দ্বিখণ্ডিত
- কাজল ভট্টাচার্য
দুজনেই ছিলাম একসঙ্গে। একেবারে গায়ে গা লাগিয়ে।
সেই নিজেকেই চিরে ফেলেছি আমি। লম্বালম্বি। যাতে দুভাগেই আমার শরীরের গুরুত্বপূর্ণ সবকিছুর এক সুষ্ঠু বন্টন হয়। একদিকে হৃদপিণ্ড গেলে অন্যদিকে ফুসফুস। কেউ কাউকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না। বেশি ট্যাফোঁ করলেই বিপদ দুজনের। কেউ দিব্যি দেয়নি, তবু বাঁচতে হবেই। তা সে আরশোলার মতোই হোক না কেন? যুগ যুগান্তর বাঁচতে হবে। এর হেঁসেলের কোণে, ওর আলমারির অন্ধকার কোণে। তবু জীবন্ত যাপন।
ফুসফুস রাগ করলে হৃদপিণ্ড একা টানতে পারবে না। ব্যাস তাহলেই হলো! মরলে তোকে নিয়েই মরবো। হৃদপিণ্ডের সেকথা বুঝতে পারলেই ফুসফুস আর তড়পাবে না। আবার উল্টোটাও। হৃদয় বেশি কায়দাবাজি করলেই ফুসফুস পাল্টা দেবে। একের প্রয়োজনেই আরেকের বেঁচে থাকা। একসঙ্গে বাঁচা একসঙ্গে মরা। সহমরণের এক নব্য সংস্করণ।
সহমরণ বেআইনি। কিন্তু এই নব্য সংস্করণ ছাড়া আমার কোনও উপায় ছিলো না। হতে পারে এই বিধিব্যবস্থা নিয়েও তর্ক উঠবে। একদিন যেমন ক্লোন নিয়ে কথা উঠেছিল। কিন্তু ওই যে কথা আছে- আপনি বাঁচলে বাপের নাম। তাই ওসব আইনকানুন বৈধ অবৈধ নিয়ে ভাবলে আমার চলে না। ভীষণ লোভ হয় যে বেঁচে থাকতে।
একা বেঁচে থাকাটা কিছুতেই অভ্যাস করতে পারিনি। একে ধরেছি তাকে ধরেছি, কেউই শেষ পর্যন্ত পাত্তা দেয়নি।
রক্তচাপ কখনও বেড়েছে কখনও কমেছে। কিছুতেই স্বাভাবিক রাখতে পারিনি। কখন যেন ভীতু হয়ে গেছি। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হলেই মনখারাপ আর ভয় ভর করতো। রাত গড়ানোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে তা বেড়েই চলতো। এরপর একসময় সেই ভয় হয়ে বসতো আতঙ্ক।
ঘুম উবে গেছিলো। চোখ বুজলেই মনে হতো আবার চোখ খুলবোতো। ভোরের আলো দেখতে পাবতো। নিদ্রাহীন রাত। শরীরে দেখা দিলো নানা উপসর্গ। চিকিৎসক নিদান দিলেন একা থাকবেন না। ওদিকে খবরের কাগজ থেকে নিয়ে নিউজ চ্যানেল, সবজায়গায় মৃত্যুর ছড়াছড়ি। কোভিড আতঙ্ক। বেড়ে গেলো হৃদয়ের ধুকপুকানি। দুর্বল হলো ফুসফুস। ইনহেলারের ধাক্কা বাড়িয়ে চেষ্টা হলো তাকে সতেজ রাখার।
আমি অর্ধেক হয়ে যাচ্ছি। চিকিৎসকের হুঁশিয়ারি। বন্ধুবান্ধবদের উৎকন্ঠা। ওজন কমছে। গাল তোবড়াচ্ছে। খাওয়া কমছে। কমে আসছে শরীরের শক্তি। দ্রুতগতিতে দৌড়চ্ছে রক্ত। দমবন্ধ হয়ে আসছে। শরীর আধখানা হয়ে আসছে। সুন্দর থেকে অসুন্দরের গ্রাসে চলে যাচ্ছি। ভয়ের দিন, আতঙ্কের রাত।
এরপরেই এক গভীর রাতে চিরে ফেললাম নিজেকে। এর আগেও আমাকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলা হয়েছিল। স্বর্গের প্রভু জিউস শাস্তি দিয়েছিলেন আমাকে। হারিয়ে গেছিলো আমার শরীরের অর্ধাঙ্গ।
আমরা সেই গল্পই শুনেছিলাম প্লেটোর মুখে। তবে সেই ভুলে যাওয়া অতীতের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন অ্যারিস্টোফেন। সেদিন প্লেটোর ডিনার পার্টি 'সিম্পোসিয়াম'- এ আমন্ত্রিত ছিলেন অ্যারিস্টোফেন। সেই ভোজসভাতেই অতিথিদের এই গল্প শোনান তিনি।
তখন মানুষ ছিলো বর্তুলাকার। তাঁর সৃষ্টিকে সর্বশক্তিমান করে তুলতেই স্বর্গের প্রভুর ওই আয়োজন। পুরুষের অধীশ্বর ছিলেন সূর্যদেব। পৃথিবী ছিলেন নারীর। এছাড়া ছিলো আরেক প্রজাতি, একই দেহে নারীপুরুষ। সেই অর্ধনারীশ্বরের অধিপতি ছিলেন চন্দ্রদেব।
দুধারে দুই মুখওয়ালা সব শরীরেই ছিলো দুজোড়া করে হাত, পা। চারধারের সবকিছুই দেখে সদাসতর্ক থাকতে পারতো সেই মানুষ। পেছন থেকে বিপদ এসে শিয়রে হানা দেওয়ার কোনও সুযোগ ছিলো না। ছিলো না সামনে, পেছনের ভেদাভেদ। ইচ্ছেমতো দুদিকেই চলতে পারতো মানুষ। সেই সঙ্গে ছিলো চার হাতের দ্বিগুন বাহুবল।
আধুনিক সভ্যভব্য মানুষের মতো, নিজের ক্ষমতায় অন্যকে বশ করার প্রবৃত্তি ছিলো সেই আদিম মানবজাতির মধ্যেও।
সেদিনের বাহুবলীরা একদিন সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসেছিলো সৃষ্টিকর্তাকেই। নিজের সৃষ্টির ওই ঔদ্ধত্য দেখে রেগে লাল হলেন প্রভু জিউস। তলোয়ারের এক কোপে, লম্বালম্বিভাবে দুভাগে চিরে ফেলেছিলেন সমগ্র মানবজাতিকে। রক্তের বান ডাকলো পৃথিবীর বুকে। দশদিশি ভরে গেলো আর্তনাদে। 'হায় হায়' করে উঠেছিলো মানবজাতি। ভয়ে, আতঙ্কে উথালপাথাল পৃথিবী। দ্বিখণ্ডিত মানুষরা ছুটে পালিয়েছিলো যেদিকে দুচোখ যায়। এরপরেও ক্ষমতার আস্ফালন দেখালে ফল হবে মারাত্মক, হুমকি দিয়েছিলেন জিউস। ফের দুটুকরো করে ফেলবেন সবাইকে।
এরপরেই শুরু হলো আত্মানুসন্ধান। নিজের হারিয়ে যাওয়া অংশের খোঁজ। একমুখ, একজোড়া হাত পাওয়ালা মানুষের জীবনের এক নয়া অধ্যায়। #
ঠিক আজকের আমার মতো। দুহাত দুপা, এক মুখওয়ালা এই আমি। জীবনভর খুঁজে গেলাম আমার হারিয়ে ফেলা অর্ধাঙ্গকে। অনেকের সঙ্গেই দেখা হলো। কিন্তু তার সঙ্গে দেখা হলো না। বারেবারে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এলাম আমার এই আমি।
সেই থেকে একা আমি। সেই প্রাচীন ঔদ্ধত্যের বাস আজও আমার মধ্যে। তাই ফিরেও তাকালেন না প্রভু জিউস আমার দিকে।
'যারা ঔদ্ধত্য ভুলে যাবে তাদের সহায় হবো,' কথা দিয়েছিলেন জিউস। ভাগ্যবানরা খুঁজে পেয়েছিলো তাদের হারিয়ে যাওয়া অর্ধাঙ্গকে। এক সুদীর্ঘ বিচ্ছেদের পর সেই মিলনদৃশ্য দেখে চোখ ছলছল করে উঠেছিল জিউসের। কঠিন আলিঙ্গনে দুই অর্ধাঙ্গ ফের মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে চেয়েছিলো। সূর্যের সৃষ্টি পুরুষের সঙ্গে পুরুষ, ধরিত্রীসন্তান নারীর সঙ্গে নারী আলিঙ্গনে আবদ্ধ। একমাত্র চন্দ্রদেবের সন্তানরা মিলিত হলেন নারীপুরুষে। দুই অর্ধাঙ্গের কেউ কাউকে ছাড়তে চায় না। কেউ কাউকে ছাড়াতেও চায় না। মনে আতঙ্ক সবারই, ফের যদি তারা একে অন্যের থেকে হারিয়ে যায়।
সবাই চায় পূর্ণতায় ফিরে যেতে। এবার সহায় হলেন অগ্নিদেব হেফেসটাস। আগুনের আঁচে জ্বলেপুড়ে, গলে ফিরে পাওয়া- এক দেহ, এক প্রাণ।
আজও হাহাকারে ভর্তি পৃথিবী। এখনও চলেছে নিরন্তর খোঁজ। একদল নারী, একদল পুরুষ আজও বিচ্ছেদ যন্ত্রণায় ভুগছে।
আজও সেই বিরহীরা নীরবে অভিযোগ জানায় পূর্ণিমার চাঁদকে। চাঁদের মধ্যেই প্রেয়সীর ছায়া খুঁজে পায় প্রেমিক। গোল চাঁদপানা মুখ সেই হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকার। দেবদাসের চন্দ্রমুখী। 'ও চাঁদ সামলে রাখো জোছনাকে।' গান বাঁধলেন শিল্পী। সারারাত অপলক চাঁদ। তার আলোয় ধুইয়ে দিতে চায় চিরবিরহীদের মনের গ্লানি।
আমার শিরা উপশিরায় বইছে বিরহীর রক্তস্রোত। নিশিরাতে কানে বাজতো আমার অর্ধাঙ্গ, হারিয়ে যাওয়া নারীর ডাক। সেই গভীর রাতে দুহাতে কান চেপে ধরেছিলাম আমি। অসহ্য হয়ে উঠেছিল আমার রক্তস্রোতের সেই চাপা আর্তনাদ।
সেদিন জিউস আমাদের আদিপুরুষকে যেভাবে চরমদণ্ড দিয়েছিলেন, আজ আমি সেভাবেই দণ্ড দিলাম নিজেকে। আমার মনের কোণে লুকিয়ে থাকা সেই ঔদ্ধত্যকে।।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন