বিশেষ কলম
কাজল ভট্টাচার্য
যে মুহূর্তে মানুষটা টের পায় তার মনের মানুষ দূরে সরে যাচ্ছে, চমকে যায়। জোর কা ঝটকা, ধীরে সে লাগে! এরপর ঝটকার তীব্রতা বুঝতে পারে। বেড়ে চলে দূরত্ব। তখন মানুষটা হন্তদন্ত হয়ে নিজেই এগিয়ে যায়। তবুও মনের মানুষ ধরাছোঁয়ার বাইরে। এরপরেই সেই মানুষটা খেপে যায়। একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। আর এই খেপে ওঠাটাকে অজুহাত করেই গড়গড় গতিতে বাকী পথটুকুও শেষ করে মনের মানুষ। দূরত্বের পথ শেষ হয় বিচ্ছেদে।
তখন সেই একা মানুষটা চমক, রাগ, দুঃখের বাইরে। স্বর্গ মর্ত্য পাতালের তিনলোক ছাড়িয়ে যেন অসীম শূন্যে ভাসমান। এক বিদেহী অতৃপ্ত আত্মার মতো। অতীত বর্তমান মিলেমিশে একাকার। ভবিষ্যত নেই। এক নিশ্ছিদ্র অনন্ত নীরবতার দুনিয়ায় পৌঁছে যায় সেই মানুষ।
সেই ঘোর কাটতে খানিকটা সময় লাগে। আঁধার পেরিয়ে ঊষা লগ্ন ছুঁয়ে ভোর হওয়ার মতো। সেই সময়টা নৈঃশব্দে মুখর।
ঠিক যেমন সেদিন দেখা গেছিলো নিখিলেশকে। নীরবতাই সম্বল। মাথা নীচু করে বাড়ি ফিরেছিল অ্যাডল্ফ নামের সেই কিশোর।
এরপরেই মনদরিয়ায় ওঠে ঝড়। কেউ শরীরের হাল শক্ত হাতে চেপে উথালপাথাল সামলায় নিখিলেশের মতো। আবার কেউ হয় অ্যাডল্ফ হিটলার। ঝড়ের পিঠে সওয়ার লণ্ডভণ্ড করে ফেলে দুনিয়াকে। ফেটে পড়ে চরম আক্রোশে।
দিবাকরের চোখের সামনেই একটু একটু করে সরে যেতে থাকে তার প্রেয়সী, পৃথিবী। দূরত্ব বেড়ে চলে দুজনার। কমে আসে সম্পর্কের উষ্ণতা। কাজলকালো মেঘের আঁচল উড়িয়ে পৃথিবী তখন ব্ল্যাক বিউটি। দশদিশি থমথমে। কেমন এক গুমোট। তারপরে আচমকাই কালবৈশাখীর অট্টহাসি। ঝড়ের দাপটে সেই মেঘের আঁচল ছিঁড়ে কুটিকুটি করে দিতে চায় দিবাকর। ঝড়ের ঝটকায় তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায় আছড়ে মারতে চায় সেই মেঘরাশিকে। ওদিকে তখন জমজমাট যৌনতায় মশগুল পৃথিবী। মেঘের প্রণয়ে ভিজে জবজবে তার সর্বাঙ্গ। মেঘ পৃথিবীর পরকীয়ায় মনমরা দিবাকর। ক্ষীণ হয়ে আসে তার তেজ। পরকীয়ার প্রণয় শেষে ফের হেসে ওঠে গোহারা, ব্যর্থ দিবাকর।
তার সেই ম্লানহাসিতে আলো থাকলেও তেজ থাকে না। যেন নিজের ললাটলিখনে নিজেরই হাস্য। এক সর্বহারার হাসি।
মনের মানুষ হারিয়ে ফকির। মনের জমাখাতায় সঞ্চয় শূন্য। তখনই হেসে ওঠে মানুষ। কালবৈশাখীর অট্টহাসি। বুক খালি করা সেই হাসিতে লুকিয়ে এক চাপা আর্তনাদ। চোখ জলে ভরা। চোখেরও আবার লিঙ্গ বৈষম্য আছে। স্ত্রী লিঙ্গ হলে চোখের জল যন্ত্রণার। পুং লিঙ্গ হলে সেই জল কাপুরুষের। আর কোনও পুরুষই অন্তত নিজের নামের সঙ্গে প্রকাশ্যে কাপুরুষের উপাধিটা জুড়ে নিতে চায় না। তখনই সে হেসে ওঠে। আকাশ বাতাস কাঁপানো হাসি। প্রলয় ডেকে আনার ক্ষমতা ধরে সেই বিরহী পুরুষ।
সব পুরুষই যক্ষের মতো বিচ্ছেদ বেদনায় অমরকাব্য সৃষ্টি করে না। প্রলয় নাচনও নাচে মহাদেবের মতো। পার্বতীকে হারিয়ে রুদ্রমূর্তি শিবের। তার সেই তাণ্ডবের কাছে মাথা নত করে মহাকাল। সেই মহাকালকে জব্দ করতে চেয়েই ইহুদিনিধন যজ্ঞে মেতেছিল হিটলার।
'আর একটু মন্দ হবার মতো তেজ আমার স্বামীর থাকা উচিত ছিল।' স্বামী নিখিলেশকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলো স্ত্রী বিমলা। সত্য সেলুকাস, বড় বিচিত্র প্রেমের গতি! তারচেয়েও বিচিত্র নারীমন।
'ঘরে বাইরে'র কথা মনে আছে তো?
দিবাকরের মতোই চোখের ওপর রোজ একটু একটু করে বিমলাকে সরে যেতে দেখেছিল নিখিলেশ। তবু সে জ্বলে ওঠেনি। তাণ্ডব করেনি নিখিলেশ। এমনকি বিমলাকে বকাঝকাও করেনি। নিখিলেশের ওই হিমশীতলতার আড়ালে কি অবহেলার গন্ধ পেয়েছিলো বিমলা? তাই বউয়ের পরকীয়াকেও কোনও গুরুত্ব দেয়নি স্বামী। নিখিলিশের নীরবতাকে তীব্র উপেক্ষা বলেই ভেবে বসেছিলো বিমলা। তাই হয়তো সে চেয়েছিলো, তার স্বামীও একটু তেজ দেখাক। নিখিলেশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতেই, বিমলা তার স্বামীর মধ্যে দেখতে চেয়েছিলো দিবাকরের তেজ।
সব পুরুষই যক্ষের মতো বিচ্ছেদ বেদনায় অমরকাব্য সৃষ্টি করে না। প্রলয় নাচনও নাচে মহাদেবের মতো। পার্বতীকে হারিয়ে রুদ্রমূর্তি শিবের। তার সেই তাণ্ডবের কাছে মাথা নত করে মহাকাল। সেই মহাকালকে জব্দ করতে চেয়েই ইহুদিনিধন যজ্ঞে মেতেছিল হিটলার।
'আর একটু মন্দ হবার মতো তেজ আমার স্বামীর থাকা উচিত ছিল।' স্বামী নিখিলেশকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলো স্ত্রী বিমলা। সত্য সেলুকাস, বড় বিচিত্র প্রেমের গতি! তারচেয়েও বিচিত্র নারীমন।
'ঘরে বাইরে'র কথা মনে আছে তো?
দিবাকরের মতোই চোখের ওপর রোজ একটু একটু করে বিমলাকে সরে যেতে দেখেছিল নিখিলেশ। তবু সে জ্বলে ওঠেনি। তাণ্ডব করেনি নিখিলেশ। এমনকি বিমলাকে বকাঝকাও করেনি। নিখিলেশের ওই হিমশীতলতার আড়ালে কি অবহেলার গন্ধ পেয়েছিলো বিমলা? তাই বউয়ের পরকীয়াকেও কোনও গুরুত্ব দেয়নি স্বামী। নিখিলিশের নীরবতাকে তীব্র উপেক্ষা বলেই ভেবে বসেছিলো বিমলা। তাই হয়তো সে চেয়েছিলো, তার স্বামীও একটু তেজ দেখাক। নিখিলেশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতেই, বিমলা তার স্বামীর মধ্যে দেখতে চেয়েছিলো দিবাকরের তেজ।
দিবাকরের মতোই অপেক্ষা করেছিল নিখিলেশ। মিলনের জয়ধ্বনি দিতে সুরে সুর মিলিয়েছিল প্রেম, প্রকৃতি। প্রেমে মিশে যাওয়া প্রকৃতির সেই অমোঘ টানকে অস্বীকার করতে পারেনি দিবাকর, নিখিলেশের কেউই।
দিবাকরের কাছে ফিরে এসছিলো পৃথিবী।
শরীরের দূরত্ব কখনোই মনের দূরত্ব বাড়ায়নি। না দিবাকর পৃথিবীর। না নিখিলেশ বিমলার। নিখিলেশের থেকে বিমলার সরে যাওয়ার মতোই, পৃথিবীও ক্রমেই দূরে সরে গেছিলো দিবাকরের কাছ থেকে। তখন শীত নেমেছিলো পৃথিবীর বুকে। বসন্তের সমাগমে বুক খালি করে পাতা ঝরিয়েছিলো বৃক্ষরাজি। যেন অস্তগামী যৌবনে ম্লান হয়ে আসা সবুজ পৃথিবীর জৌলুস। রূপের ছটা হারিয়ে আর্তনাদ করে উঠেছিলো সে মর্মর শব্দে। মোহভঙ্গের পর পৃথিবী ফিরে গেছিলো পুরনো প্রেমের কাছে। তার সমস্ত উষ্ণতা উজাড় করে আরও একবার পৃথিবীকে কাছে টেনে নিয়েছিলো দিবাকর।
সন্দীপের প্রেমেও মোহভঙ্গ হয়েছিলো বিমলার। ফিরে গেছিলো নিখিলেশের কাছে। এই ফিরে আসার মধ্যেই বিমলার সম্পূর্ণতা। ওই সম্পূর্ণাকে পাওয়ার অপেক্ষাতেই বসে ছিলো নিখিলেশ। সেখানেই নিখিলেশের জীবনের এক গভীর উপলব্ধি। জীবনদর্শন।
যে বিমলাকে নিখিলেশ হারিয়েছিল সে ছিলো অসম্পূর্ণা। যে বিমলাকে নিখিলেশ ফিরে পেলো সে সম্পূর্ণা। নিখিলেশের বিশ্বাস ছিলো, গ্রহণ বর্জনের পথ বেয়েই আসে মানুষের স্বতন্ত্র সত্তা। ছাদনাতলার সাতপাকে না, বিমলাকে নিখিলেশ বাঁধতে চেয়েছিল সত্যের বাঁধনে।
-'ছুটিনি মোহন মরীচিকা পিছে পিছে
ভুলাইনি মন সত্যেরে করি মিছে।'
দিবাকরের মতোই উদার, ধৈর্য্যের প্রতীক হয়ে উঠেছিল নিখিলেশ। নিজে জ্বললেও বিমলার গায়ে আঁচ লাগতে দেয়নি। কিন্তু হিটলারের গনগনে আঁচে জ্বলেপুড়ে মরতে হয়েছিল ইহুদিদের। শিব তাণ্ডব করেছিলো পার্বতীকে হারিয়ে। হিটলার তাণ্ডব করেছিলো স্টেফানিকে হারিয়ে।
ভিয়েনার এক ষোড়শী ইহুদি কন্যার সঙ্গে অ্যাডল্ফ হিটলারের এমনই এক প্রেমকাহিনীর কথা বলছেন অনেক গবেষকরা।
স্টেফানি রাবেচ। ওই ষোড়শীর প্রেমেই হাতেখড়ি আঠারোর কিশোর অ্যাডল্ফের। একে তো হতদরিদ্র তায় অইহুদি, এই দুই অপরাধে অ্যাডল্ফ প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল সেই ইহুদি কন্যার ধনী পরিবারের কাছে।
সেদিনই সেই কিশোরের আবেগে ইহুদি বিদ্বেষের বিজ পোঁতা হয়ে গেছিলো বলেই অনেক গবেষকের ধারনা। কিশোরটি চেয়েছিলো দুনিয়াটাকে শিল্পীর চোখে দেখতে। কিন্তু সেই চোখেই জ্বলে উঠেছিলো প্রতিশোধের আগুন।
ভিয়েনা শহরের ফুটপাথে কাগজ পেন্সিল হাতে ঘুরে বেড়াতো সেই ছেলে, অ্যাডল্ফ। পথচলতি মানুষের পোর্ট্রেট এঁকেই যৎসামান্য রোজগার। মা ছেলের সংসারে কিছুটা সাহায্য হয়। তবে ছেলের দুচোখ জুড়ে স্বপ্ন অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে ভর্তি হয়ে শিল্পী হওয়ার।
একদিন স্টেফানি বসে পড়লো অ্যাডল্ফের সামনে। ছবি আঁকতে আঁকতেই সুন্দরী ইহুদি ধনী বণিক কন্যার প্রেমে হাবুডুবু খেলো শিল্পী। শিল্পীর প্রস্তাবে স্টেফানি নিরুত্তর থাকলেও তার পরিবার অ্যাডল্ফকে শাসানি দিলো। একে তো ইহুদি নয়, তার ওপর হতদরিদ্র ফুটপাথে ঘুরে বেড়ানো এক মামুলি শিল্পী। এরপরেই স্টেফানির সঙ্গে মুখ দেখাদেখি বন্ধ অ্যাডল্ফের। তখন এক চালাকি করেছিলো সেই কিশোর।
নিজের পোষা কুকুরের মুখে চিঠি গুঁজে স্টেফানির বিশাল বাড়ির গেটের ফাঁক দিয়ে তাকে ঢুকিয়ে দিতো অ্যাডল্ফ। একদিন সেই কুকুর স্টেফানির বাড়ি থেকে আর ফিরলো না। পরদিন সকালে সেই বাড়ির গেটের বাইরে কুকুরের ছিন্নভিন্ন শরীরটা পড়ে থাকতে দেখা গেলো। পোষ্যকে হারিয়ে সেদিন চোখের জলে ভাসতে ভাসতে বাড়ি ফিরেছিল সেই কিশোর। আর কোনওদিন স্টেফানির বাড়ির দিকে ফিরেও তাকায়নি অ্যাডল্ফ।
প্রথম প্রেমের স্বপ্ন চুরমার হয়ে যাওয়ার পরেও শিল্পী হওয়ার চেষ্টা চালিয়েছিলো অ্যাডল্ফ। কিন্তু সেখানেও পদে পদে হেনস্থা। আর্ট স্কুলের রেক্টর থেকে নিয়ে ছাত্রছাত্রীদেরও বেশিভাগ ইহুদি। এরপরেই শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন বিসর্জন দিয়েছিল সেই ছেলে। স্টেফানির প্রত্যাখানে যে ইহুদি বিদ্বেষের জন্ম হয়েছিল, তাকেই উসকে দিয়েছিল আর্ট স্কুলের ঘটনা। অ্যাডল্ফের মনে তখন শুধুই তীব্র ঘৃণা প্রতিটি ইহুদির ওপর। আর যেদিন সেই ঘৃণার বিস্ফোরণ হলো, রক্তাক্ত হলো পৃথিবী। ইতিহাসে নাম লেখা হয়ে গেলো অ্যাডল্ফ হিটলারের। তার সেই তাণ্ডবকে ঐতিহাসিকরা নাম দিলেন হলোকাস্ট।
কনসেনেট্রশন ক্যাম্পে, গ্যাস চেম্বারে চলতো ইহুদি নিধন। স্টেফনিকে হারানোর প্রতিশোধের আগুনে দাউদাউ করে জ্বলতো হিটলার আর হাসতো। সেই হাসিতে অন্তরাত্মার আর্তনাদ শোনা যেতো কিনা, তা গবেষকরাই বলবেন।
আমরা হাসি না, কাঁদিও না আবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়তে গেলেই কেশে ফেলি। সভ্য সমাজের সংস্কৃতিমনস্ক মধ্যবিত্ত বঙ্গসন্তান বলে কথা।
আমাদের কেউ দিবাকর, শিব, হিটলার এমনকি নিখিলেশও না। আবার কোনও বিমলা, পার্বতী, স্টেফানিকেও চিনি না আমরা।
আমরা ওসব অপেক্ষা, জীবনদর্শনের ধার ধারি না। আমরা স্বতন্ত্র। আমরা পরিবর্তনশীল। বদলে ফেলি প্রেমের রং। কাল লাল ছিলাম তো আজ নীল। আগামীতে গেরুয়াও হতে পারি। আজকের মনের মানুষ কাল থাকবে কিনা জানি না। আমরা চট করে মনের মানুষও বদলে ফেলি।
চিত্র সৌজন্যঃ সংগৃহীত
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন