রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন - সাহিত্যিক সন্দীপ চক্রবর্তীর অন্য ধারার গল্প গাঁথার ধারাবাহিক - " তুহু মম "
রবিবাসরীয় ধারাবাহিক
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম ।সন্দীপের প্রতিটি অক্ষরের মাঝে লুকিয়ে থাকে সমাজের চালচিত্র। প্রতিদিন থাকছে এই সমাজের কথকতা। একেবারে নতুন এক আঙ্গিক। একেবারে অন্য রকম আখ্যান গাথা
তুঁহু মম / ১৬
সন্দীপ চক্রবর্তী
রাস্তা কখনও ফুরোয় না। যেতে যেতে অন্য কোনও রাস্তায় মিলে যায়। গোলাপি বাথটবের কাহিনি আমার জীবনকে গোলাপি আভায় ভরে দিলেও সেখানে আটকে থাকতে আমি চাইনি। কিংবা বারবার দিনটিকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারেও আমার অনীহা ছিল। রুরু অবশ্য এর উল্টোটাই। শরীর নিয়ে কোনও ছুঁৎমার্গ ওর কোনওদিনই ছিল না। যে কোনও দিনই ওর কাছে সম্ভোগের দিন। যে কোনও মুহূর্তে ও জীবনকে তীব্র ভালোলাগায় জড়িয়ে ধরার জন্য তৈরি। যৌনতা ওর কাছে কখনও পুরনো হয় না। কিন্তু আমি সেরকম নই। ভালো লাগা ঘটনাও বারবার ঘটতে থাকলে আমার সাড়া দেবার ইচ্ছেটা মরে যায়। আমার রস যেমন আছে রসের ওপর বশও আছে। আমি জীবনকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে চাই। জীবনের ভাণ্ডার লুট করে রাতারাতি নবাব বা ফকির হতে চাই না। প্রিয় নারীর সঙ্গে মিলনে যে আনন্দ পাই তার দাম আমার কাছে অনেক ঠিকই কিন্তু প্রিয়ার বিরহে মন যে অবোধ কান্নায় ভরে ওঠে, তার দামও কিছু কম নয়। সবই এই জীবনের কাছ থেকে পাওয়া। এই জীবনের দান।
সুতরাং, আমি গোলাপি বাথটবকে মনের গোপন সিন্দুকে বন্ধ করে রেখেছিলাম। মন যখন টানত তখন সিন্দুকের ডালা খুলে বুকভরে শ্বাস নিতাম। ল্যাভেন্ডার সাবানের গন্ধে ভুরভুর করত হোস্টেলের ঘরটা। হাত বাড়ালেই মুঠোয় পেয়ে যেতাম আমার রাজহংসিনীদের। আমার হাত থেকে গমের দানা খাবার জন্য ছটফট করত ওরা। মাঝে মাঝে অব্যক্ত অভিমানে মুখ ঘষে দিত আমার হাতের পাতায়।
নির্দোষ ফ্যান্টাসি। কিন্তু রুরু মানবে কেন? রোম্যান্স ওর কাছে বোকা-বোকা ব্যাপার। এমনিতে ইংরিজি ছাড়া অন্য কোনও ভাষাকে তেমন পাত্তা না দিলেও, ফারুখ আনসারির একটা শের ও সেইসময় সুযোগ পেলেই আওড়াত।
'আগ সে খেলতে খেলতে হাত জ্বল যায়ে তো কেয়া/ আন্ধিয়োঁ সে যুঝতে যুঝতে নাও ডুব যায়ে তো কেয়া/ মুহব্বত এক জুনুন হ্যায়/ ইস সে টকরাতে টকরাতে দিওয়ানা অগর বিখর যায়ে তো কেয়া!'
বুঝতেই পারছ কুমুদিনী, রুরুর উদ্দাম প্রকৃতির কাছে আমি নেহাতই সাধারণ। যতই মফস্বলের ছাপ মুছে আমি কলকাতার আরবান সোসাইটির কেউকেটা হয়ে ওঠার চেষ্টা করি না কেন, রাতারাতি স্বভাব পালটে ফেলা অত সহজ নয়। তাই একটা আশঙ্কা ছিল। রুরুর হাউইয়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে আমার প্রদীপ অসময়ে নিভে যাবে না তো? রুরুর শরীর-সর্বস্ব প্রেম কি কোনওদিন আমার আবেগের মূল্য দেবে?
একে সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যাই বলো, আমার আশঙ্কা সত্যি হয়নি। সে কোন জাদুতে জানি না, রুরু এক দুর্লঙ্ঘ্য পাহাড়ের চূড়া থেকে মাটিতে নেমে এসেছিল। যে রুরুকে আমি চিনতাম, এ যেন সে রুরু নয়। ফোর্ট র্যাডিসনের তিনশো তিপ্পান্ন নম্বর ঘর ওকে যে মায়ায় বশীভূত করেছিল ও যেন সেই মায়াকে একটি স্থায়ীরূপ দেওয়ার খেলায় মেতে উঠেছিল ছেলেমানুষের মতো। হয়তো ও আমার কাছে কিছু প্রমাণ করতে চেয়েছিল। কিংবা নিজেকেই বোঝাতে চেয়েছিল যে আমি অমলও পারি অর্জুনও পারি। আমি পাহাড় হতে পারি, সাগর হতে পারি, আবার নদীও হতে পারি। আমি বিছানায় যেমন সুন্দর ঠাকুরঘরেও তেমনই সুন্দর হতে পারি। পুরুষমানুষের যে কোনও ইচ্ছে পূরণ করতে পারি বলেই আমি রুরু। ঠিক এমনটা তুমি আর কারোর মধ্যে পাবে না। এটা হয়তো ফারুখ আনসারির ভাষায় 'জুনুন'। জিদ। কিন্তু মাত্র কুড়ি বছরের আমার মাথায় তখন একটি মেয়ের জটিল মনস্তত্ত্ব বোঝার ক্ষমতা কোথায়? আমার চোখে তখন রুরুর পরিবর্তনটাই বেশি করে ধরা পড়ছে। আর আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে ভেসে চলেছি মেঘের ওপর দিয়ে।
ফোর্ট র্যাডিসন থেকে ফেরার পর দিন সাতেক কেটে গেল নানারকম দোলাচল আর রুরুর 'পরিবর্তনে'র আনন্দে। যদিও এই সাতদিনে আমাদের দেখা হয়নি। তবে কথা হয়েছে প্রতিদিনই। আমি রাতের দিকে ফোন করতাম। ওর গলায় উচ্ছ্বাস আমাকে বলে দিত গোলাপি বাথটবের রেশ এখনও কাটেনি। একদিন রুরু বলল, 'কাল পাঁচটা নাগাদ মালগুড্ডি ডেজের সামনে আসতে পারবে? জরুরি কথা আছে।'
নব্বইয়ের দশকে মালগুড্ডি ডেজ ক্যামাক স্ট্রিটের বিখ্যাত কাফেটেরিয়ার। সাউথ ইন্ডিয়ান খাবারও পাওয়া যেত। এখন বোধহয় বন্ধ হয়ে গেছে। কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, 'কী কথা?'
'এখন না। কাল এসো তখন বলব।'
পরের দিন গেলাম। গান পাউডার ডোসা আর কফি খেতে খেতে কথা হচ্ছিল। রুরু বলল, 'আর একবার র্যাডিসনে গেলে হয় না?'
এই প্রসঙ্গ যে উঠতে পারে আমি আগেই অনুমান করেছিলাম। বললাম, 'না রুরু। পরীক্ষার আর বেশি দেরি নেই। আমাকে তৈরি হতে হবে। ভালো রেজাল্ট আমাকে করতেই হবে রুরু। বাবার জন্য তো বটেই তোমার জন্যেও।'
'আমার জন্যে কেন?'
'বা রে! আমি অর্ডিনারি রেজাল্ট করলে তোমার কি ভালো লাগবে?'
'না, তা লাগবে না। আই ওয়ন্ট টু সি ইউ উইন এভরি রেস।' বলতে বলতে রুরু মাথা নীচু করল। কফিতে চামচ ডুবিয়ে নাড়ল-চাড়ল খানিক। তারপর বলল, 'তুমি অর্ডিনারি রেজাল্ট করলে বাবাকে তোমার কথা বলব কেমন করে!'
খুব সাধারণ কথা। এইসব কথাই কলেজে পড়া প্রেমিক-প্রেমিকারা সেইসময় বলত। আশায় আশঙ্কায় চেয়ে থাকত ভবিষ্যতের দিকে। কিন্তু রুরুর মুখে এই কথাগুলো শুধু অসাধারণ নয় অপ্রত্যাশিতও বটে। কিছুক্ষণ পর রুরু বলল, 'আসলে কী বলো তো, কাল অমল র্যাডিসনে যাবার কথা বলছিল। আগের বার যাওয়া হয়নি তো, তাই। আমি না করে দিয়েছি।'
মনে হল আমি সারা পৃথিবীর সম্রাট হয়ে গেছি। সত্যি কথা বলতে, রুরুকে ভালোবেসে সুখ পেলেও শান্তি পাইনি। মনে হত রুরুর অসংখ্য প্রেমিকের তালিকায় অর্জুন দাশগুপ্ত একটা নামমাত্র। মানুষ হিসেবে তার আলাদা কোনও মূল্য নেই। প্রেমিক হিসেবেও না। যে রাতে ঘুম আসত না, ভোর হওয়া পর্যন্ত মনে মনে আমি ডুয়েল লড়তাম। কখনও অমল যোগলেকারের সঙ্গে। কখনও বিকাশ কোঠারির সঙ্গে। আবার কখনও রুদ্রপ্রসন্ন রায়ের সঙ্গে। নিজেকে খুব সাধারণ মনে হত। কারণ রুরুর প্রেমিকেরা সবাই ধনী পরিবারের সন্তান। ওদের প্রতিষ্ঠা আছে, সম্পদ আছে। ওরা কথায় কথায় অ্যামেরিকায় ছুটি কাটাতে চলে যায়। জন্মদিনে গাড়ি উপহার পায়। আমি ওদের সঙ্গে কিছুতেই পেরে উঠব না। একদিন রুরু আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে ওদের সঙ্গে চলে যাবে। আমি হাজার ডাকলেও ফিরে তাকাবে না। খুব হতাশ লাগত তখন। একবার রাগে হতাশায় সিগারেটের আগুনে নিজের হাত পুড়িয়েছিলাম। সেই দাগ আছে এখনও।
কিন্তু সেদিন অমল যোগলেকারকে 'না করে দিয়ে' রুরু বুঝিয়ে দিয়েছিল ডুয়েলে আমি জিতেছি। ভালোবাসার নারীকে জয় করার আনন্দ যে কত গভীর হতে পারে, সে আমি জানি কুমুদিনী। দেশ জয়ের আনন্দও তার কাছে তুচ্ছ। কিন্তু এত পেয়েও কি আমার চাওয়া ফুরোয়? আমার যে আরও চাই। তাই বললাম, 'না করে দিলে কেন?'
'র্যাডিসন থেকে ফিরে আসার পর থেকে আমার আর ওদের ভালো লাগে না। শুধু তোমাকে ভালো লাগে। তুমি যেরকম চাও ঠিক সেরকম হতে ইচ্ছে করে।'
জয়ের আনন্দে সেদিন আমি একটা সহজ সত্যি কথা ভুলে গিয়েছিলাম। রুরুর এই পরিবর্তনের পিছনে রয়েছে র্যাডিসনে কাটানো রোম্যান্টিক কিছু মুহূর্ত। রোমান্সকে উপেক্ষা করলেও যথার্থ রোম্যান্টিসিজমের স্বাদ রুরু কখনও পায়নি। ভালোবাসার কান্নায় কখনও বুজে যায়নি ওর গলা। তাই গোলাপি বাথটব থেকে ও নামতে পারেনি। কিন্তু যেদিন বাথটবের রঙ ফিকে হবে সেদিন ওর পরিবর্তনও মিথ্যে হয়ে যাবে।
না কুমুদিনী, পারিনি সেদিন এইসব যুক্তির জাল বুনতে। দুনিয়াদারির সঙ্গে সম্পর্কহীন একটা কুড়ি বছরের অনভিজ্ঞ ছেলের পক্ষে সম্ভব হয়নি উঁকি দিয়ে ভবিষ্যতটি দেখে নেওয়া। আমি ওর হাতের ওপর হাত রেখে নরম গলায় জিজ্ঞাসা করেছিলাম, 'আমার বউ হবে রুরু?'
কামাতুর হরিণির মতো চোখ তুলে রুরু বলেছিল, 'হব।'
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন