রাজনীতির স্বার্থসিদ্ধিতে এভাবেই বারেবারে হিংসার বলি হন বাংলার মইদুলরা,তবুও বদলায় না রাজনৈতিক হিংসার ছবিটা - বিশেষ কলম
শাসক বদলায়, পশ্চিমবঙ্গের ছবি বদলায় না
রাজদর্শী রায়, কলকাতা, ১৮ ফেব্রুয়ারি:
অবশেষে মইদুল মরিয়া প্রমাণ করিল, সে চাকরির দাবি আদায় করিতে পারে।
পাশাপাশি নিঃশব্দে ঘটে গেলো আরও এক ঘটনা। সোমবার লাশকাটা ঘরে যাওয়ার আগেই, নির্বাচনী প্রচারে তাঁর দল সিপিএমকে একেবারে সামনের সারীতে এনে দিয়ে গেলো বাঁকুড়ার ওই অখ্যাত যুবক মইদুল ইসলাম মিদ্যা। ওদিকে কোতুলপুরের গ্রামে পড়ে রইলো সিপিএমের যুবকর্মী মইদুলের মা, স্ত্রী, তিন কন্যাসন্তান।
নবান্ন অভিযানে মইদুল মিদ্যার মৃত্যু নিয়ে তোলপাড় বাংলার রাজনীতি। এতদিন ভোটযুদ্ধে বাজার গরম রেখেছিল তৃণমূল কংগ্রেস, বিজেপি। বাম কংগ্রেস জোট কিছুতেই জায়গা করে উঠতে পারছিলো না এই দুই প্রতিদ্বন্দীর কাছে। রাতারাতিই ছবিটা গেলো পাল্টে। মইদুলের মৃত্যুর পরেই তৃণমূল কংগ্রেস, বিজেপিকে পেছনে ফেলে একেবারে সামনের সারীতে চলে এলেন বামপন্থীরা। সঙ্গে জোটসঙ্গী কংগ্রেস।
মইদুলের মৃত্যু যে কোনও অভাবনীয় ঘটনা এমনটা নয়। ভোটবাজার গরম হয়ে ওঠার পর থেকেই একের পর এক হামলাবাজির ঘটনা, এমনকি কিছু খুনোখুনীর ঘটনায় বাকযুদ্ধে মেতেছিল জোড়া ফুল, পদ্ম ফুল শিবির। এবার সেখানে বাম কংগ্রেস জোটকে জায়গা করে দিলো বাঁকুড়ার তরুনের নৃশংস মৃত্যু। রেজিমেন্টেড দল সিপিএম। একটুও দেরি না করে মইদুলের মৃত্যুর প্রতিবাদে রেল রোকো, রাস্তা রোকো করে তাঁতিয়ে তুললো বঙ্গ রাজনীতি। আরও একবার দেখা গেলো সরকারকে শিক্ষা দিতে, জনজীবন স্তব্ধ করে দেওয়ার পুরনো রাজনৈতিক রণকৌশল।
পাশাপাশি নবান্ন অভিযানে ডিওয়াইএফআই কর্মীর মৃত্যতে প্রশ্নের জবাব দিতে হবে রাজ্যের পুলিসমন্ত্রীকেও। তালতলা থানার এএসআই অভিনব দত্তের গায়ে হাত তোলার অপরাধে, সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী আড়াইশোজন বাম যুব ছাত্র নেতার বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা রুজু করেছে পুলিস। কিন্তু মইদুলকে লাঠিপেটা করে হত্যার অভিযোগে ঠিক কতজন পুলিসকর্মীর বিরুদ্ধে প্রশাসনিক পদক্ষেপ করা হলো?
তবে যাবতীয় তর্ক বিতর্ক ছাপিয়ে, যে প্রশ্নের উত্তর খোঁজা এমুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি তা হলো, ঠিক কার প্ররোচনায় প্রাণ গেলো মইদুলের?
মিছিল কোন পথ ধরে এগোবে তা নিয়ে নবান্ন অভিযানের আগের রাতেও একমত হতে পারেননি পুলিসকর্তা আর যুবনেতারা। ওদিকে পুলিসকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসেন বামকর্তারা। হুমকি আসে, মিছিল আটকানোর চেষ্টা হলে, পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে বলা যায় না। এরপর পরিস্থিতি বাস্তবে কী দাঁড়িয়েছিল তার পুনরাবৃত্তি অপ্রয়োজনীয়। গোটা ঘটনায় পরিষ্কার, আঘাত প্রত্যাঘাতের ঝুঁকি নিয়েই সেদিন মিছিল শুরু করেছিলেন ডিওয়াইএফআই কর্মীরা।
এরই পাশাপাশি উঠে আসে আরও এক অপরিহার্য প্রশ্ন।
কর্ম সংস্থানের দাবিতে আন্দোলনের জন্য ঠিক এই সময়টাকেই কেন বেছে নিলেন সিপিএমের যুব সংগঠন কর্তারা? কেনই বা তাতে সিলমোহর দিলো আলিমুদ্দিন?
খোদ সিপিএম ভবিষ্যদ্বাণীও করেছে, এবার বিদায় তৃণমূলের। ক্ষমতায় আসছে বাম কংগ্রেস জোট। ওদিকে যে কোনদিন ঘোষনা হয়ে যেতে পারে নির্বাচনের দিনক্ষণ। ঠিক এরকম এক সময় যখন বাম কংগ্রেস উভয়েই ভবিষ্যদ্বাণী করছে মমতা সরকারের আয়ু ফুরিয়ে এসেছে, ঠিক তখনই শিল্প, কর্মসংস্থানের দাবিতে নবান্ন অভিযানের কি ন্যুণতম কোনও সারবত্ত্বা ছিলো? এক বিদায়ী সরকারের বিরুদ্ধে এমন আন্দোলনের যুক্তি কোথায়?
নাকি সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্যই যথার্থ- সিপিএম কর্তারা কারুর মৃত্যু না চাইলেও, একটা গণ্ডগোল পাকাতে চাইছিলেন। আর ওই গণ্ডগোলেরই বলি হলেন মইদুল।
যে শিল্প কর্মসংস্থানের দাবিতে সিপিএমের যুব সংগঠনকর্মীরা সেদিন নবান্ন অভিযানে নেমেছিলেন, সেই শিল্পের ছবিটা কেমন দাঁড়িয়েছিল বাম জমানায়?
স্বাধীণোত্তর ভারতবর্ষে প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ, বিধানচন্দ্র রায় জমানায় পশ্চিমবঙ্গের শিল্পসমৃদ্ধ চেহারাটা ছিলো চোখে পড়ার মতো। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৫৯ সালে ভারতের রেজিস্টার্ড শিল্পে মোট আয়ের ২২.২ শতাংশই ছিলো ছিল পশ্চিমবঙ্গের একার। এরপর ১৯৬৩ সাল নাগাদ প্রফুল্লচন্দ্র সেনের আমলে তা আরও খানিকটা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ২৩.১ শতাংশ। তারপরেই রাজ্য জুড়ে শুরু হয়েছিলো এক ঘোর রাজনৈতিক অস্থিরতা। আর ঠিক তখনই শিল্প অবক্ষয়ের শুরু। ১৯৬৭ সালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলো পশ্চিমবঙ্গের। যুক্তফ্রন্টের ক্ষমতায় আসার ঘটনা দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে সূচনা হলো বাম জমানার। মুখ্যমন্ত্রী হলেন অজয়কুমার মুখোপাধ্যায়। মাত্র আট মাসের মধ্যেই পতন হলো সেই সরকারের। এরপর ফের স্বল্প সময়ের জন্য ক্ষমতায় ফিরে আসা প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ, অজয়কুমার মুখোপাধ্যায়ের হাত ঘুরে, রাষ্ট্রপতি শাসনের মেয়াদ কাটিয়ে রাজ্য রাজনীতির ক্ষমতা দখলে প্রত্যাবর্তন হলো কংগ্রেসের। মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে বসলেন সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়।
সত্তর দশকের মাঝামাঝি সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় জমানায় রেজিস্টার্ড শিল্পে আয় ঠেকলো ১০.২৪ শতাংশে। এরপরেই ১৯৭৭ সালে ক্ষমতার রাশ গেলো জ্যোতি বসুর হাতে। শিল্পের আয় কমতে কমতে ১৯৮৭- ৮৮ সাল নাগাদ তা পৌঁছে গেলো ৭.২ শতাংশে। বামবিরোধী কংগ্রেসের অভিযোগ, রাজ্যের প্রায় ৫৮ হাজার কলকারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বাম জমানায়। এই গোটা ঘটনার দায় ঝেড়ে ফেলতে বামফ্রন্ট সরকারের পরিচিত বাক্যবন্ধটি ছিলো- কেন্দ্রের বঞ্চনা। আর দিল্লির মাশুল সমীকরণ নীতির চাপ। পশ্চিমবঙ্গের শিল্পব্যবস্থা রুগ্ন হওয়ার জন্য কেন্দ্রের কংগ্রেসের সরকারের বৈষম্যমূলক শিল্পনীতির দিকেই আঙুল তুলতেন বামপন্থীরা। ওদিকে কংগ্রেসের বক্তব্য ছিলো, রাজ্যের কলকারখানা বন্ধ হওয়ার মূলে ছিলো সিপিএম শ্রমিক সংগঠনের জঙ্গী আন্দোলন। বিরোধিতার সেই ধারাবাহিক ইতিহাস ভুলিয়ে দিতে বাম কংগ্রেস জোট আজ এক মঞ্চে।
রাজ্যে পুলিসের অত্যাচারের বিভৎসতম ছবিও দেখা গিয়েছিল কংগ্রেস জমানাতেই।
নকশাল আন্দোলন দমনের নামে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় সরকারের পুলিস সেদিন যে তাণ্ডব চালিয়েছিল, আজও তা ফিরে ফিরে আসে বাংলার শিল্প সাহিত্যে। অতি বামপন্থীদের পাশাপাশি সেই বর্বরতার আঁচ লেগেছিল বামপন্থীদের গায়েও। সরকার বদলালেও পুলিসের অত্যাচারের সেই ছবি কিন্তু বদলায়নি। জ্যোতি বসু জমানাতেও একের পর আর এক ঘটনায় বাংলার রাজনীতি তোলপাড় হয়েছিল পুলিসের বর্বরতা নিয়ে। ১২ ফেব্রুয়ারি নবান্ন অভিযানে পুলিসের হাতে মইদুলের মৃত্যুর দায়ে যেভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কাঠগড়ায় তুলেছেন বামপন্থীরা, ঠিক সেভাবেই ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই মহাকরণ অভিযানে পুলিসের হাতে তেরো যুব কংগ্রেস কর্মীর প্রাণ যাওয়ার ঘটনায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর দিকে আঙুল তুলেছিল কংগ্রেস।
বাম নেতারা রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধিতে যেভাবে সিদ্ধার্থ জমানার কথা ভুলে মেরে দিয়েছেন, ঠিক সেভাবেই জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য জমানার নন্দীগ্রামের কথা ভুলে মেরে দিয়েছেন কংগ্রেস নেতারা। আজ অতীতের দুই যুযুধান পক্ষই হাতে হাত মিলিয়ে এক মঞ্চে। বাম কংগ্রেস জোটের নেতারা গলা ফাটাচ্ছেন মমতা সরকারের শিল্পনীতির ব্যর্থতা, পুলিসের অত্যাচার নিয়ে। ওদিকে মৃত মইদুলের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে তাঁর পরিবারের একজনকে চাকরি দেওয়ার ঘোষনা করে, পুলিসের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।
রাজনীতির স্বার্থসিদ্ধিতে এভাবেই বারেবারে হিংসার বলি হন বাংলার মইদুলরা। প্রাণ দিয়েই তাঁরা এগিয়ে দিয়ে যান নিজেদের দলকে। আজ যে দল শাসকের বিরোধিতা করতে গিয়ে হিংস্রতার শিকার হয়, কাল সে দলই শাসকের গদিতে বসে। তবুও বদলায় না রাজনৈতিক হিংসার ছবিটা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন