বিশেষ কলম
আপনি সবার। মহামায়া রূপে আপনি গ্রেট। সার্বজনীন। আপনার মায়ার ইন্দ্রজালে বন্দি গোটা বঙ্গপ্রদেশ। আপনি প্রাণের উৎসব। মনের ফূর্তি। আত্মা নিয়ে কারবার করেন বলে তো শুনিনি। আধুনিকতার সঙ্গে ঘোর বিবাদ ওসব আত্মা- ফাত্মার। আত্মা যাতা!
তবে আপনি মেজাজ হারালে সাক্ষাত কালী। কাউকে পাত্তা দেন না। শিবের বুকের ওপরে উঠে ধিন তানাক ধিন করতেও, আপনার পা এতটুকু কাঁপে না। আপনার ওই রূপেও মজেছে বাংলা। মাঝরাতে রক্তের স্রোত বয়ে যায় আপনাকে পেতে। তবুও যদি আপনি সদয় হন।
দুর্গা কালী। আপনি লক্ষ্মী না সরস্বতীও না। দুর্গা কালীর মধ্যে পড়ে প্যান্ডেলে নিয়মরক্ষার পুজো পেয়ে যান লক্ষ্মীদেবী। আপনি কোনমতেই অতো অবহেলিত রূপে অধিষ্ঠিত হতে রাজি না। আবার আপনি গৃহস্থবাড়ির কুলদেবতাও না।
দেবী সরস্বতীকে নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ধুমধাম হয় বটে, তবে তাঁর বাস উঠতিদের আবেগে। তিনি যতটা না দেবী, তারচেয়েও বেশি সখী। পূজার্চনা না, দেবীর ভক্তরা তাঁকে ছোঁয় ভালবাসা দিয়ে। নবীন প্রাণের সেই ভালবাসা বড়ো শুদ্ধ। নির্মল। পবিত্র। বয়ঃসন্ধির প্রেমের উন্মেষ দেবীবন্দনা দিয়েই। পাড়ার কিশোরীরা আজও রাতারাতি বড়ো হয়ে ওঠে ওই দিনটাতেই। গা ঢাকে শাড়ির আঁচলে। কিশোররা তাদের ম্যাচিওরিটি দেখায় পাজামা পাঞ্জাবিতে। বড়ো হয়ে একসময় ওই কিশোর কিশোরীরাও সরস্বতীর হাত ছেড়ে দুর্গা কালীর সার্বজনীনের ভিড়ে হারিয়ে যায়।
আপনার ঘাড় ধরেও লক্ষ্মীর মতো গৃহী করা যাবে না। গৃহীর আসনে আপনার অরুচি। আপনার পছন্দ সার্বজনীন। এর ঘাড়ে চেপে আসবেন। ওর ঘাড়ে চেপে বিদায় নেবেন। আপনার পছন্দ কখনও ঘোটক, কখনও দোলা, আবার নৌকাও হতে পারে। নানাবিধ। আগমন, নির্গমন সবই নির্ভর করে আপনার মুড সুইংয়ের ওপর। তার ফলভোগ করে বাংলা বাঙালি। সবেতেই আপনার বিদগ্ধ মনের বিচিত্র ছায়া। আগমন বিসর্জনের মধ্যে কয়েকটা দিন হইচই। রসিক ভক্তদের আনন্দ উপচে পড়ে। তাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেরায়। হিল্লি দিল্লিও হতে পারে, নিদেনপক্ষে কলকাতা দীঘা। সারাদিন ফূর্তিফার্তার জোয়ারে ভাসা। রাতে মদ্যপান। সুরার নেশায় অসুরের খেলায় মাতা রাতভর।
ওরা জানে দেবী সবার। সার্বজনীন। দেবী ভক্তের। দেবী গুণমুগ্ধের। নিঃশর্ত ভক্তির নৈবেদ্যে দেবী আহ্লাদিত হন। যুক্তিবাদীরা আবার ধম্মটম্মের কথা শুনলেই জিভ কাটেন। তাঁদের কাছে আবার এই নিঃশর্ত ভক্তি মানে স্তাবকতা। দেবী ওই স্তাবকদের কাছেই ধরা দেন।
চাই আয়োজন। শুধু খটখটে ভালবাসা দিয়ে কেউ দেবীর কাছে পৌঁছতে চাইলে, দেবী তা বরদাস্ত করেন না। মুখ ফিরিয়ে থাকেন। কূপিত হলে, সেই অর্বাচীন ঔদ্ধত্যের নিষ্ঠুর দণ্ডবিধান করেন তিনি।
তবু আজও কিছু মানুষ মুখ লুকিয়ে কাঁদে। অনেকে আবার গোপন করে চোখের জল। লুকিয়ে লুকিয়ে বারেবারে দেখে দেবীর অনিন্দ্যসুন্দর শান্ত মুখখানা। প্রেম না, ভালবাসাও না, মায়ায় পড়ে যায় মহামায়ার। চিন্ময়ী তখন রক্তমাংসের মানবী। মনের কোলঘেঁষে থাকা নেহাতই এক মানবী।
দেবীর কালোরূপে মাতোয়ারা হয় অনেকে। তাঁর বন্দনা করতে গান বাঁধে সুররসিক ভক্তরা।
হোক তিনি দেবী, নাহয় সার্বজনীনও, কিন্তু মায়া তো ওসব যুক্তিতর্কের ধার ধারে না। তাঁর বিদায় আজও কাঁদায় কিছু মানুষকে।
কলির দেবী
কাজল ভট্টাচার্য
আপনি তো সার্বজনীন।আপনি সবার। মহামায়া রূপে আপনি গ্রেট। সার্বজনীন। আপনার মায়ার ইন্দ্রজালে বন্দি গোটা বঙ্গপ্রদেশ। আপনি প্রাণের উৎসব। মনের ফূর্তি। আত্মা নিয়ে কারবার করেন বলে তো শুনিনি। আধুনিকতার সঙ্গে ঘোর বিবাদ ওসব আত্মা- ফাত্মার। আত্মা যাতা!
তবে আপনি মেজাজ হারালে সাক্ষাত কালী। কাউকে পাত্তা দেন না। শিবের বুকের ওপরে উঠে ধিন তানাক ধিন করতেও, আপনার পা এতটুকু কাঁপে না। আপনার ওই রূপেও মজেছে বাংলা। মাঝরাতে রক্তের স্রোত বয়ে যায় আপনাকে পেতে। তবুও যদি আপনি সদয় হন।
দুর্গা কালী। আপনি লক্ষ্মী না সরস্বতীও না। দুর্গা কালীর মধ্যে পড়ে প্যান্ডেলে নিয়মরক্ষার পুজো পেয়ে যান লক্ষ্মীদেবী। আপনি কোনমতেই অতো অবহেলিত রূপে অধিষ্ঠিত হতে রাজি না। আবার আপনি গৃহস্থবাড়ির কুলদেবতাও না।
দেবী সরস্বতীকে নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ধুমধাম হয় বটে, তবে তাঁর বাস উঠতিদের আবেগে। তিনি যতটা না দেবী, তারচেয়েও বেশি সখী। পূজার্চনা না, দেবীর ভক্তরা তাঁকে ছোঁয় ভালবাসা দিয়ে। নবীন প্রাণের সেই ভালবাসা বড়ো শুদ্ধ। নির্মল। পবিত্র। বয়ঃসন্ধির প্রেমের উন্মেষ দেবীবন্দনা দিয়েই। পাড়ার কিশোরীরা আজও রাতারাতি বড়ো হয়ে ওঠে ওই দিনটাতেই। গা ঢাকে শাড়ির আঁচলে। কিশোররা তাদের ম্যাচিওরিটি দেখায় পাজামা পাঞ্জাবিতে। বড়ো হয়ে একসময় ওই কিশোর কিশোরীরাও সরস্বতীর হাত ছেড়ে দুর্গা কালীর সার্বজনীনের ভিড়ে হারিয়ে যায়।
আপনার ঘাড় ধরেও লক্ষ্মীর মতো গৃহী করা যাবে না। গৃহীর আসনে আপনার অরুচি। আপনার পছন্দ সার্বজনীন। এর ঘাড়ে চেপে আসবেন। ওর ঘাড়ে চেপে বিদায় নেবেন। আপনার পছন্দ কখনও ঘোটক, কখনও দোলা, আবার নৌকাও হতে পারে। নানাবিধ। আগমন, নির্গমন সবই নির্ভর করে আপনার মুড সুইংয়ের ওপর। তার ফলভোগ করে বাংলা বাঙালি। সবেতেই আপনার বিদগ্ধ মনের বিচিত্র ছায়া। আগমন বিসর্জনের মধ্যে কয়েকটা দিন হইচই। রসিক ভক্তদের আনন্দ উপচে পড়ে। তাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেরায়। হিল্লি দিল্লিও হতে পারে, নিদেনপক্ষে কলকাতা দীঘা। সারাদিন ফূর্তিফার্তার জোয়ারে ভাসা। রাতে মদ্যপান। সুরার নেশায় অসুরের খেলায় মাতা রাতভর।
ওরা জানে দেবী সবার। সার্বজনীন। দেবী ভক্তের। দেবী গুণমুগ্ধের। নিঃশর্ত ভক্তির নৈবেদ্যে দেবী আহ্লাদিত হন। যুক্তিবাদীরা আবার ধম্মটম্মের কথা শুনলেই জিভ কাটেন। তাঁদের কাছে আবার এই নিঃশর্ত ভক্তি মানে স্তাবকতা। দেবী ওই স্তাবকদের কাছেই ধরা দেন।
চাই আয়োজন। শুধু খটখটে ভালবাসা দিয়ে কেউ দেবীর কাছে পৌঁছতে চাইলে, দেবী তা বরদাস্ত করেন না। মুখ ফিরিয়ে থাকেন। কূপিত হলে, সেই অর্বাচীন ঔদ্ধত্যের নিষ্ঠুর দণ্ডবিধান করেন তিনি।
তবু আজও কিছু মানুষ মুখ লুকিয়ে কাঁদে। অনেকে আবার গোপন করে চোখের জল। লুকিয়ে লুকিয়ে বারেবারে দেখে দেবীর অনিন্দ্যসুন্দর শান্ত মুখখানা। প্রেম না, ভালবাসাও না, মায়ায় পড়ে যায় মহামায়ার। চিন্ময়ী তখন রক্তমাংসের মানবী। মনের কোলঘেঁষে থাকা নেহাতই এক মানবী।
দেবীর কালোরূপে মাতোয়ারা হয় অনেকে। তাঁর বন্দনা করতে গান বাঁধে সুররসিক ভক্তরা।
হোক তিনি দেবী, নাহয় সার্বজনীনও, কিন্তু মায়া তো ওসব যুক্তিতর্কের ধার ধারে না। তাঁর বিদায় আজও কাঁদায় কিছু মানুষকে।
অবতারের রূপ ধরেও মর্ত্যে আসেন দেবী। ধরায় অবতীর্ণ হন নানারূপে। সাধারণের চোখ তা খুঁজে পায় না। কিছু অসাধারণ চোখেই ধরা পড়ে মহামায়ার বিচিত্র সেই রূপ।
'মোর জীবনে বিচিত্র রূপ ধরি
তোমার ইচ্ছা তরঙ্গিছে।'
ভারী লেন্সের আড়ালে ঢাকা বিকাশ ভট্টাচার্যের সেই চোখ, দেবীর মধ্যে লুকিয়ে থাকা নেহাতই এক মানবীকে খুঁজে পায়। তাঁর ক্যানভাসে আপনি মূর্ত হন 'ত্রিনয়নী'র নানারূপে। গায়ে আঁচল জড়িয়ে সিঁদুরখেলায় বিভোর হন মর্ত্যের দেবী। প্রেমের অক্ষয় কামনা সিঁথির সিঁদুরে।
দুপায়ে দুরঙা হাওয়াই চপ্পল পায়ে। দেবীর হাতে থলেভর্তি সবজি, বাজার ফেরতা মহিলা। পরম মমতায় প্রাণের দেবীকে আবিষ্কার করেন শিল্পী, তাঁর মনের সবটুকু মাধুরী মিশিয়ে।
আবার কখনও শিল্পীর কল্পলোকে দেবী বিরাজ করেন 'জয়া বিজয়া' হয়ে। শিল্পীরা এরকমই। দেবী মহামায়ার মতোই মায়া গড়েন। ফারাক একটাই। দেবী নিজে কারুর মায়ায় জড়ান না। শিল্পী মায়াব্যূহ রচনা করেন। অভিমণ্যুর মতো সেই ব্যূহে সাবলীল ভাবে ঢুকেও পড়েন। বেরোতে পারেন না। সেই মায়ার জালে ফেঁসে দম আটকে মারা যান শিল্পী।
আপনি তো দেবী। কুমোরটুলি থেকে কানাডা, লন্ডন, কোথায় না আছে আপনার ভক্তরা! আপনার রূপে মুগ্ধ, গুণে চমকিত ভক্তরা ফেসবুকে বন্দনার ঝড় তোলেন। প্রসন্ন হন আপনি। স্নেহধন্য ভক্তমণ্ডলীকে বঞ্চিত করেন না আপনার কৃপালাভ থেকে। ফেসবুক তরঙ্গের মতোই আপনি মুক্ত গগনবিহারী। সর্বত্র চষে বেড়ান।
আবার মনে হয়, আসলে হয়তো আপনি আর পাঁচটা মেয়ের মতোই নির্ভেজাল এক মানবী। কুমোরটুলি আপনার রূপে মুগ্ধ হয়েই, কাঠখড় মাটির প্রতিমার মধ্যে আপনাকে ধরতে চেয়েছে। সেই নিষ্প্রাণ মূর্তিকেই ভক্তরা দেবী বানিয়ে ছেড়েছে। উৎসাহের আতিশয্যেই মানবী থেকে সার্বজনীন দেবীতে উত্তরণ আপনার। আর এই গোটা ব্যাপারটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেন আপনি।
তবু আপনি পলাশপুরের রমা হতে পারেন না। 'হারানো সুর' ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আপনার থাকে না।
'আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবো ডাক্তার।' 'সব্যসাচী'র সুমিত্রার মতো অঙ্গীকার করার মতো মনের জোর থাকতে নেই আপনার। আপনি প্রেমময়। তবে কারুর প্রেমিকা না। প্রেমিকের ডাকে সাড়া দেন না আপনি। আপনি শুধুই ভক্তের দেবতা।
আপনি তো রক্তমাংসের দেবী।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন