বেহালার দিন প্রতিদিন বিশেষ কাজল ভট্টাচার্যের কলমে - শেষের গল্প

 
শেষের গল্প 




     কাজল ভট্টাচার্য


শেষটা যাতে শুভ হয়।
বিদায়েই শেষ। আপদ বালাই বিদায় হলে অবশ্যই শুভ। কিন্তু যদি বিদায় দিতে হয় আপনজনকে? বিদায় দিলেই হলো না, বিদায় নিতেও হবে। সেই আপনজনের কাছ থেকেই। আপনজন, যার সঙ্গে অল্পদিনের জন্য হলেও বাস মনের খুব কাছাকাছি। মনের ওয়ান বিএইচকে- তে।

সাধারণ ভাড়া বাড়িতেও আজকাল আইনকানুন মেনে এগারো মাস বাসের কন্ট্রাক্ট। তারপর গোটাটাই বাড়িওয়ালার মর্জি। ভাড়াটিয়ার বাসের মেয়াদ বাড়াতেও পারেন, আবার তাড়িয়েও দিতে পারেন। প্রায় সব বাড়িওয়ালাই ভাড়াটিয়াকে সন্দেহের চোখে দেখেন। নাগাড়ে বেশিদিন ভাড়া থাকলেই, ভাড়াটিয়া মৌরুসিপাট্টা জমাতে চান। এমনটাই বদনাম ভাড়াটিয়া কুলের।
কিন্তু যতোই বদনাম থাকুক, এগারো মাস পরে বাড়ি খালি করতে গিয়ে, ভাড়াটিয়ার মনও ভারী হয়ে আসে। বাল্বটা খুলতে গিয়েও খোলা হয় না। হোক না অন্যের ঘর, তবু সেই ঘরও অন্ধকার করে যেতে নেই। বাড়িওয়ালার অমঙ্গল হয়।
মনের ঘর ছেড়ে যাওয়ার আগেও সেকথাটাই মনে পড়ে। হোক না অন্যের মন, অন্ধকার ফেলে রেখে যাবো না।

- 'ভালো থাকিস।'
এটাই কী হবে বিদায় সম্ভাষণ? কী হবে শেষকথাটা?
সেও বলবে- 'তুইও ভালো থাকিস।'
শেষকথাটা কে বলবে? আমি না তুই?
তারপর?
তুই চলে যাবি, আমি দাঁড়িয়ে তোকে দেখবো। নাকি সেদিনও আমি তোকে আগলে রাস্তাটা পার করে দেবো? রাস্তা পেরনোর সময় তুই কি সেই প্রথম দিনের মতো আমার হাত চেপে ধরবি? সেদিনও, শেষবারের মতো।
আমরা দুজনে কি হাতেহাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকবো বাসের অপেক্ষায়? রাস্তা পেরনোর সময় তুই যে আমার হাতটা চেপে ধরেছিলি, রাস্তা পেরিয়ে সেই হাতটা ছেড়ে দিতে ভুলে যাবি। ভোলারই কথা। বছর দুয়েকের অভ্যাস তো! 

আমি জানি, সেসময় আমরা কেউ কোনও কথা বলবো না। কথাগুলি দলা পাকিয়ে থাকবে গলার মধ্যে। তবু কেউ কিছু বলবো না। আচমকাই দুজনার চোখে চোখ পড়বে। দুজনেই চোখ নামিয়ে নেবো। রাস্তা দেখবো, মানুষজন দেখবো। এমনকি আকাশও দেখতে পারি। শুধু আমি তোকে দেখবো না। তুইও আমাকে দেখবি না। 
সেদিন আচমকাই দেখবি, হুড়মুড় করে তোর বাসটা এসে পড়বে। আমরা রাস্তার দিকে ঠায় তাকিয়ে থাকলেও, কেউ বাসটাকে খেয়াল করবো না। বাসঠাসা ভিড়। এরকম ভিড় দেখলেই আমি তোকে সেই বাসে উঠতে মানা করতাম। সেদিন আর মানা করবো না। ভিড় তোকে ঠেলে বাসের ভেতর গুঁজে দেবে। আমি দাঁড়িয়ে দেখবো।
- 'আজ তো ভিড় বাসে উঠতে একবারও মানা করলি না ?' ভাববি তুই। 
তোকে নিয়ে চলে যাওয়া বাসটার দিকে ঠায় তাকিয়ে থাকবো। মোড়ের মাথায় সিগন্যাল খেয়ে দাঁড়ানো বাসটার দিকে মন ছুটে গিয়ে, একলাফে উঠে পড়তে চাইবে। আমি শক্ত হাতে সেই মনের লাগাম কষে রাখবো।




বাসে না গিয়ে সেদিন অটোর লাইনেও দাঁড়াতে পারিস তুই। আমি তোর পাশে দাঁড়িয়ে লাইনের সঙ্গে এগোতে থাকবো। গায়ে গা ঘেঁষে গেলেই তুই সতর্ক হবি। আমিও। মন থেকে মনের দূরত্ব বাড়তে অনেক সময় লাগে। শরীরের দূরত্ব বাড়াতে একটুও সময় লাগে না। 
সেদিনই প্রথম মনে হতে পারে, অটোর লাইনটা এত চট করে শেষ হলো কেন? কিন্তু সেকথা আমরা কেউ কাউকে বলবো না। তারপর একসময় তুই অটোতে চেপে বসবি। আমার দিকে একবার তাকাবি। আমিও তাকাবো। টা টা করবো। তোর হাত কোল থেকে উঠতে চাইবে না। সেমুহূর্তে ভীষণ ভারী হয়ে উঠবে হাতটা। তারমধ্যেই টলিগঞ্জ থেকে ইউ টার্ন নিয়ে তোকে চাপিয়ে অটোর দৌড় শুরু।

দিনের শেষ আলোর ছটাটাও যেন তখন দৌড় লাগাবে অটোর পেছন পেছন। সন্ধ্যা নামবে শহরের বুকে। সবকিছুই কেমন যেন ঝাপসা। এবার ঠিক কোন পথে হাঁটা লাগাবো, সেদিন বুঝে উঠতে পারবো না। কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাবো। মাথাটা ফাঁকা। গোটা শরীর জুড়ে এক অস্থিরতা। দুলে উঠবে ভেতরটা। গা গুলিয়ে উঠবে। চট করে মুখ চাপা দেবো রুমালে। ভেতরের সবকিছু যেন এবার উগরে উঠতে চাইছে। 
যে কথাগুলো বলবো বলে ভেবে এসেছিলাম, তা আর বলা হবে না। সেদিন তোর সঙ্গে দেখা হতেই মনে হবে, তুই শেষ বিদায় জানাতেই এসেছিস। 

ঠিক ওই সময়েই একটু বেশি গতিতে, পাক খাবে পৃথিবীটা। প্রেসারটা গড়বড় করছে নাকি? বুঝে উঠতে পারবো না কষ্টটা ঠিক কোথায়। চট করে একটা পাফ নিয়ে নেবো ইনহেলারের। শ্বাসকষ্ট হলেও হতে পারে। দু- চারজন এগিয়ে এসে আমার ওপর নজর রাখবে। তখন আর কোনও প্রশ্নের মুখে পড়তে ইচ্ছে করবে না। কোনও সহানুভূতি না। ধীর পায়ে কেটে পড়বো। পায়ের নীচের মাটি তখনও দুলছে। 

পকেটে মেট্রো রেলের স্মার্ট কার্ড গোঁজা। টলিগঞ্জ মেট্রোর সামনে যেখানে বহুদিন বসে তোর জন্য অপেক্ষা করতাম, সেখানেই বসে পড়বো। ঘামের বান ডাকবে তখন। ঘাড় গলা ভাসিয়ে বুকপিঠ দিয়ে তা নেমে যাবে।

সেই সন্ধ্যায় এত বড় শহরটায় হারিয়ে যাবো আমরা দুজনে। এবার থেকে আমাদের দুজনের দুই পৃথিবী। সম্পর্কের মধ্যে কাঁটাতারের বেড়া। ঠিক যেমনভাবে একদিন ভাগ হয়ে গেছিলো দেশটা। রক্ত দাঙ্গার মধ্য দিয়ে। আমাদের ভেতরেও সেভাবে রক্তক্ষরণ হবে। কেউ তার খোঁজ রাখবে না। মনটা এপারে পড়ে রইলো তো শরীরটা ওপারে। আবার অনেকের শরীরটা এপারে, মনটা ওপারে।
মন আর শরীর দুটুকরো মানে মানুষটার সঙ্গে তার সত্তার বিচ্ছেদ হওয়া। সেদিন থেকে ঠিক এভাবেই বেঁচে থাকবো আমরা। কেউ কাঁটাতারের শাসন ভাঙতে চেষ্টা করবো না। গুলি খাওয়ার ভয়। নিজের হাতেই আমাদের দুই পৃথিবী বানিয়ে ফেলবো আমরা।

এবার একজন অরেকজনকে ছেড়ে ভালো থাকবো আমরা। ভালো থাকাটাই সব। দুজনেই সেটা চাই। কিন্তু কে কতটা ভালো থাকবো, তা জানার উপায় থাকবে না। 
কিন্তু ভালোই যদি থাকবো, তাহলে বিদায়বেলায় মনের এতো ভারী হয়ে ওঠা কেন? কেনই বা মনে ঝড় উঠবে তোর কথা ভেবে? মন থেকে তোকে ঝেড়ে ফেলতে পারবোই বা না কেন? এমনই হাজারো কেনর ভিড়। 
কন্ট্রাক্ট শেষ, ভাড়াটিয়া বিদায়। তোর মনের মালিক তুই। আমার মনের মালিক আমি। দুজনেই দুজনকে সেই মনের ঘরে ভাড়া দিয়েছিলাম। সেই ভাড়াটিয়া বিদায় হলে এতো মনখারাপের কী আছে? এক ভাড়াটিয়া গেছে আরেক ভাড়াটিয়া আসবে। ঘর টুটাফুটা হলেও ভাড়াটিয়ার অভাব হয় না। 

বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়ার সম্পর্কের মধ্যে দুর্বলতা ঢুকে পড়লে কি এমনটাই হয়? পোষা মুরগিটা নধর হয়ে উঠলেও তাকে জবাই করতে, গৃহস্থের মন চায় না। খাদ্য খাদকের সম্পর্ক চাপা পড়ে যায় স্নেহের মোহে। 
খাঁচা খোলা পেয়েও উড়ে যেতে চায় না পোষা ময়না। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে বাইরে চক্কর মেরে, ফের গলায় চেন পরতে হাজির হয় পোষা সারমেয়। বন্ধনেই সুখ খুঁজে পায় মনুষ্যেতররা। মানুষের জন্য 'শেষের কবিতা'। কবিতা শেষ হলেও পড়ে থাকে এক বন্ধনহীন গ্রন্থি। অদৃশ্য। অপার্থিব শক্তিধর। যতোই 'চলতি হাওয়ার পন্থী' হই না কেন, পথ বেঁধে দেয় সেই 'বন্ধনহীন গ্রন্থি'। 
সেই পথ বিদায়ের পথ না। কোনও বিদায় শুভ হয় না। দুজনে দুমুখো হলেই টান পড়ে গ্রন্থিতে। দমবন্ধ হয়ে আসে। ইনহেলার সেমুহূর্তে শেষরক্ষা করতে পারবে তো ?

চিত্র কৃতজ্ঞতাঃ সংগৃহীত 

মন্তব্যসমূহ