পুজোর অসুরের টি আর পি
প্যাকের প্যাকপ্যাকানি
- কাজল ভট্টাচার্য
আচ্ছা, পপুলারিটি কার বেশি?
কার্তিকের নাকি অসুরের। একটাসময় ছিলো যখন বেশ সুন্দর জামাই দেখলেই বলা হতো জামাই কার্তিক ঠাকুরের মতো। আবার বেশ গোলগাল, শান্তশিষ্ট পত্নীপরায়ন স্বামী দেখলেই, শিবের মতো কর্তা। দিন পাল্টেছে। পাল্টেছে রুচি। সুন্দরের উপমাও। কার্তিক ঠাকুর মানে রাঙা আলু। আর শিবঠাকুরের মতো মানে নাপসন্দ ভুঁড়িওয়ালা নাদুসনুদুস পুরুষ। আজ বাজার মাতিয়েছে 'প্যাক'।
একটা জনমত সমীক্ষা করলে বেশ হয়। অসুরের এইট প্যাক দেখে মেয়েদের চোখ চকচক করে ওঠে কিনা? ছেলেদেরও নিশ্চয়ই হিংসা হয়।
সলমন বলুন আর সানি, চাইকী জন আব্রাহাম, কারুর সিক্স হলে কারুর এইট প্যাক। আবার টাইগার শ্রোফ নাকি সেরা। গুনে গুনে 'টেন প্যাক অ্যাব'।
বলিউডে তো এখন প্যাকের ছড়াছড়ি। তারওপর আবার সানি দেওলের 'ঢাই কিলোকী হাত'! উত্তম সুচিত্রা সৌমিত্রর টলিউডেও তা ঢুকে পড়েছে। অনেকেরই বেশ একটা অসুরমার্কা চেহারা। তবে অসুরের পুজোও কিন্তু আমাদের শাস্ত্রমতে সিদ্ধ। দেবীর সঙ্গে পুজো পান অসুরও। তাই অসুরকেও 'দূর ছাই' করা তো দূরের কথা, হেলাফেলা করাও চলবে না। নইলে ঠাকুর পাপ দেবে।
সেই সত্তর আশির দশকে হিন্দি সিনেমার জগতে 'হিম্যান' বলতে ছিলেন একজনই। ওয়ান অ্যান্ড অনলি ধর্মেন্দ্র। তবে সেই চেহারা ছিলো সুগঠিত, সপ্রতিভ। প্যাকের প্রদর্শনী ছিলো না। অসুরের মতো তো কখনোই নয়। ধর্মেন্দ্রর এক চড়েতেই ঠান্ডা, ধেড়ে খোকাদের পান্ডা। ধেড়ে খোকাদের মধ্যে যাদের নাম প্রথমেই মনে আসে, তাঁরা হলেন প্রাণ, প্রেম চোপড়া, অজিত। ওফ সেকি ক্যালানোই না ক্যালাতেন ধর্মেন্দ্র।
তবে যিনি ঠান্ডা হতে ধর্মেন্দ্রকে সবচেয়ে বেশি ভোগাতেন, তিনি শেট্টি। পুরোনাম এমবি শেট্টি। মুম্বইয়ের ডাকসাইটে স্টান্টম্যান, ফাইট কম্পোজার। একের পর আরেক হাড়হিম করা ফাইট সিন। বিশেষ করে লড়াইটা যখন হিম্যান ধর্মেন্দ্রর সঙ্গে।
শেট্টির হাবভাব, চেহারাখানাও ছিলো অসুরের মতোই। ধর্মেন্দ্র যখন 'গদাম' করে শেট্টির টাকমাথায় লোহার রডের বাড়ি মারতো, রড দুমড়ে যেতো। শেট্টির মাথা তখনও আস্ত।
পর্দায় ধর্মেন্দ্র শেট্টি ছিলেন, অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের ডেভিড বুন, জিওফ মার্স জুটির মতো। ওঁরা বল পিটিয়ে ছাতু করতেন। ধর্মেন্দ্র শেট্টি দুজনেই দুজনকে পিটিয়ে ছাতু করার চেষ্টা চালাতেন। কেউ সহজে আউট হতে চাইতেন না। ফল কী হবে, তা সবার জানা। তবু হলের দর্শকরা দমবন্ধ করে অপেক্ষা করতেন কখন শেট্টি আসে। বলিউডের অসুর। আর ধর্মেন্দ্র যেন দেব সেনাপতি।
শীত গ্রীষ্ম বর্ষা, লেদার জ্যাকেট গায়ে না চাপালে চলতো না শেট্টির। হতে পারে ধর্মেন্দ্রর মুখোমুখী হওয়ার আগে শরীরের গরম বাড়িয়ে নিতে ওই ব্যবস্থা। তবে শেষরক্ষা হতো না।
চুলতো দূরের কথা, একটা দুব্বোঘাসও জন্মাতো না শেট্টির মাথায়। ঠিকরে যেতো রোদের আলো। একটা করে ঘুষি খেতেন বা দিতেন, আওয়াজ উঠতো 'ভিসুম ভাসুম'। সেই সঙ্গে হল ফেটে পড়তো তীক্ষ্ম সিটির আওয়াজে। চিৎকার- 'মার শালাকে, মার!'
আর সবাই রাগে ফেটে পড়বেই বা না কেন? হিরোর মা বোন গার্লফ্রেন্ড কেউ বাদ যেতো না। কাউকে দেখলেই ভিলেনের চোখ গোলগোল। জিভ দিয়ে গড়াত লাল। আর সুযোগ সুবিধামতো হাতধরে টান মারা। আটকে রাখা। দ্রৌপদীর অবস্থা করে ছাড়া।
দুর্গার সঙ্গে যেমন অসুরের ফাইট, তেমনই ধর্মেন্দ্রর সঙ্গে শেট্টির। নাগাড়ে সাতের দশক ধরে হিট জুটি। আর পরিচালকও দর্শকের মনের খবর রাখতেন। খুব জানতে ইচ্ছা করতো অমন সেধে সেধে বিচ্ছিরি রকমের প্যাঁদানি খাওয়াবাবদ শেট্টি কত টাকা পেতেন? উনি কীভাবে কোন কায়দায় পেটানি খাবেন, বিলো দ্য বেল্ট নাকি অ্যাভাব দ্য বেল্ট, সেটা কীভাবে ভাবতেন? কারণ শেট্টি শুধু ভিলেন না, ফাইট কম্পোসারও ছিলেন।
ভীষণ মিল খুঁজে পাই শেট্টির সঙ্গে অসুরের।
ব্যাস তেঁতেঁ উঠতেন ধর্মেন্দ্র। দড়াম করে লোহার বেলচার বাড়ি মারতেন। বেলচা ভেঙে পাটপাট। শেট্টির পিঠ আস্ত। আর জেলের গারদের লোহার রড দুমড়ে দেওয়া টেওয়াতো বাঁয়ে হাত কা খেল। তবু হিরোর হাতে মার খেয়ে মরতেই হতো, পরিচালকের কাঠিনাড়াতে।
এতকিছুর পরেও কোনদিন কোনও নায়িকা শেট্টির বিশাল ইস্পাতকঠিন শরীরটার প্রেমে পড়েছিল বলে শুনিনি। বরং ধর্মেন্দ্রর মজবুত সপ্রতিভ চেহারার প্রেমে মজেছিলেন স্বপ্নসুন্দরী হেমা মালিনী। কিন্তু দিনকাল পাল্টেছে।
একই হাল মহিষাসুরেরও।
সারাটা জীবন মার খেতেখেতেই শেষ হলো। সিংহের খামচে দেওয়া। ঘ্যাঁচ করে কামড়ে মাংস খুবলে নেওয়া। ওদিকে দুর্গা ঠাকুরের দৈবী ত্রিশূলের খোঁচা। একবার মরলেও ফের তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত পরপর তিনবার ওই এক মহিষাসুরকে নিধন করে স্বস্তির শ্বাস ফেলেন দেবী দুর্গা।
গোটাটাই শাস্ত্রের কারসাজি ঠিক ওই বলিউডের পরিচালকের মতোই। শেট্টির ওই হাল দেখে দর্শকরা মজা পেতেন। ঠিক যেভাবে আমরা মজা পাই অসুরকে মরতে দেখে। কিন্তু ওই মজার নেপথ্যে লুকিয়ে থাকে অনেক করুণ ইতিহাস। ভাগ্যদেবীর হাতেও প্রচণ্ড মার খেয়েছিলেন শেট্টি। সেখানেও মাথা পেতে হার স্বীকার করতে হয়েছিল, ঠিক ওই মহিষাসুরের মতোই।
মহানবমীর রাতই শেষরাত ছিলো মহিষাসুরের। আজ অসুর নিধন করেছিলেন দেবী। সেই ঘটনা আজও মেনে নিতে পারেনি তাঁর বংশজরা। অন্যায়ভাবে তাঁদের আদিপুরুষ 'হুদুড় দুর্গা' নিধন করেছিলেন দেবী দুর্গা। মহিষাসুরকে ওই নামেই ডাকেন খেড়ওয়াল সম্প্রদায়। ভারতের ভূমিপুত্রদের ভিটেমাটি, বনজঙ্গল ছিনতাই করতেই আর্যরা এক রমণীকে সামনে রেখে যুদ্ধে নামে। কারণ তারা জানতো, আদিবাসীরা কোনও মহিলার ওপর হাত ওঠায় না। ওই যুদ্ধের পরেই গোটা ভূখণ্ড চলে যায় আর্যদের দখলে। ভূখণ্ডের নতুন নাম হয় আর্যাবর্ত।
'ত্রিশূল' সিনেমার কথা মনে পড়ে? শেট্টিকে দমাদ্দম পিটিয়ে এলাকাছাড়া করেছিল অমিতাভ বচ্চন। তারপর ওই জায়গাতেই বোর্ড ঝোলে 'শান্তি কনস্ট্রাকশন'- এর।
মোদ্দা কথা, লড়াই মানে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা। তা সে দেবী দুর্গার সঙ্গে মহিষাসুরের হোক বা ধর্মেন্দ্র শেট্টির।
তবে পিটুনি খেয়ে শেষ পর্যন্ত ভালোমানুষ হয়ে যাওয়ার ঘটনাও আছে। যেমন প্রাণ, শত্রুঘ্ন সিনহা, বিনোদ খান্নার মতো আরও অনেকে। ছিলেন ভিলেন, হয়ে গেলেন চরিত্রাভিনেতা, হিরো।
ঠিক সেরকমই মহিষাসুরও হয়ে গেলেন পূজ্য।
শাস্ত্রে বলে মহিষাসুরেরও শেষ পর্যন্ত ধম্মে মতি ফিরেছিল। মারা যাওয়ার আগে অসুর, দেবীর কাছে বর চান। আর সেই বরের দৌলতেই আজ দেবীর সঙ্গে পুজো পান মহিষাসুরও।
এখন পরিবর্তনের ঝড়।
'আমার জমানায় ওসব ফাইভ প্যাক, সিক্স প্যাকের দরকার পড়তো না,' বলেন ধর্মেন্দ্র। 'এমনকি কথায় কথায় জামা খুলে ফেলার রেওয়াজও ছিলো না।' শরীরচর্চার জন্য খেলাধুলার ওপর জোর দিতেন বলিউডের 'হিম্যান'।
প্যাকের জমানা শুরু হলো শাহরুখ খানের হাত ধরে। সাল ২০০৭। রিলিজ হলো 'ওম শান্তি ওম'। 'দর্দ- এ- ডিসকো' গানে লিপ দিতে গিয়ে শাহরুখ তাঁর 'সিক্স প্যাক অ্যাব' দেখালেন। সেই থেকে বলিউডে শুরু হলো প্যাকের প্যাকপ্যাকানি।
তারও আগে সাতের দশকও এক পরিবর্তন দেখেছিল বলিউড। সুদর্শন মিষ্টি চেহারার হিরোদের গায়ে সিলমোহর পড়লো 'চকলেট বয়'- এর। বাংলায় তাঁদের আদর করে বলা হতো- আহা কাত্তিক ঠাকুর!
আচমকাই এসে হাজির রোগা, ঢ্যাঙা, তোবড়ানো গালের এক যুবক। আগেকার হিরোদের মতো মোটেই শান্তশিষ্ট না। কথায় কথায় রেগে যান। ইমেজটা দাঁড়ালো 'অ্যাংরি ইয়ংম্যান'- এর। অমিতাভ বচ্চনের মধ্যে সাধারণ মানুষ পর্দায় যেন নিজের ছায়া দেখতে পেলো। ব্যাস, দিনশেষ হলো চকলেট মার্কা, কার্তিকের মতো সুদর্শন হিরোদের। রাগী, তেজী, এক অসম্ভব প্রতিবাদী ভাবমূর্তি শেষপর্যন্ত মনে গেড়ে বসলো না দেশের যুবসমাজের। তাঁরা মনোযোগী হলেন আসুরিক চেহারার বন্দনায়।
পরিবর্তন সর্বস্তরে। সামাজিক, রাজনৈতিক, চেতনার ভাবজগতে। পরিবর্তনের ধাক্কায় ক্রমেই দাপট বেড়ে চলেছে সেই আদি আবহমান কাল ধরে চলে আসা পাওয়ার গেমের। সেই গেমের নব অনুপ্রেরণাতেই হিরোর মতো নীতিবাগিশ না হয়ে ভিলেনের মতো দুর্দম হয়ে উঠতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে আজকের তরুণ তুর্কিরা।
ইনিংস শেষের কয়েকটা ওভার বাদ দিলে, গোটা সময়টাই তোফা পিটিয়ে খেলো। মজা লোটো। হিরো তখন সাইডলাইনে ফিল্ডিংয়ে ক্যাচের আশায় গগনপানে তাকায়।
তারই ছায়া বলিউড, টলিউডের রূপোলি জগতেও। এখনকার হিরোদের অনেকেই অনুপ্রাণিত সেই মহিষাসুরের আদর্শেই। শরীরচর্চায় একনিষ্ঠ। অভিনয় টভিনয়ে একটু ঘাটতি থাকলে ওই 'ঢিসুম ঢাসুম' গর্জনে সব অনায়াসেই চাপা পড়ে যাবে। হিরোইনরাও সুরক্ষিত। গায়ের জোর খাটিয়ে ভিলেনরা খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারবে না। বয়ফ্রেন্ড হোক না হোক, হিরোইনের বডিগার্ড হিসেবে কদর বাড়বে হিরোদের। বেড়েছেও তাই। আর তাই সম্পর্কের ভাঙাগড়ার কাহিনীও আজ আকছার।
শাহরুখ সলমনের অনুপ্রেরণার সংক্রমণ পাড়া গলি মহল্লাতেও একইরকম। খেলাধুলার ময়দান ফাঁকা। ভিড় উপচে পড়ছে জিমের কামরায়। প্যাক চাই দেশের যুবদের। যার শরীরে যত প্যাকের অলঙ্কার, তার কদর তত বেশি। প্রশ্ন একটাই, মনের প্যাক বাড়ানোর কথা কেউ ভাবছেন কি? শরীরের প্যাক বাড়িয়ে মহিষাসুরের কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন