বেহালার দিন প্রতিদিনে সামাজিক ব্যবস্থার চলমানতার বিশেষ কলম সাংবাদিক কাজল ভট্টাচার্যের - ' আরশোলা এক ছাপোষা '
আরশোলা এক ছাপোষা
কাজল ভট্টাচার্য
আরশোলা।
কেমন যেনো সেই ছাপোষা মানুষের মতো আরশোলা। ঘুরঘুর করে ঘুরে বেড়ায়। এদোর থেকে সেদোর।
পাপী পেট কা সওয়াল!
সরকারি দপ্তরের দরজায় দরজায় পেনসনের দলিল দস্তাবেজ নিয়ে ঘুরঘুর এক ছাপোষার। প্রাপ্য পাওনাগণ্ডা আদায়। যদিও দাবি, তবু ভাবখানা কৃপাপ্রার্থীর। তা করবেটাই বা কী? যে টেবিলে যায় সেখান থেকে অন্য টেবিলে পাঠায়। ধৈর্যের মক টেস্ট চলতেই থাকে টেবিল থেকে টেবিলে। রেজাল্ট নেই। মাঝেমধ্যেই সন্দেহ হয়, এবার আরশোলাদেরও পেনসনের ব্যবস্থা হলো নাকি! চশমার কাচ ঘষে ঠিক করে দেখে নিই। ওটা ছাপোষাই, আরশোলা না।
সাহেবের চাপরাসি পাত্তাই দেয় না হাতগোটানো ফুল শার্ট, ধুতি পরা ছাপোষাবাবুকে। সেই 'ইন্টারভিউ' সিনেমার মতো। গায়ে কোট চড়িয়ে না আসার অপরাধে চাকরি হয় না রঞ্জিত মল্লিকের। এবার থেকে তাহলে সাহেবের টেবিলের ড্রয়ারে ঢুকে দিবানিদ্রা দিতে গেলে, আরশোলাকেও গায়ে স্যুট চাপাতে হবে নাকি?
ছাপোষাকে পত্রপাঠ বিদায় দিতে, গাল তোবড়ানো চাপরাসি বলে দিয়েছে- 'সাহেব বিজি।' তাকে অমান্য করে ছোটসাহেবের চেম্বারে ঢোকার হিম্মত নেই ছাপোষার। ওদিকে ক্যারিব্যাগ ভেদ করে ভেতরে রাখা উচ্ছিষ্টের কাছে পৌঁছনোর মুরোদ নেই আরশোলার।
- 'শাসনে যতোই ঘেরো
আছে বল দূর্বলেরও।'
একসময় ছিলো হয়তো। গণতন্ত্র তা গিলে খেয়েছে। অগত্যা, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে জুলজুল দৃষ্টিতে শুধুই সাহেবের শ্রীমুখ দর্শন করা। আরশোলার দৃষ্টিতে তখন শার্লক হোমস। হেঁসেলের সিঙ্কের কোণায় মুখে গিঁট মারা এক প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ। শুঁড় আন্দোলিত উত্তেজনায়।
উত্তেজিত সাহেবও। হাত নেড়ে ঘাড় নেড়ে টেবিলের উল্টোদিকে বসা এক সুন্দরীর সঙ্গে বকেই চলেছেন। হেসে লুটোপুটি খায় সেই সুন্দরী। শূন্য চোখে সেদিকে তাকিয়ে ছাপোষা।
কেমন যেন এক দার্শনিক হাবভাব আরশোলার চোখে। ক্যারিব্যাগের গায়ে শুঁড় ঠেকায়, আর কীসব ভাবে। তবে কি ও সেই তত্ত্ব আওড়ে চলেছে- ঘ্রাণেন অর্ধং ভোজনম? যা জোটে যতটুকু জোটে যেমন জোটে। আধপেটা হলেও চলবে।
বড্ড মিল এই দুই প্রজাতির। ছাপোষা আর আরশোলার। দুজনাই হাবভাবে গরুচোর। ছাপোষা আরশোলার সঙ্গে সহাবস্থান করে নাকি, আরশোলা ছাপোষার সঙ্গে, কেমন গুলিয়ে যায়। দুনিয়ায় প্রায় চারহাজার ছশো প্রজাতির আরশোলা বিরাজমান। তাদের মধ্যে কমপক্ষে তিরিশটা প্রজাতির সঙ্গে মানবচরিতের ব্যাপক মিল।
গণতন্ত্রের 'ট্রু স্পিরিট'- এ বলীয়ান আরশোলা। ধর্ম বর্ণ বিত্ত নির্বিশেষে সহাবস্থানে বিশ্বাসী। আর তাই নিম্নবিত্তের হেঁসেল থেকে নিয়ে উচ্চবিত্তের কিচেন, সর্বত্র সে একইরকম স্বচ্ছন্দ ও নির্লিপ্ত।
আপিসের বড়বাবুর ঘর থেকে ক্লান্ত পায়ে বেরিয়ে আসা ছাপোষার মতোই, ধীরস্থির পদে উচ্চবিত্তের কিচেনের কাবার্ড থেকে আরশোলার বেরিয়ে আসা। বেরিয়েই চট করে একবার চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে, হাওয়া বুঝে নেওয়া।
তারপর ফের হাঁটি হাঁটি পা পা। এগিয়ে চলা।
বিচ্ছিরি রকমের চাপের জীবন। কারা যেন একসময় খুব গলা ফাটাতো-
'লড়াই লড়াই লড়াই চাই
লড়াই করে বাঁচতে চাই।'
তাঁরা লড়াই করে আজও বেঁচে আছেন তো? নাকি লড়াইয়ে জিতে ঘরে বসে দিব্য ঠ্যাং নাচিয়ে, লকডাউনের পর এবার দার্জিলিং না পুরীর প্ল্যান করছেন?
ঠিক তখন ধীরপায়ে হেঁসেলের সিঙ্কের দিকে এগিয়ে চলে আরশোলা। জীবনযুদ্ধের লড়াই। বাবুবিবির এঁটো বাসনপত্রের কোনও কণা যদি সিঙ্কের গায়ে কোথাও লেগে থাকে। উচ্ছিষ্টের কণাই আরশোলার 'ঈশ্বর কণা'। আরশোলা ফিজিক্স জানে না। কিন্তু সে একনিষ্ঠ ভাবে কণারূপী ঈশ্বরের খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই।
এক্সাইড মোড়ে রাইকিশোরী এসকালেটরে চেপে পাতাল রেলের গহ্বরে ঝাঁপ মারে। তার পিছু পিছু ঝাঁপিয়ে পড়ে মোড়ের মাথায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা উস্কোখুস্কো কিশোর।
ঈশ্বরের নাম নিয়ে এক ঝাঁপ আরশোলারও। সোজা সিঙ্কের গভীরে। কিনারায় রেখে যায় জীবনকে বন্ধক।
পাতালগর্ভের জনস্রোতে ভেসে গেছিলো রাইকিশোরী। খাদ্যকণাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছিলো সিঙ্কের জলস্রোত। না সেই উদভ্রান্ত কিশোর, না ক্ষুধার্ত আরশোলা, কেউ কারুর আরাধ্যের দেখা পায়নি।
সিঙ্কের ভেতর শুঁড় নাচাতে নাচাতে ভাবতে বসে আরশোলা- অতঃকিম? সিঙ্কের গা বেয়ে যতবার ওঠার চেষ্টা করেছে ততবারই ধপাস। ঠিক যেন জয়েন্ট এনট্রান্সের পরীক্ষার্থী।
ভাগ্যিস রাজা রবার্ট ব্রুস মাকড়সা দেখেছিলেন। মনোযোগ দিয়ে আরশোলা দেখেননি। রবার্টের মতো ছবারের চেষ্টাতেও উপর্যুপরি হার আরশোলার। পেট উল্টে সিঙ্কে পড়ে থাকা। ঠিক যেমনটা সেদিন পড়েছিল সলমন খানের গাড়ির চাকায় চেপটে যাওয়া মানুষগুলো। সিঙ্কের কিনারায় বন্ধক রেখে আসা জীবনের কাছে পৌঁছতে পারেনি সেই আরশোলা।
গণতন্ত্রের 'ট্রু স্পিরিট'- এ বলীয়ান আরশোলা। ধর্ম বর্ণ বিত্ত নির্বিশেষে সহাবস্থানে বিশ্বাসী। আর তাই নিম্নবিত্তের হেঁসেল থেকে নিয়ে উচ্চবিত্তের কিচেন, সর্বত্র সে একইরকম স্বচ্ছন্দ ও নির্লিপ্ত।
আপিসের বড়বাবুর ঘর থেকে ক্লান্ত পায়ে বেরিয়ে আসা ছাপোষার মতোই, ধীরস্থির পদে উচ্চবিত্তের কিচেনের কাবার্ড থেকে আরশোলার বেরিয়ে আসা। বেরিয়েই চট করে একবার চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে, হাওয়া বুঝে নেওয়া।
তারপর ফের হাঁটি হাঁটি পা পা। এগিয়ে চলা।
বিচ্ছিরি রকমের চাপের জীবন। কারা যেন একসময় খুব গলা ফাটাতো-
'লড়াই লড়াই লড়াই চাই
লড়াই করে বাঁচতে চাই।'
তাঁরা লড়াই করে আজও বেঁচে আছেন তো? নাকি লড়াইয়ে জিতে ঘরে বসে দিব্য ঠ্যাং নাচিয়ে, লকডাউনের পর এবার দার্জিলিং না পুরীর প্ল্যান করছেন?
ঠিক তখন ধীরপায়ে হেঁসেলের সিঙ্কের দিকে এগিয়ে চলে আরশোলা। জীবনযুদ্ধের লড়াই। বাবুবিবির এঁটো বাসনপত্রের কোনও কণা যদি সিঙ্কের গায়ে কোথাও লেগে থাকে। উচ্ছিষ্টের কণাই আরশোলার 'ঈশ্বর কণা'। আরশোলা ফিজিক্স জানে না। কিন্তু সে একনিষ্ঠ ভাবে কণারূপী ঈশ্বরের খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই।
এক্সাইড মোড়ে রাইকিশোরী এসকালেটরে চেপে পাতাল রেলের গহ্বরে ঝাঁপ মারে। তার পিছু পিছু ঝাঁপিয়ে পড়ে মোড়ের মাথায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা উস্কোখুস্কো কিশোর।
ঈশ্বরের নাম নিয়ে এক ঝাঁপ আরশোলারও। সোজা সিঙ্কের গভীরে। কিনারায় রেখে যায় জীবনকে বন্ধক।
পাতালগর্ভের জনস্রোতে ভেসে গেছিলো রাইকিশোরী। খাদ্যকণাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছিলো সিঙ্কের জলস্রোত। না সেই উদভ্রান্ত কিশোর, না ক্ষুধার্ত আরশোলা, কেউ কারুর আরাধ্যের দেখা পায়নি।
সিঙ্কের ভেতর শুঁড় নাচাতে নাচাতে ভাবতে বসে আরশোলা- অতঃকিম? সিঙ্কের গা বেয়ে যতবার ওঠার চেষ্টা করেছে ততবারই ধপাস। ঠিক যেন জয়েন্ট এনট্রান্সের পরীক্ষার্থী।
ভাগ্যিস রাজা রবার্ট ব্রুস মাকড়সা দেখেছিলেন। মনোযোগ দিয়ে আরশোলা দেখেননি। রবার্টের মতো ছবারের চেষ্টাতেও উপর্যুপরি হার আরশোলার। পেট উল্টে সিঙ্কে পড়ে থাকা। ঠিক যেমনটা সেদিন পড়েছিল সলমন খানের গাড়ির চাকায় চেপটে যাওয়া মানুষগুলো। সিঙ্কের কিনারায় বন্ধক রেখে আসা জীবনের কাছে পৌঁছতে পারেনি সেই আরশোলা।
হাল ছাড়েনি আরশোলাও।
- 'দেড় বছর পার। আরও অপেক্ষা করতে হবে। খাবোটা কী?' এবার ভাঙা গলায় চিৎকার করে ওঠে ছাপোষা।
- 'আরশোলা নাকি মশাই? উচ্ছিষ্ট খেয়ে বেঁচে থাকবো?' চিৎকার করতে গিয়েই কাশতে কাশতে নাকাল সে।
ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙেছে ছাপোষার।
ওদিকে সিঙ্কের ভেতর চিত হয়েই হাতপা নেড়ে লড়ে যাচ্ছে প্রাগৈতিহাসিক জীবটি। গত পাঁচ কোটি বছর ধরে এভাবেই পৃথিবীতে টিকে আছে আরশোলা।
বিণা যুদ্ধে নাহি নিবো সূচ্যাগ্র উচ্ছিষ্ট।
তবু কালচক্র কদাপি উল্টোমুখেও ঘোরে।
সব পোকামাকড় মানুষ দেখলেই পালায়। আরশোলা খেয়াল খুশি মতো তেড়েও আসে। তোর একদিন কী আমার একদিন! আবার মর্জি হলে, সেলফের গা বেয়ে সোজা একলাফ, মানুষের ঘাড়ে দোল খেতে বসে।
শাড়ি লুঙ্গির ভেদাভেদ করে না। মানবশরীরের রহস্য সন্ধানে অসীম উৎসাহী আরশোলা। পাঁচ কোটি বছর ধরে ভদ্রাসনে বাস করেও, মানুষ চেনা হলো না। শার্লক হোমসের থেকেও বেশি মনোযোগী, অনুসন্ধানী। তড়বড় করে জামাকাপড় ভেদ করে শরীরের গোপন জায়গায় সরেজমিন তদন্ত করে ফেলতে ওস্তাদ।
আবার অনেকসময় আরশোলার চালখানা গদাইলস্করী। মনে হয় বাংলা মাল টেনেছে। দুপা এগোয়। থামে। আবার টলমল করে চলতে লাগে। এহেন জীবটার কখনও ইচ্ছে হয় আকাশে ডানা মেলার। ছাপোষার চাঁদ ছোঁয়ার স্বপ্নের মতো। ডানা ফড়ফড় করে আলমারির মাথা থেকে প্যারা ডাইভিং করে খাবার টেবিলে। সেখান থেকে গৃহস্থের প্রয়াত পিতামহের বাঁধানো ছবির ফ্রেমে। মনোযোগ দিয়ে মুখখানা দেখে আরশোলা। যেন পাঠশালার সঙ্গী ছিলো।
আরশোলাও পাখি হলে ভয় তো পেতেই হবে। ঘরের সবাই তখন সামাল সামাল।
আরশোলা উড়তে থাকে। পড়তে থাকে। আবার ওড়ে।
ছাপোষাও তখন আরশোলা হতে চায়।
চিত্র সৌজন্যঃ সংগৃহীত
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন