বেহালার দিন প্রতিদিন বিশেষ কাজল ভট্টাচার্যের কলমে- সুরায় সুরে রবিচর্চা

 

সুরায় সুরে রবিচর্চা



-- কাজল ভট্টাচার্য
হাতে পেগ নিয়ে কি রবীন্দ্রচর্চা হয়?
পাকস্থলী ভর্তি স্কচ। গলায় রবীন্দ্রগান?
হ্যাঁ অথবা না। কোনও মন্তব্য করার ঝুঁকি নিলাম না। শুধু প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলাম এযুগের ডিরোজিয়ান, 'ইয়ং বেঙ্গল'- এর দরবারে।

জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি।
আধুনিক বাংলার উৎসস্থল বলতে বাঙালি ওই বাড়িটাই বোঝে। কিন্তু প্রাচীন বঙ্গসমাজকে কেতাদুরস্ত আধুনিক করতে উঠেপড়ে লেগেছিল ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত, স্বঘোষিত ডিরোজিয়ান, একদল নব্য যুবক- 'ইয়ং বেঙ্গল'। তাদের আন্দোলন শুরু হয়েছিল মদের গেলাস হাতে। উল্লাসে ফেটে পড়া কলকাতা তড়িঘড়ি তাদের গায়ে দেগে দিয়েছিল বুদ্ধিজীবীর সিলমোহর।
প্রায় দুশো বছর পরেও অধুনা বুদ্ধিজীবীরা সোৎসাহে সেই 'গেলাস' আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে চলেছেন।

তবে সুরার পক্ষধারী আর সুরাবিরোধীদের খটামটিতে একটা ঘটনা পরিষ্কার, কুসংস্কার ভাঙার অছিলায় সেদিন যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তাতে আখেরে হাতে ছিলো মদের গেলাস। আর কুসংস্কার ভাঙার ব্যাপারটা ডুবে ম'লো ওই গেলাসেই।

বাংলা বাঙালির আধুনিকতার উৎস ঠাকুরবাড়িতেও কি মদের অনুপ্রবেশ হয়েছিল? হ্যাঁ হয়েছিল। আর তা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের দু'পুরুষ আগেই। দলিল দস্তাবেজ ঘেঁটে এমনটাই মত গবেষক প্রাবন্ধিকদের। এমনকি ঠাকুরবাড়ির সুরারসিকদের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল রবীন্দ্রনাথের নামটাও।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুরের হাত ধরেই সুরা ঢুকে পড়েছিল ঠাকুরবাড়িতে। তবে তিনি সুরাবাসর বসাতেন 'বেলগাছিয়া ভিলা'র বাগানবাড়িতে। মদের আসর, বাইজির নাচাগানায় তাঁর কীর্তির কথা বলতে গেলে, তাতে জুড়ে দিতে হবে আরেক কীর্তির কথাও। বাঙালিরা ব্যবসায় অচল। এই বদনাম ঘোচান ওই সুরাপ্রেমী দ্বারকানাথ ঠাকুরই। তাঁর জমানাতেই ঠাকুরবাড়ির রমরমা।

প্রিন্স দ্বারকানাথ পুত্র দেবেন্দ্রনাথ প্রথম জীবনে খুব মেপেজুকে চলার মানুষ ছিলেন না। বেশ উদ্দাম লাইফ স্টাইল ছিলো তাঁর। সুরাপানের রসে মজতেন। সেই 'বাবু' দেবেন্দ্রনাথের জীবন শুরু ষোলোতে, শেষ আঠারোয়।
'ইয়ং বেঙ্গল'- এর ঝড়ে ভাসলেন না কেন দেবেন্দ্রনাথ? 
ভাসলেন না কারণ পাশে ছিলেন ঠাকুমা অলকাসুন্দরী। তাঁর স্নেহে নাতি দেবেন্দ্রনাথ তখন বাড়ির শালগ্রাম শিলা, দুর্গা কালীর রূপে মজেছিলেন। এছাড়া ঠাকুমার দেখাদেখি ছিলেন ঠনঠনিয়া সিদ্ধেশ্বরীর ভক্ত।
আবার ছেলেবেলা থেকেই, দেবেন্দ্রনাথ ভক্ত ছিলেন রামমোহন রায়ের। যাঁর প্রভাবে নিরাকার ঈশ্বর সাধনায় মাতেন দ্বারকানাথ পুত্র। বাস্তবে, রামমোহনের মানসপুত্র দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে পিতা দ্বারকানাথের ভাবজগতের ফারাক ছিলো বিস্তর।


মদের গেলাসে না, শ্মশানের নীরবতায় শান্তি খুঁজে পেয়েছিলেন দেবেন্দ্রনাথ। বয়স তখন মাত্র একুশ। ঠাকুমার মৃত্যুকালে তাঁর সঙ্গে গঙ্গাযাত্রায় গিয়েই ওই উপলব্ধি।
বাইশ বছরের ভরা যৌবনেই আধ্যাত্মিক জগতে ঢুকে পড়েন দেবেন্দ্রনাথ। তারপর ন'বছর কাটতে না কাটতেই কাঁধে তুলে নিলেন ব্রাহ্মসমাজের ভার। তার তেরো বছর পরেই প্রবর্তন করলেন ব্রাহ্ম ধর্ম। পিতৃসূত্রে বিলাস ব্যাসনের শৌখিনতা শিখলেও প্রিন্স দ্বারকানাথের কাছেই স্বদেশপ্রেম, সৌন্দর্যবোধের দীক্ষা নিয়েছিলেন দেবেন্দ্রনাথ।

বয়স তখন মাত্র উনত্রিশ। আচমকাই যেন আকাশ ভেঙে পড়লো দেবেন্দ্রনাথের মাথায়। বিশাল দেনার দায় রেখে মারা গেলেন দ্বারকানাথ। প্রয়াত পিতার দেনাশোধ করতে চাপে পড়ে যান পুত্র। এরকম নানা চড়াই উতরাইয়ের পথ পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত আমরা যাঁকে চিনলাম, তিনি প্রিন্স দ্বারকানাথের পুত্র 'বাবু' দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর না। তিনি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
যাঁকে দেখতে ছুটে এসেছিলেন দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুর রামকৃষ্ণ। দেবেন্দ্রনাথের মুখখানা দেখে ঠাকুর বলেছিলেন- 'তুমি কলির জনক'।

মহর্ষি যখন চুয়াল্লিশে, তখন রবীন্দ্রনাথের জন্ম। ঠিক সেসময় কঠোর ধার্মিক নিষ্ঠায় জীবন কাটাচ্ছেন দেবেন্দ্রনাথ। তাই এহেন 'কলির জনক' পিতৃসূত্রে, রবীন্দ্রনাথ সুরাজগতের সন্ধান পেয়ে যান এমনটা মোটেই নয়। তবে মদ নিয়ে কোনরকম ছুতমার্গ না থাকাটাই স্বাভাবিক কবিগুরুর। মদের আসরে বয়সের কোনও বাধানিষেধের তোয়াক্কাও করতেন না তিনি। 
বাবাই ছিলেন রবীন্দ্রনাথের আদর্শ। বয়স যখন মাত্র বারো, বাবার হাত ধরে রবীন্দ্রনাথ চললেন হিমালয় দর্শণে। ওদিকে ততদিনে বাবার কাছে শুরু হয়ে গেছে উপনিষদ শিক্ষা। পিতাপুত্রে কথা হতো ব্রহ্মোপাসনা নিয়ে।
জন্মের পর থেকেই বাড়িতে সাহেবসুবোদের আসতে দেখা। পরবর্তী জীবনে সারা দুনিয়া চষে বেরানো। খুব সামনে থেকে দেখা পাশ্চত্য সভ্যতার কেতাদুরস্ত বৈচিত্র্য। তারওপর চরম মুক্তমনা রবীন্দ্রনাথ। 
তবে যে ঘটনাগুলোর কথা তুলে কবির মদ্যপ্রীতির নমুনা পেশ করা হয়, সেগুলোতে কিন্তু কোথাও রবীন্দ্রনাথের হাতে গেলাস তুলে নেওয়ার ঘটনা নেই। বরং উল্টোটাই। যখনই মদের আসরে সঙ্গীসাথীর কেউ বেহেড হয়ে পড়েছেন, তাঁকে সামলানোর কাজটি করছেন খোদ কবিগুরু।

এমনই এক সুরাপানের আসরে, নেহাত জেদের বশে পরপর সাত গেলাস মদ সাবড়ে দিয়েছিলেন নির্মলকুমারী মহলানবীশ। ভারতে স্ট্যাটিসটিক্সের জনক প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ। তাঁরই স্ত্রী নির্মলকুমারী। সেই আসরে খোদ রবীন্দ্রনাথও ছিলেন বলে তাঁর বিলেতবাস গল্পে লিখেছিলেন মহলানবীশ। এরপর সাত গেলাস সুরা পেটের ভেতর নাচানাচি শুরু করতেই মুশকিল। নির্মলকুমারীর ওই অবস্থা দেখে তাঁকে প্রায় জোর করেই হোটেলে ফিরিয়ে নিয়ে যান কবিগুরু। একেবারে হাত ধরে তাঁকে আগলে পৌঁছে দেন তাঁর নিজের রুমে। 

রবীন্দ্রনাথের সুরাপানের গল্প শোনা না গেলেও, সুরাপানের কেতা শেখানোর ঘটনা শোনা যায়। 'আমাকে সুরাপানের এটিকেট শিখিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ,' বলেছিলেন আশ্রমের শিক্ষক অনিল চন্দের স্ত্রী রানি চন্দ।
তবে কেতা মেনে মদ খাওয়ার ব্যাপারে কবিগুরুকেও পাল্লা দিয়েছিলেন আরেক নাকউঁচু বাঙালি। যাঁর কাঠকাঠ মন্তব্য ঘিরে ছিলো অসংখ্য বিতর্ক। ব্রিটিশ কালচারের ভক্ত সেই আপাদমস্তক বাঙালিটির নাম নীরদ সি চৌধুরী। 

দেশ থেকে লন্ডনে আসা এক অতিথিকে যত্ন করে রেড ওয়াইন খাওয়ার কায়দা কানুন শিখিয়ে পড়িয়ে দিলেন নীরদবাবু। অতিথিও দিব্য ঘাড় নেড়ে সবকিছু শিখেপড়ে হাতে ওয়াইনের পাত্র তুললেন। ব্যাস অমনি কথা নেই বার্তা নেই, নীরদবাবু অতিথির হাতের ওয়াইন দিলেন ফেলে। কী ব্যাপার? পাত্র ধরার কায়দায় ভুল ছিল। আঙুল আর হাতের তাপে ওই মহার্ঘ্য ওয়াইন নষ্ট হয়ে যায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাকি নীরদ সি চৌধুরী, বিলিতি মদ বিলিতি কেতায় খাওয়ার ব্যাপারে কে কাকে শেষ পর্যন্ত টেক্কা দিয়েছিল, তার বিচার করুন সুরাবিশারদরাই।

'স্মৃতির ঝারি উপুর করে ফেলে
নয়নবারি শূন্য করি দিব
উচ্ছ্বসিত মদের ফেনা দিয়ে 
অট্টহাসি শোধন করি নিব।'

ক্ষণিকা'য় মাতাল নামের কবিতা থেকে এই চারটা কলি সামনে রেখে কবিগুরুর মদ্যপ্রীতির প্রমাণ পেশ করতে চেয়েছেন অনেকে। কিন্তু তাঁরা কবিতার শুরুটা চেপে গেলেন কেন?
'শপথ করে দিলাম ছেড়ে আজই
যা আছে মোর বুদ্ধি বিবেচনা .....'
কোথাও কোনও অস্পষ্টতা নেই। আধুনিক কবিতার শব্দের কারসাজি নেই। গোড়াতেই তো পরিষ্কার করে দিয়েছেন গুরুদেব, বুদ্ধি বিবেচনা শুধু ছেড়ে দিলেই চলবে না, ছাড়তে হবে রীতিমতো শপথ করে। তবেই মদের ফেনা দিয়ে অট্টহাসি শোধন করা।
এবার কবিতার শেষে চলে যান-
'...শপথ করে বিপথ ব্রত নেব
মাতাল হয়ে পাতালপানে ধাওয়া।'
শপথ করে বিপথ পথগমন। তবেই মাতাল হওয়া। আর তারপরেই মাতাল হয়ে আমাদের পরম ঈপ্সিত স্বর্গে না, এমনকি জীবনের আধার মর্ত্যেও না, সোজা পাতালপ্রবেশ। দেবি সীতা অগ্নিপরীক্ষার লজ্জা ঢাকতে পাতালপ্রবেশ করেছিলেন। কবিগুরুও কি সেরকম কোনও ইঙ্গিত ছুঁড়ে দিলেন?

'চিরকুমার সভা'র কথা মনে পড়ে? সেখানেতো আরও সরাসরি। ওসব মদ, সুরা- ফুরা না, সোজাসাপটা শব্দে একেবারে মদকুলের কুলীন হুইস্কির নামটাও বলিয়ে নিলেন অক্ষয়কে দিয়ে।
'...দেশে অন্নজলের হলো ঘোর অনটন
ধরো হুইস্কি সোডা আর মুর্গি মটন।'
কিন্তু হুইস্কি সোডা ধরার শর্তটা কী দিলেন? প্রেক্ষিতেই স্পষ্ট গোটাটাই প্রহসন। ১৮৩০ নাগাদ 'ইয়ং বেঙ্গল' আন্দোলনের ছিয়ানব্বই বছর পর ১৯২৬ সালে ওই প্রহসন লিখে, দেশকালের নগ্ন ছবিটা তুলে ধরলেন বিশ্বকবি। 

সুরা থেকে সুরের দূরত্ব রক্ষা করায় রবীন্দ্রনাথকে প্রভাবিত করার নেপথ্যে আরেকজনের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। তিনি রাজনারায়ণ বসু। ছেলেবেলা থেকেই দেবেন্দ্রনাথ যেমন রামমোহনের ভক্ত ছিলেন, পুত্র রবীন্দ্রনাথ তেমনই অনুরাগী ছিলেন রাজনারায়ণ বসুর। সুরাবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন এই রাজনারায়ণ বসু। 
এসবকিছু মিলিয়ে মিশিয়েই হয়তো, কোনদিনই হাতে মদের গেলাস তুলে তথাকথিত আধুনিক হয়ে উঠতে পারেননি মহর্ষিপুত্র।

বাঙালি মাত্রই রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরি মনে করে ছাতি ফোলান। এদিকে 'ইয়ং বেঙ্গল'- এর ফল্গুধারা আজও বহমান। শুধু মুখগুলো বদলে গেছে। মধ্যবিত্ত বাঙালির সব সেন্টিমেন্ট তাঁরা রাম, স্কচ, হুইস্কির বানে ভাসিয়েই ছাড়বেন। 
মুখে কবিতা, হাতে মদের গেলাস, দাড়িচুলের বাহার, এযুগের 'ইয়ং বেঙ্গল'। সবাই মধূসুদন, রবিঠাকুরের এক একটি ক্ষুদ্র আধুনিক সংস্করণ। কিন্তু তাঁদের নাক সিঁটকোতে পারে কবিগুরুর আরেক নেশার কথা কানে গেলেই। 

সকাল হলেই খালিপেটে এক গেলাস কচি নিমপাতার শরবত। পরম নিষ্ঠাভরে চোঁ- চাঁ করে মেরে দিতেন কবিগুরু। একহাতে মদের গেলাস অন্যহাতে নিমপাতার শরবতের গেলাস। দুয়ে মিলে সাচ্চা রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠার চেষ্টাটা কেমন হবে?
- 'ওরে ব্যাটারা মদ না খেলেও আমি গিরিশ ঘোষ। মদ না খেলে তু ব্যাটারা কে?'
সেই দুই মোদোমাতালকে বলা গিরিশ ঘোষের ডায়লগটা আজও, অধুনা 'ইয়ং বেঙ্গল'- এর মতোই সমকালীন।।

মন্তব্যসমূহ