয়ে গেলেন ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড'।
তবে প্রেম, ভালবাসার রঙিন আবেগের মধ্যেও, গানের আড়ালে উঁকি মেরেছে সেই সময়ের ছবি। সাল ১৯৫৪। রিলিজ হলো বিমল রায়ের 'নৌকরি'। শৈলেন্দ্রর সঙ্গে জুটি বেঁধে গান লিখলেন সলিল চৌধুরী। সুর দিলেন তিনি নিজেই। পরপর দুটি গানেই ধরা পড়লো সেই স্বপ্নের ছবি। চাকরি আর ঘরবাঁধা। প্রথম গান, 'এক ছোটি সি নৌকরি কা তলবগার'। দ্বিতীয়টি, 'ছোটা সা ঘর হোগা'। সিনেমা, চিত্রনাট্যের শর্ত মেনেও সেই সমাজের কথা। ফের প্রমাণ রাখলেন, বঙ্গবাসী কলেজের সলিল চৌধুরী বোম্বেতেও হারিয়ে যাননি।
'মধুমতী'র গান শুনে মজে গেলেন প্রয়াত মলিউড পরিচালক রামু কারিয়াত। খোঁজ নিলেন সুরকার কে। সেই প্রথম নাম শুনলেন সলিলের। শুনলেন সলিল চেন্নাইয়েই আছেন। সেখানে কোনও হিন্দি সিনেমার গান রেকর্ডিং করছেন। তাঁকে বললেন, মালয়ালম সিনেমা চিম্মেন- এর (১৯৬৫) জন্য সুর দিতে। ওদিকে সলিল মালয়ালমের বিন্দু বিসর্গও বোঝেন না। তবু রাজি হয়ে গেলেন। না ডোবাননি কারিয়াতকে। উল্টে সেই গান বাজার মাতিয়ে ছাড়লো। বাংলা অসম নেপালের মাটির সুর মাতিয়ে দিলো দক্ষিণকে। বাংলার মতোই কেরালেও সমান জনপ্রিয় সলিল চৌধুরী। দক্ষিণের কন্নড় তামিল তেলেগু ছাড়াও অসমীয়া গুজরাতি মারাঠি সিনেমাতেও সুর সংযোজনা করেছেন সলিল চৌধুরী। কী বলবো একে সাংস্কৃতিক আদান প্রদান? জাতীয় ঐক্য? কোনটাই নয়। কেতাবি ভাষায় সলিল চৌধুরীকে বাঁধার চেষ্টা ভন্ডামি।
শিল্প সাহিত্যের ওপর ভর করে, মানুষের বিবেক উসকে দিতে চেয়েছিলেন সলিল চৌধুরী। যাতে বৈষম্যের সমাজটা বদলে যায়। মনের সেই টান থেকেই ইন্ডিয়ান পিপল থিয়েটর এসোসিয়েশনে যোগ। তারপরেই গঙ্গার পাড় থেকে সোজা উড়ে যাওয়া নীল আরব সাগরের তীরে। দক্ষিণ ভারত ছুঁয়ে ভারত জয় অভিযান সেরে ফিরে এলেন তাঁর নিজের শেকড়ে। ১৯৭০ থেকে সলিল চৌধুরীর ঠিকানা হলো কলকাতা। গড়লেন 'সেন্টার ফর মিউজিক রিসার্চ'। আধুনিক সাজ সরঞ্জামে সমৃদ্ধ স্টুডিয়ো 'সাউন্ড অন সাউন্ড'। মনের গহীনে তখনও প্রচন্ড টান বামপন্থার। তবে পরিবর্তিত পৃথিবীর কমিউনিস্ট আন্দোলন দেশে হোক বা বিদেশে, ঠিক মেনে নিতে পারেননি তিনি। "পৃথিবীর গাড়িটা থামাও/ আমি নেমে যাব...।" ১৯৭৮ সালে গাইলেন সলিল চৌধুরী। একেবারে এক অন্য ধারার গান।
চরম উদার আধুনিক এই মানুষটি নয়া প্রজন্মের পাশ্চাত্ত্য পপ গানের ওপর টানের পেছনেও সামাজিক প্রেক্ষিত দেখেছিলেন। বলেছিলেন, "দেশ, সমাজের দিকে তাকান। অনিশ্চিয়তা আর অস্থিরতা আমাদের ঘিরে আছে। এই পরিস্থিতিতে তারা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ওপর মনোযোগী হবে ভাবা অন্যায়। ভালোমন্দের বিচারে কখনোই তাড়াহুড়ো করা ঠিক না।"
অবশেষে খাঁচা ভেঙে সেই বেপরোয়া সুরের পাখি একদিন উড়ে গেলো সুরের আকাশে। ১৯ নভেম্বরের দিনটা প্রতিবছর আমাদের মনে করিয়ে দেবে, সলিল চৌধুরী এসেছিলেন। কথা দিয়েছিলেন 'ঝড়ের কাছে রেখে যাব আমার ঠিকানা'। সুরের ঝড়ে আজও তিনি অক্ষয়। অমর। কন্যা অন্তরার 'সুরধ্বনি'তে আজও সুর ছড়াচ্ছেন।
(কৃতজ্ঞতা স্বীকার: বায়োগ্রাফি অফ সলিল চৌধুরী, চন্দ্রকান্ত)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন