বিশেষ কলম
ইনহেলার ও ঈশ্বরের গল্প
কাজল ভট্টাচার্য
ঈশ্বর ইনহেলারের মতো।
নাকি ইনহেলার ঈশ্বরের মতো?
তর্ক করতে চাইলে কফির কাপে ঝড় তোলাই যায়। কিন্তু ওই ঝড়ে যে কোনও লাভ হয় না, তা বঙ্গবাসী মাত্রই জানেন। নইলে বোকাবাক্সের গাদাগুচ্ছের নিউজ চ্যানেলে সন্ধ্যা নামলেই যে পরিমাণ তর্কবিতর্ক হয়, তাতে রাজ্য বর্ষার জলে না ভেসে, উন্নয়নের বানে ভাসতো। তারচেয়ে ভালো এক সোজাসাপটা অভিজ্ঞতার কথা শোনাই।
এক বহুতলের সাততলায় উঠছি সিঁড়ি ভেঙে। তখনও বিল্ডিংয়ের কাজ চলছে। তাই লিফট সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়নি। সাততলার এক ফ্ল্যাটের দেওয়ালে আমার বন্ধু ম্যুরালের কাজ করছে। সেই বন্ধুর সঙ্গেই সিঁড়ি ভেঙে পৌঁছে গেলাম ফ্ল্যাটে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সেই বিশাল মাপের দেওয়াল জোড়া কাজ দেখলাম। মন ভরে গেলো কাজটা দেখে।
ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম দুজনে। ওপর থেকে শহরটাকে দেখতে ভারী সুন্দর লাগে। কোনও মানুষকে ছোট করে দেখতে নেই। কিন্তু নিজে ওপরে উঠে গেলে আর কী করা। সবাইকেই বড্ড ছোট্ট, লিলিপুটের মতো লাগে। কে সুন্দর কে অসুন্দর, ফর্সা কালো সব একাকার। দুনিয়ার সব মানুষই যেন একরকম- অমৃতস্য পুত্রা! বেশ লাগে। ঠিক তখনই বুঝতে পারলাম কতটা ওপরে আছি। আকাশ এখান থেকে বেশ খানিকটা কাছে। এবার এখান থেকেই আবার সেই মাটিতে অবতরণ, তাও সেই সিঁড়ি ভেঙে। জামার পকেটে হাতটা চলে গেলো। অমনি যেন গোটা আকাশটাই হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়লো মাথার ওপর।
পকেটে ইনহেলার নেই।
ব্যাস মনে এক চাপা আতঙ্ক ভর করে বসলো। কেমন যেন জমাট বেঁধে উঠতে লাগলো বুকের ভেতরটা। একটু কি শ্বাসকষ্ট শুরু হলো? ভয়ের ছাপ মুখে পড়তেই বন্ধু ধরে ফেললো।
- 'কী হলো রে হঠাত?'
- 'আরে ব্রিদিং ট্রাবল হচ্ছে। এতটা পায়ে হেঁটে উঠেছি তো।'
- 'তাহলে ইনহেলারটা নে।'
- 'আরে ওটাই তো নেই।'
- 'চল নামি। আমি ঘাড়ে বসিয়ে নামাবো তোকে।' আমাকে আশ্বস্ত করে বন্ধু বললো, 'চল, কোনও ভয় নেই।'
মনের ভয়টা গেলো না। চাপা অস্বস্তি নিয়েই সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালাম। তবু বন্ধু সঙ্গে আছে। ওই সাহসে ভর করেই ধীরে সুস্থে নেমে এলাম। ঠিক সেমুহূর্তে বন্ধুই যেন ইনহেলারের কাজ করেছিলো।
ফুটের দোকানে চা খেতে বসলাম দুজনে। বন্ধু সিগারেট ধরিয়ে বললো,
- 'তুই তো সিগারেট খাবি না?'
- 'কেন?'
- 'ওই যে তোর ব্রিদিং ট্রাবল,' হেসে বললো। 'শালা যত্তসব মামদোবাজি।'
দুজনে চা সিগারেট খেয়ে ফের পথে নামলাম। 'চল, হেঁটেই যাই।'
সাততলা থেকে নেমেই গায়েব শ্বাসকষ্ট। আর ইনহেলারের খোঁজ করলাম না।
এটাই হয়। ভয়ের বাস মনে। শরীরে সেই ভয়ের ছাপ পড়তেই ভুল করে তাকে শরীরের কষ্ট ভেবে বসি। সেই চাপে পড়েই বাপ বলি। শ্বাসকষ্টটা ওভাবেই হচ্ছিলো। সাততলা থেকে জমিনে নেমে আসতেই তা পরিষ্কার হলো।
ভয়ের চোটেই ইনহেলারের কথা মনে পড়ে গেছিলো। আবার ভয় কেটে যেতেই ইনহেলারের কথাও বেমালুম ভুলে মেরে দিয়েছিলাম। এটাই মনুষ্যচরিত। বিপদে পড়লেই- 'হে ঈশ্বর!' বিপদ কেটে গেলেই কোথায় ইনহেলার আর কোথায় ঈশ্বর।
সেদিন সাততলায় যা হয়েছিল, একদিন অফিস টাইম মেট্রোর ভিড়েও তাই হলো। সাততলায় হাত বাড়িয়ে সেদিন ইনহেলারের ছোঁয়া না পেয়েই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছিল। একদিন মেট্রোর ভিড়ে হাত বাড়িয়ে আরেকজনের ছোঁয়া না পেয়েও ওরকম বুক ধড়ফড় করে উঠেছিল।
আশপাশে কোথাও সে নেই। মেট্রোতে উঠতে পেরেছিলো তো? হাত ছিটকে কোথায় বেরিয়ে গেলো, কে জানে? ভিড়ের চাপে পড়ে যায়নি তো? কোনও অ্যাক্সিডেন্ট। এমনই অজস্র প্রশ্নের চাপে সেদিনও দমবন্ধ হয়ে এসছিলো।
দুদিনই কিছু করার ছিলো না।
অফিস টাইমের মেট্রোতে শরীরের নড়াচড়াই না, দৃষ্টির নড়াচড়াও বারণ। এক দুই তিন নাম্বার স্টেশন পেরোতে না পেরোতেই সেই সাততলার আতঙ্ক। বুকের ভেতর হাকুপাকু। সেই দমবন্ধ হয়ে আসা।
অতঃপর নির্দিষ্ট স্টেশনে ভিড়ের ধাক্কায় ছিটকে নেমে পড়া। উদভ্রান্ত দৃষ্টি। বুক উথালপাথাল। এমন সময় ভিড়ের ঘনঘটার মধ্য দিয়েই সে যেন দুহাত ছড়িয়ে উড়ে এলো।
আমার চোখমুখের আতঙ্ক তখনও কাটেনি। ওদিকে তার মুখে একগাল হাসি। ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না, রাগবো নাকি হাসবো। সে তখন উত্তেজনায় আমার বুকে আঙুলের খোঁচা মেরে বলে,
- এই কী হয়েছে তোর?
একেবারে বুক ঘেঁষে এলো সে। আমার উত্তর না পেয়ে তার তর্জনীর নখ ততক্ষণে আমার বুকে গেড়ে বসেছে।
- 'কী হয়েছে তোর? বল না। এই...'
কবিগুরুর মানসলোকে সেদিন কোন ছবি ধরা দিয়েছিলো জানি না। তবে আমার মনে হয়েছিল, এমন এক স্বর্গীয় মুহূর্তের কথা ভেবেই যেন তিনি লিখেছিলেন-
'তুমি আর আমি মাঝে কেহ নাই
কোনো বাধা নাই ভুবনে।'
একাকার হয়ে গেছিলো পূজা আর প্রেম।
সেদিন মেট্রো স্টেশনে ইনহেলার ফিরে এসেছিলো সেই সুন্দরীর বেশ ধরে। ভালবাসা সেই সুন্দরীকে শুধু প্রেমিকা সাজিয়ে হাত গোটায়নি। আমার অপরিহার্য ইনহেলার করে ছেড়েছিল। আমার শেষতম ভরসাস্থল। এখনও পর্যন্ত আপনার যদি তা না হয়ে থাকে, তাহলে আপনার ভালবাসায় নির্ঘাত হুগলি হোক বা দামোদর, ঘোলাজল মিশেছে।
এই এক দোষ ইনহেলারের। দরকার লাগুক না লাগুক সঙ্গে থাকা চাই। আসলে ভরসার জিনিসকে কখনোই দরকার অদরকার দিয়ে বিচার করা যায় না। ব্যাপারটা হলো- 'তিনি আমার প্রাণের আরাম মনের আনন্দ আত্মার শান্তি।' মহর্ষির সেই জীবনদর্শন।
আসলে ইনহেলার এক ভরসা। মনের ভয় কাটাতে। সাততলা কেন, আমার দশতলার অফিসে দিনের প্রায় বারোঘণ্টা কাটিয়েও, কোনদিন শ্বাসকষ্ট হয়েছে বলে মনে পড়ে না। আতঙ্কেও ভুগিনি। কারণ ড্রয়ারে ইনহেলার।
আর যাদের ড্রয়ারে ইনহেলার ছিলো না? তাদের ড্রয়ারে ঈশ্বরের ল্যামিনেট করা ফটো, অথবা কমপিউটার স্ক্রিনে ঈশ্বরের ব্লো আপ।
জীবনের প্রতিমুহূর্তে ইনহেলার দরকার পড়ে না। উপাসনার মতো বা ওই সকাল সন্ধ্যায় গৃহদেবতার আহ্নিকের মতো, ইনহেলারের শরণে যাওয়া। তবু বিপদ আসে যায়। আর বিপদের গন্ধ পেলেই ইনহেলারের অভয়।
মনুষ্যচরিত বড়োই সংকীর্ণ। স্বার্থান্বেষী। অবহেলায় পটু। বিপদের মুখোমুখি না দাঁড়ালে ইনহেলার হোক কী ঈশ্বর, কারুর কথাই মনে থাকে না। বেরনোর তাড়া থাকলেও ঈশ্বর প্রণাম মিস হয়ে যায়। ভুল হয়ে যায় পকেটে ইনহেলার গুঁজতে।
মনে পড়ে তখনই- 'জীবন যখন শুকায়ে যায়।' তখনই তার আবাহন- 'করুনাধারায় এসো'।
মানুষ জীবনভর আকূল হয়ে খুঁজে মরে এক ভরসার জায়গা। পরম নিশ্চিন্তের এক আশ্রয়। কেউ জেনেবুঝে, কেউ অজান্তে।
তখন ওসব তর্ক মাথায় আসে না- ইনহেলার ঈশ্বরের মতো নাকি ঈশ্বরই ইনহেলারের মতো? শর্ত একটাই, অনুভূতির জায়গাটা প্রবল হওয়া চাই। মেট্রো স্টেশনে প্রেমিকের সাজেও আসে সেই প্রাণদায়ী ইনহেলাররূপী ঈশ্বর! আবার কখনও সাততলায় বন্ধুর বেশে।
বহুরূপে সম্মুখে তোমার!
ঈশ্বর ইনহেলার প্রেম সখা সখী, সবকিছু মিলেমিশে একাকার।।
খুব ভালো লাগল , একেবারে অন্য রকমের অনুভূতি
উত্তরমুছুন