রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন - সাহিত্যিক সন্দীপ চক্রবর্তীর অন্য ধারার গল্প গাঁথার ধারাবাহিক " তুহু মম "

 

রবিবাসরীয়   ধারাবাহিক 


 আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম ।সন্দীপের  প্রতিটি অক্ষরের মাঝে লুকিয়ে থাকে সমাজের চালচিত্র। প্রতিদিন থাকছে  এই সমাজের কথকতা। একেবারে নতুন এক আঙ্গিক। একেবারে অন্য রকম আখ্যান গাথা  

                 তুঁহু মম / ১৫   


সন্দীপ চক্রবর্তী

রুরু অবশ্য কোনওদিনই রানুদি হয়নি। রুরু আর রানুদি দু'জনেই স্যাডিস্ট ধরনের হলেও, দুজনের নিষ্ঠুরতার প্রকৃতি আলাদা। রানুদি কুড়ুলের এক কোপে ধড় থেকে মাথা আলাদা করে দেওয়ায় বিশ্বাসী। রুরু তা নয়। ওর আঘাত অনেক সূক্ষ্ম। আঘাত বলে অনেক সময় তোমার মনেও হবে না। কিন্তু তোমার অগোচরে বুকের ভেতর নিঃশব্দে রক্তক্ষরণ হবে। হতেই থাকবে। তারপর একদিন আবিষ্কার করবে তুমি ডুবে গেছ গভীর অবসাদে। এ জীবন অর্থহীন মনে হতে শুরু করবে। হাসলে মনে হবে অভ্যেসে হাসছ৷ কাঁদলে মনে হবে অভ্যেসে কাঁদছ। এমনকী প্রিয় মানুষটিকে ভালোবাসার সময়েও মনে হবে-- এও একটা অভ্যেস!
কলেজে পড়ার দিনগুলোতে অবশ্য রুরুকে এমন স্পষ্টভাবে চিনতে পারিনি। তখন একটা ঘোরের মধ্যে থাকতাম। ঘোরের মধ্যে থেকেই স্বপ্ন দেখতাম। রুরুকে চিনেছি অনেক পরে। বলতে পারো ওকে বিয়ে করার পর। কিন্তু মজার কথা কী বলো তো, মানুষ যে বয়েসে প্রতিদিন একটার পর একটা ভুল করে সেটাই তার প্রিয়। সেটাই তার আপন। সেই বয়েসেই সে বারবার ফিরে যেতে চায়। মানুষ প্রথম জীবনে ভুল করে আর জীবনের মাঝখান থেকে শেষ পর্যন্ত সেই ভুল বয়ে বেড়ায়। আমিও তাই কুমুদিনী। সারাজীবন কয়েকটা ভুলকে মাথার মুকুট করে পরে রইলাম কিন্তু ভুল জেনেও ভুলগুলো ভুলতে পারলাম না।
যাই হোক, গল্পে ফিরি।
তখন আমি সেকেন্ড ইয়ারে। এত অল্পদিনের মধ্যে প্রাইভেট টিউটর হিসেবে আমার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে কল্পনাও করতে পারিনি। পাঁচজনকে পড়াতাম। টাকাপয়সাও মন্দ আসছিল না। ইংরিজিতে ওই যে একটা কথা আছে না-- অ্যাটিটিউড! আমার অ্যাটিটিউড তখন বদলাতে শুরু করেছে। নিজেকে ভালোবাসতে শুরু করেছি, বলতে পারো। পড়াশোনা আর ছেলে পড়ানোর ফাঁকে যেটুকু অবসর পাই তাতে একটা ভাবনাই মাথার ভেতর খলবল করে। কী করে আরও স্মার্ট হব, কী করে আরও ফ্যাশনেবল হব। ব্লু জিনসের ট্রাউজারের সঙ্গে কী রঙের টিশার্ট পরলে আমাকে মানাবে। কৃষ্ণনগর থেকে নিয়ে আসা দাড়িগোঁফ কেটে ফেলেছি ততদিনে। ক্লিন শেভড গাল। শেভিংয়ের পর ভুরভুর করে ডেনিমের গন্ধ। রুরু কবে একবার বলেছিল কোলনের গন্ধ ওর ভালো লাগে। সেই থেকে ডেনিম ছাড়া আমি অন্য কোনও আফটার শেভিং লোশন ব্যবহার করি না। আর হ্যাঁ, কলকাতার স্মার্টনেসের সঙ্গে পাল্লা দিতে সিগারেট খাওয়াও শুরু করেছি। উইলস নেভিকাট। আমার সাদা শার্টের পকেটে রেড স্ট্রিপড নেভিকাটের প্যাকেট তখন স্টাইল আইকন হয়ে গেছে।
এসবই রুরুর জন্য। রুরুকে ইম্প্রেস করার জন্য। আমার অসংখ্য প্রতিদ্বন্দ্বীর গুহা থেকে রুরুকে ছিনিয়ে আনার জন্য। না হলে হয়তো জীবনের সাজঘরে আমি কোনওদিন যেতামই না। মাথায় নকল মুকুট চড়িয়ে রাজা সাজার কোনও দরকার আমার হত না। জানি, মফস্বল থেকে কলকাতায় পড়াশোনা করতে আসা অনেক ছেলের জীবনেই এরকম একটা পর্ব আসে। তাদের মধ্যে হয়তো কেউ কেউ মেরুদণ্ড সোজা রেখে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে পারে। কিন্তু আমি পারিনি। সেই না-পারার কথা আমি তোমাকে বলতে চাই কুমুদিনী। যাতে তুমি প্রেমিকের আসন দেবার আগে আমাকে আতশকাচের নীচে রেখে দেখে নিতে পারো। না জেনে গ্রহণ করার থেকে ভালোভাবে জেনে প্রত্যাখ্যান করা ঢের বেশি যুক্তিসংগত।
নিদারুণ টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে কেটে যাচ্ছিল আমার সেই দিনগুলো। ক্রমশ আবছা হয়ে আসছে মায়ের স্মৃতি, বাবার প্রাণখোলা হাসির শব্দ, কৃষ্ণনগরের সেই ছোট্ট একতলা বাড়িটা। আর আমি ক্রমশ বনসাই হবার লোভে অরণ্য ছেড়ে পৌঁছে যাচ্ছি রুরুর বারান্দার নাগালের মধ্যে।
এর মধ্যে একদিন একটা ঘটনা ঘটল। আমি আর রুরু নজরুল মঞ্চে একটা অনুষ্ঠান দেখে ট্যাক্সি করে ফিরছিলাম। হঠাৎ রুরু বলল, 'শনিবার আমি আর অমল রায়চক যাচ্ছি। শনিবার ওখানে থেকে রোববার ফিরব।'
সেদিন আমার কী হয়েছিল এতদিন পর আমি আজ আর তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না কুমুদিনী। শুধু এইটুকু বলি, এত রাগ আমার কখনও হয়নি। এই ঘটনার আগেও না, পরেও না। আমি বলেছিলাম, 'তুমি অমলের সঙ্গে যাবে না রুরু।'
রুরু অবাক হয়ে বলল, 'যাব না! কেন যাব না?'
'কারণ আমি পছন্দ করি না'
'কাম অন অর্জুন। দিস ইজ মাই লাইফ। আই উইল ডিসাইড হোয়াট টু ডু অ্যান্ড হোয়াট নট।'
'এটা শুধু তোমার জীবন নয় রুরু। এটা আমাদের জীবন। আই লাভ ইউ।'
রুরু কিছুক্ষণ চিন্তা করে আমার আরও কাছে সরে এসে বলল, 'ওকে ফাইন! অমল ইজ আউট। ইউ আর ইন। আই ওয়ান্ট টু সি হাউ গুড ইউ আর অন বেড। ইউ হ্যাভ টু গো উইথ মি অর্জুন।'
অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে বলে দিলাম, 'যাব।'
'শুধু গেলেই হবে না। রায়চকে আমাদের ফোর্ট র্যাডিসনে থাকার কথা। ওখানে দু'দিনের প্যাকেজের দাম তিন হাজার টাকা। অমল অলরেডি দু'হাজার টাকা দিয়ে অ্যাডভান্স বুকিং করে রেখেছে। ক্যান ইউ অ্যাফর্ড দিস?'
'পারব।'
'ডোনট বি ক্রেজি অর্জুন। আই নো ইউ আর ফ্রম আ মিডলক্লাস ফ্যামিলি। প্রাইস মাস্ট বি ভেরি হাই ফর ইউ।'
আমার মাথায় তখন জেদ চেপে গেছে। বললাম, 'ইয়েস প্রাইস ইজ হাই বাট ভ্যালু অফ মাই লাভ ইজ হায়ার।'
রুরু আমার কাঁধে মাথাটা হেলিয়ে দিয়ে বলল, 'আই উইল বি ওয়েটিং টু ফিল ইয়োর স্যাভেজারি।'
মনে মনে বললাম, 'অ্যান্ড আই উইল বি ওয়েটিং টু হ্যাভ আ শাওয়ার ইন মুনলাইট।'
আমার মধ্যে তুমি যত ইচ্ছে জানোয়ারদের খোঁজ রুরু, আমি তোমার মধ্যে আমার জ্যোৎস্নাকেই খুঁজব। জ্যোৎস্নায় একবার তলিয়ে যেতে পারলে সব জানোয়ার একদিন প্রেমিক হয়ে যায়।



মন্তব্যসমূহ