রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন- সন্দীপ চক্রবর্তীর ধারাবাহিক উপন্যাস \ ধুলো

 


 আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম ।সন্দীপের নতুন উপন্যাস   ধুলো# ৫ । একেবারে এক নতুন চিন্তা ধারার প্রতিফলন।  আগামীদিনে   সঙ্গে থাকবেন।


                            ধুলো # ৫






সন্দীপ চক্রবর্তী
সেই রাতেই শালোপাড়ার জঙ্গল মুখর হয়ে উঠল। দশজন বাছাই করা লেঠেল আর চারজন বন্দুকবাজ রওনা দিল লোনাপানির দিকে।
সিদ্ধান্তটা কিছুটা হঠকারী। রাতের জঙ্গলে সাঁওতালদের তিরধনুকের সঙ্গে মাত্র চারটে বন্দুক নিয়ে লড়াই করা বেশ কঠিন। লাঠি এ ক্ষেত্রে ধর্তব্যের মধ্যেই পড়ে না। প্রতাপচন্দ্র হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিলেন। বিলাসচন্দ্রের জন্য দুশ্চিন্তা তো ছিলই। সেই সঙ্গে ছিল অপমানের জ্বালা। অজ্ঞাতকূলশীল এক সাঁওতালের বিদ্রোহ তিনি যদি দমন করতে না পারেন তা হলে রায়চৌধুরীদের মানমর্যাদা বলে আর কিছু থাকবে না। জমিদারি রক্ষা করাই দায় হয়ে উঠবে।
তার পরিকল্পনা অবশ্য খাটল না। রাত্রি তৃতীয় প্রহরে চারটে ডিঙি নৌকো ঘাটে এসে লাগতেই ছুটে এল ঝাঁকে ঝাঁকে তির। লেঠেলদের সর্দার গণেশ মণ্ডল 'মা গো' বলে পড়ে গেল লোনাপানির জলে। বন্দুকধারীরা গুলি ছুঁড়ল বটে কিন্তু কাকে লক্ষ করে ছুঁড়ল তারাই জানে। প্রতাপচন্দ্র যে ঝামেলা বাঁধাবেন সনাতন আগেই বুঝতে পেরেছিল। তাই সে আর তার সঙ্গীরা ডেরা বেঁধেছিল গাছের ডালে। খেলা শেষ করতে তাদের আধঘন্টাও লাগল না।
পরেরদিন খবরটা হাওয়ার চেয়েও দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ল৷
প্রতাপচন্দ্র ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়েছিলেন। বিলাসকে কী করে ফিরিয়ে আনবেন সেই ভাবনা ছাড়া তিনি অন্য কিছু ভাবতে পারছিলেন না। বৃদ্ধ নায়েব রাধামোহনকে পাঠালেন সনাতনকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিরস্ত করার জন্য। কিন্তু সনাতনকে টলানো গেল না। রাধামোহনকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে সনাতন বলল, 'তু বড়ো ভালো লোক ঠাকুর। তুর পায়ের ধুলো মাথায় ঠেকাইলে জীবনটা ধন্য হইয়া যায়। কিন্তু উ রাজারে বিশ্বাস লাই। উয়ারে বল্যে দিস, যে কথা কইয়া দিছি তার লড়চড় হবেক লাই। বিলাস জামিন থাইকবেক।'
তখন ব্রিটিশ আমল৷ আর কোনও উপায় না দেখে প্রতাপচন্দ্র ব্রিটিশ সরকারের শরণাপন্ন হলেন। ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে পুলিশ সুপার মার্টিন হুইটম্যান নিজে এলেন তদন্ত করতে৷ সনাতনের ভাগ্য ভালো জাতে ব্রিটিশ আর কর্মসূত্রে পুলিশ অফিসার হলেও মার্টিন হুইটম্যান স্বভাবে ছিলেন ভদ্রলোক। তা না হলে সনাতনের ফাঁসি কেউ আটকাতে পারত না। প্রতাপচন্দ্র সেরকম প্রস্তাবই করেছিলেন। শুধু বিলাসকে ফিরে পেলে তার কাজ চলে না। জমিদারের মর্যাদাও ফেরত পাওয়া দরকার। তার জন্য সনাতনের গলায় দড়ি বেঁধে গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেওয়াই সব থেকে ভালো উপায়। কিন্তু প্রতাপচন্দ্রের এক লক্ষ টাকা উৎকোচের প্রস্তাব সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে মার্টিন হুইটম্যান বললেন, 'টেন সনাতন উইল বি বর্ন ফলোইং দা ডেথ অব ওয়ান সনাতন। ইউ ওয়ন্ট বি এবল টু বাই টেন মোর লাইভস বাবু। উতনা রুপেয়া তুমহারে পাশ নেহি হ্যায়। তার চেয়ে হামাকে কাম করিতে দাও।'
সনাতনকে ডেকে পাঠানো হল। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে ব্রিটিশ পুলিশ অফিসারের ডাক উপেক্ষা করা তত সহজ ছিল না। সনাতনও সে দুঃসাহস দেখালো না। মার্টিন হুইটম্যান বললেন, 'হাম তুমহারা পিতা সমান হ্যায়, মাই বয়। কোনও অন্যায় ঘটিলে সোজা হামার কাছে আসিবে। আয়াম আ ক্যাথলিক ক্রিশ্চান। আই সোয়ার ইউ, নাথিং রং উইল হ্যাপেন।'
সনাতন ভাষা বুঝল না বটে কিন্তু ভাব বুঝল। হুইটম্যান সাহেবের মধ্যস্থতায় স্থির হল, রায়চৌধুরী বংশের কেউ লোনাপানির খাল পেরিয়ে সাঁওতালদের গ্রামের দিকে যাবে না। নায়েব রাধামোহন যেতে পারবেন। তার হাতেই খাজনা তুলে দেবে সাঁওতালরা।
বাবার হাত ধরে বিলাস ফিরে এল। কিন্তু জমিদারের ভয়ে বাঘে আর গোরুতে এক ঘাটে জল খাওয়ার হাড় হিম করে দেওয়া প্রবাদটা আর তত ভয়ংকর থাকল না।
তারপর অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। সোনালদি গ্রামের অনেকই পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু একটা নিয়ম অপরিবর্তনীয় থেকে গেছে। প্রতাপচন্দ্রের পর রায়চৌধুরী বংশের আর কোনও পুরুষ হুইটম্যান সাহেবের টেনে দেওয়া লক্ষণরেখা পেরিয়ে লোনাপানি গ্রামে যাওয়ার সাহস দেখাননি। বস্তুত তারা ছোটবেলা থেকেই একটা ভয়কে সংস্কারের মতো লালন-পালন করতেন। যেন সাঁওতাল পল্লী একটি বর্জিত এলাকা। সেখানে গেলে মানুষ আর ফেরে না। কালক্রমে রায়চৌধুরীদের জমিদারির ভিত আরও দুর্বল হয়েছে। এবং তার সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়ায় সংস্কারের ভিত হয়েছে আরও মজবুত।
সেই মজবুত ভিতে শোভেন প্রথম আঘাত হেনেছিল। কারণ রূপমতী সনাতন টুডুর বংশের মেয়ে। শোভেন তাকে ভালোবাসে জানার পর রূপমতী খোলসা করেই তার পরিচয় দিয়েছিল। শোভেন বিন্দুমাত্র বিস্মিত হয়নি। যে কোনও মানুষের একটি পারিবারিক অতীত থাকবে। পরিচয়ও থাকবে। এমনই স্বাভাবিক বিশ্বাসে বলেছিল, 'আমি তোমাকে ভালোবাসি রূপা। বিয়ে করতে চাই। তাই অতীতকে ভয় করে চলার কোনও দায় আমার নেই।'
বাড়িতে এই সম্পর্কের কথা জানত একমাত্র নন্দ। বেশ কয়েকবার সে শোভেনের দূতের কাজ করেছে। কিন্তু রমেনবাবু বা অন্নপূর্ণাকে বিন্দুবিসর্গ বুঝতে দেয়নি।
তবুও রমেনবাবু একদিন জানতে পারলেন। সেদিন খবরের কাগজ নেবেন বলে রমেনবাবু ছেলের ঘরে ঢুকেছিলেন। টেবিলের ওপর একটি মেয়ের পেন্সিল স্কেচ দেখে তার পা আচমকাই থেমে গেল৷ ছোটবেলা থেকেই শোভেনের ছবি আঁকার হাত দারুণ। এই ছবিও তারই আঁকা। কিন্তু মেয়েটি কে? পুরু ঠোঁট আর খোঁপায় করৌঞ্জ ফুলের বাহার দেখে রমেনবাবুর মনে হল মেয়েটি সাঁওতাল।
শোভেন বাড়িতে ছিল না। ফিরতেই রমেনবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, 'মেয়েটি কে ভানু?'
কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল শোভেন। সম্ভবত আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করল। তারপর আগাগোড়া সব কথা খুলে বলল। এমনকী, সে যে রূপমতীকে বিয়ে করতে চায় সে কথাও গোপন করল না।
হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন রমেনবাবু। ভয়, দুর্ভাবনা, দুশ্চিন্তার একটা মিশ্র অনুভূতি তাকে অনেকক্ষণ কথা বলতে দেয়নি। কিন্তু তিনি রমেন রায়চৌধুরী। বিলীন হয়ে যাওয়া অভিজাততন্ত্রের জীবন্ত প্রতিনিধি। চিরকাল মন আর মুখের মধ্যে অপার ব্যবধান রক্ষা করে এসেছেন। অপ্রস্তুত ভাব কাটিয়ে উঠেই তিনি রাগে ফেটে পড়েছিলেন, 'তোমার সাহস তো কম নয় ভানু! একটা খুনির বংশের মেয়েকে তুমি এ বাড়ির বউ করতে চাও?'
শোভেন শান্ত সংযত ভঙ্গিতে বলেছিল, 'আমরা লম্পট বলেই ওরা খুনি বাবা।'
কথাটা তিরের মতো রমেনবাবুর বুকে বিঁধেছিল। মুহূর্তের জন্য তিনি শোভেনের মধ্যে সনাতন টুডুকে দেখতে পেয়েছিলেন। দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ প্রবাদবাক্যটির কথা তিনি জানতেন। কিন্তু এ তো প্রহ্লাদের কুলে দৈত্য! বেজায় ভয় পেয়েছিলেন রমেনবাবু। সেদিন আর কোনও কথা হয়নি।
পরের দিন থেকে শুরু হয়েছিল পাখি পড়ানো। রায়চৌধুরী বংশ বহু প্রাচীন বংশ৷ স্বয়ং বাদশাহ আওরঙ্গজেব রায়রায়ান খেতাব দিয়েছিলেন। সেই হুকুমনামা এখনও আছে৷ রূপমতীর কোনও বংশমর্যাদা নেই। অর্ধসভ্য অর্ধশিক্ষিত সমাজে তার জন্ম। সে এই বাড়ির বউ হয়ে এলে লোকে ছি ছি করবে। ইত্যাদি।
শোভেন শুধু একটি কথাই বলেছিল, 'আমি মানুষ মানি বাবা। রূপাও আমার কাছে স্রেফ একজন মানুষ। তার বংশমর্যাদা নিয়ে আমি কী করব বলুন তো।'
তিনমাস কেটে গেল। কিন্তু কোনও মীমাংসা হল না। রমেনবাবু তখন মেয়েদের সঙ্গে পরামর্শ করাকে পুরুষত্বের হানি বলে মনে করতেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাকে অন্নপূর্ণার শরণাপন্ন হতে হল। রূপমতীর ব্যাপারে অন্নপূর্ণার এমনিতে কোনও আপত্তি ছিল না। ছেলে সুখী হলেই তিনি সুখী। কিন্তু গোল বাঁধল স্ত্রী-ধর্মে। তিনি রমেনবাবুর কথাগুলোই ছেলের কাছে উগরে দিলেন। শোভেন অবাক হল না। এরকম যে হবে সে জানত। প্রতাপচন্দ্র মারা যাবার পর দু'টো বিশ্বযুদ্ধ হয়ে গেছে। ভারত স্বাধীন হয়েছে। দেশভাগ হয়েছে। কিন্তু মেয়েদের প্রতি এ বাড়ির পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গি বিন্দুমাত্র বদলায়নি। পুরুষের প্রতি মেয়েদের দৃষ্টিভঙ্গিও থেকে গেছে একই জায়গায়।
অবশেষে রমেনবাবু প্রয়োগ করলেন তার ব্রহ্মাস্ত্র। তিনি ভেবেছিলেন শোভেন বিএ পাশ করলেও এখনও চাকরি পায়নি। টাকাপয়সার ব্যাপারে ছেলে তার ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং এই একটি পথেই শোভেনকে ফেরানো সম্ভব। একদিন বেশ গম্ভীর হয়ে বললেন, 'তুমি যখন ওই মেয়েটাকে বিয়ে করবেই তখন আমারও একটা কথা তোমার শুনে রাখা দরকার। এ বাড়িতে ওসব হবে না। বিয়ে করতে হয় বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে করো।'
অন্নপূর্ণা আর্তনাদ করে উঠলেন। কিন্তু রমেনবাবু পাত্তা দিলেন না। তিনি নিশ্চিত ছিলেন আলাদা সংসার পাতার পুঁজি যখন শোভেনের নেই তখন সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে বিয়ে করার ঝুঁকি নিতে পারবে না৷ কিন্তু তাকে অবাক করে শোভেন বলেছিল, 'ভেবেছিলাম পূর্বপুরুষের পাপের প্রায়শ্চিত্য করার একটা সুযোগ আপনি আমায় দেবেন। কিন্তু আপনি যখন চান না তখন তাই হবে। আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েই রূপমতীকে বিয়ে করব।'
পরেরদিন একবস্ত্রে গৃহত্যাগ করেছিল শোভেন। অন্নপূর্ণার কাতর অনুনয় তাকে ফেরাতে পারেনি।
মর্মাহত অন্নপূর্ণা পাঁচ বছর পর তার অসহনীয় স্ত্রী-ধর্ম থেকে মুক্তি পেয়ে বিদায় নেন।
থেকে যান শুধু রমেনবাবু।
(ক্রমশ)

মন্তব্যসমূহ