বেহালার দিন প্রতিদিন বিশেষ সাংবাদিক কাজল ভট্টাচার্যের কলমে বাংলাদেশ পরিস্তিতি - ' উৎসবের মেজাজে আত্মঘাতী বাঙালি '
বাংলাদেশ পরিস্তিতি বিশেষ
উৎসবের মেজাজে আত্মঘাতী বাঙালি
উৎসবের মেজাজে আত্মঘাতী বাঙালি
ওসব ধম্মকম্ম মাথায় থাকুক।
বাদ দিন ওসব ডিপ্লোম্যাটিক নিন্দা। তথাকথিত অভিজাত বুদ্ধিজীবী, একদশক আগেও মানুষ যাঁদের চিনতো বুদ্ধজীবী নামে, তাঁদের শান্তিবার্তা। পদ্মার ইলিশের গন্ধ ঠিক সময়ে পৌঁছে দেয় বাংলার সংবাদমাধ্যম। হয়তো 'অনিচ্ছাকৃত' দেরি করে ফেলে ওপার বাংলার দেবীমণ্ডপে ভাঙচুরের খবর দিতে। কিন্তু শাক দিয়ে মাছ ঢাকা দিলেও, কট্টরপন্থীদের আঁশটানি গন্ধ বেশিক্ষণ ঢাকা যায় না। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে তা নিমেষেই ভাইরাল।
তবে এসব নিয়ে আমি মোটেই ভাবছি না। ভাবছি অন্য কথা। মনের কথা। সড়কপথে গেলে কলকাতা থেকে কয়েকঘণ্টার রাস্তা। মাত্র ৪২৪ কিলোমিটার গেলেই বাংলাদেশের কুমিল্লা। উড়ে গেলে আরও কম, ৩০৪ কিলোমিটার। সেই কুমিল্লাতেই দক্ষযজ্ঞের শুরু। এরপরেই কট্টরপন্থীদের তাণ্ডব ছড়িয়ে পড়লো বাংলাদেশের নানা প্রান্তে। সবজায়গায় টার্গেট, দেবীদুর্গার পূজামণ্ডপ। মণ্ডপের সেই আঁচ এপার বাংলায় পৌঁছতে খুব একটা সময় লাগার কথা নয়। লাগেওনি। বাংলাদেশতো মামুলি, সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে আজ সাতসমুদ্র পাড়ের খবরও আমরা জেনে ফেলি কয়েক লহমায়।
শিবের ঘরণী। তিনি আগেও দক্ষযজ্ঞ দেখেছেন। এবারেও দেখলেন। সেবার শিবকে ঠান্ডা করতে নারায়ণের কৌশলে ছিন্নভিন্ন হয়েছিল সতীর দেহ। এবারেও হলো, কট্টরপন্থীদের ধর্মোন্মাদ শান্ত করতে। দক্ষ্মরাজের যজ্ঞস্থলের মতোই তাসের ঘরের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলো মণ্ডপ। ধুলায় গড়াগড়ি পূজা উপাচারের। এত আনন্দ আয়োজন মুহূর্তেই তছনছ। এসবকিছুই ধরা পড়লো সাদা চোখে, ক্যামেরার লেন্সে। কিন্তু যা ধরা পড়লো না, তা হলো দোমড়ানো মোচড়ানো বাঙালির মন।
কেন ধরা পড়লো না?
কারণ বাঙালির চোখে রাজনীতির লাল নীল সবুজ চশমা আঁটা। সেই চশমা চড়িয়ে কেউ বললেন, বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার। আমাদের নাকগলানো উচিত না। কেউ আবার গোপাল ভাঁড়ের দেখানো রাস্তায় চালাকি করলেন। একটা লাইনকে ছোট দেখাতে পাশে একটা বড়ো লাইন টেনে দিলেন। মণ্ডপে হামলাবাজির ছবির পাশে, মণ্ডপ পাহারার ছবি এঁটে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করলেন।
'মেরেছো কলসির কানা
তাই বলে কি প্রেম দেবো না?'
প্রশ্ন একটাই। পাড়ার বাহাদুর যে শীত গ্রীষ্ম বর্ষায় রাতজেগে বাড়ি পাহারা দেয়, সেকি ইচ্ছে হলেই দরজা ভেঙে কোনও বাড়ির মাল হাপিস করতে পারে? বাহাদুরের সেই অধিকারে বৈধতার সিলমোহর দেগে দেবেন তো?
বজরংবলির ছবির পায়ের সামনে কোরাণ রাখার স্পর্ধা দেখালে, মুণ্ডু কাটার হুমকিও শোনা গেলো। পরে অবশ্য সেই হুমকির জন্য মার্জনা চেয়ে নেওয়া হয়। আশা করি, সেকুহৃদয় জোটসঙ্গিরা মাফ করেও দিয়েছেন।
অনেকে ঘটনার নিন্দা করলেন। আবার কেউ কেউ কয়েকদিন মগজ ঘামিয়ে মেধাচাষ করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সেখ হাসিনাকে অনুরোধ করলেন, ঘটনার প্রেক্ষিতে পদক্ষেপ করতে। এরপর একদিন হয়তো ওঁরা বুক চাপড়ে বলবেন- দেখলেন তো, আমাদের চাপেই হাসিনা সরকার দোষীদের ধরতে বাধ্য হলো। প্রতিবাদের রাস্তায় ভুল করেও গেলেন না। কারণ সবার টিকি বাঁধা। প্রতিবাদ করলেন তারাই যাঁদের গায়ে সরাসরি দাঙ্গাহাঙ্গামার আঁচ লেগেছিল।
এই শহরের মানুষরাই একদিন রসিকতা করতেন- ভিয়েতনামে বৃষ্টি নামলে কলকাতায় ছাতাখুলে মিছিল হয়। সেদিন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মুণ্ডুপাত করতে গলা ফাটানোর লোকের অভাব ছিলো না। সেই প্রবল প্রতাপশালী বিপ্লবী মানুষগুলো আজ গেলো কোথায়? নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সেই শিশুর মতো কোনও এক গোপন গুহায় ঢুকে সবাই দিবানিদ্রায় গেছেন?
তসলিমা নাসরিন, পরবাসে জানালার পাশে বসে দোহাই আপনি হাসবেন না।
কেন ধরা পড়লো না?
কারণ বাঙালির চোখে রাজনীতির লাল নীল সবুজ চশমা আঁটা। সেই চশমা চড়িয়ে কেউ বললেন, বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার। আমাদের নাকগলানো উচিত না। কেউ আবার গোপাল ভাঁড়ের দেখানো রাস্তায় চালাকি করলেন। একটা লাইনকে ছোট দেখাতে পাশে একটা বড়ো লাইন টেনে দিলেন। মণ্ডপে হামলাবাজির ছবির পাশে, মণ্ডপ পাহারার ছবি এঁটে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করলেন।
'মেরেছো কলসির কানা
তাই বলে কি প্রেম দেবো না?'
প্রশ্ন একটাই। পাড়ার বাহাদুর যে শীত গ্রীষ্ম বর্ষায় রাতজেগে বাড়ি পাহারা দেয়, সেকি ইচ্ছে হলেই দরজা ভেঙে কোনও বাড়ির মাল হাপিস করতে পারে? বাহাদুরের সেই অধিকারে বৈধতার সিলমোহর দেগে দেবেন তো?
বজরংবলির ছবির পায়ের সামনে কোরাণ রাখার স্পর্ধা দেখালে, মুণ্ডু কাটার হুমকিও শোনা গেলো। পরে অবশ্য সেই হুমকির জন্য মার্জনা চেয়ে নেওয়া হয়। আশা করি, সেকুহৃদয় জোটসঙ্গিরা মাফ করেও দিয়েছেন।
অনেকে ঘটনার নিন্দা করলেন। আবার কেউ কেউ কয়েকদিন মগজ ঘামিয়ে মেধাচাষ করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সেখ হাসিনাকে অনুরোধ করলেন, ঘটনার প্রেক্ষিতে পদক্ষেপ করতে। এরপর একদিন হয়তো ওঁরা বুক চাপড়ে বলবেন- দেখলেন তো, আমাদের চাপেই হাসিনা সরকার দোষীদের ধরতে বাধ্য হলো। প্রতিবাদের রাস্তায় ভুল করেও গেলেন না। কারণ সবার টিকি বাঁধা। প্রতিবাদ করলেন তারাই যাঁদের গায়ে সরাসরি দাঙ্গাহাঙ্গামার আঁচ লেগেছিল।
এই শহরের মানুষরাই একদিন রসিকতা করতেন- ভিয়েতনামে বৃষ্টি নামলে কলকাতায় ছাতাখুলে মিছিল হয়। সেদিন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মুণ্ডুপাত করতে গলা ফাটানোর লোকের অভাব ছিলো না। সেই প্রবল প্রতাপশালী বিপ্লবী মানুষগুলো আজ গেলো কোথায়? নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সেই শিশুর মতো কোনও এক গোপন গুহায় ঢুকে সবাই দিবানিদ্রায় গেছেন?
তসলিমা নাসরিন, পরবাসে জানালার পাশে বসে দোহাই আপনি হাসবেন না।
'ধর্মে আছো জিরাফেও আছো।'
সেই কবেই ১৯৬৫ সালে, এই দ্বিচারিতার কথা ফাঁস করে দিয়েছিলেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। ওই প্রবাদের মূলেও ছিলো ধর্মান্ধতা আর দ্বিচারিতার ঘটনা। সেই ঘটনাই ফিরে ফিরে আসে রূপ বদলে।
একটা গোটা দেশ তাও শুধু বাঙালির জন্য, এমনতরো চাওয়ার স্পর্ধা দেখিয়েছিলেন 'বঙ্গবন্ধু'। ভারতের মদতে তিনি তা আদায় করেই ছেড়েছিলেন। মাত্র সাড়ে তিনবছর কাটতেই ক্ষমতা দখলের রাজনীতিতে সপরিবারে খুন হয়ে গেলেন জাতির জনক মুজিবুর রহমান। ঘটনার নেপথ্যে যোগসাজশ ছিলো বঙ্গবন্ধুর নিজের দল আওয়ামি লিগের বিক্ষুব্ধ সদস্য আর কিছু সামরিক কর্তাদের।
ক্ষমতা দখলের রাজনীতি ঢুকে পড়ার পরেই ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য দরকার হলো ধর্মের। আর সেইসঙ্গেই বাঙালির আপনভূমে উধাও হলো কমপক্ষে চারটি জিনিস। বঙ্গবন্ধুর বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজবাদ, গণতন্ত্র আর ধর্মনিরপক্ষেতা। ধর্মের অজুহাতে আরও একবার ভাগ হয়ে গেলো বাঙালি। আর এই ভাগাভাগি সম্পূর্ণ হতেই মৌরুসিপাট্টা গেড়ে বসতে চাইলেন রাষ্ট্রের ক্ষমতালোভী শাসকরা।
'বঙ্গবন্ধু' মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের বাংলাদেশের মাটিতে মহাষ্টমীর দিন থেকে যে তাণ্ডবের ছবি ধরা পড়লো, তলেতলে তার প্রস্তুতি চলছিলো অনেকদিন ধরেই।
১৯৭৭ সালে ক্ষমতায় এসেই পঞ্চম সংশোধনী এনে রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে ধুয়েমুছে সাফ করে ফেলেন জিয়াউর রহমান। কমতে লাগলো সংখ্যালঘু বাঙালির সংখ্যা।
১৯৭৪ সালের সরকারি জনগণনায়, প্রতি একশোজন বাংলাদেশীর মধ্যে হিন্দু বাঙালির সংখ্যা ছিলো ১৩.৫ জন। ১৯৮১ সালে তা দাঁড়ালো ১২.১৩ জনে। এরপর থেকে গ্রাফ ক্রমেই নিম্নমুখী।
এরপর ১৯৮৮ সালে কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতে দিলেন দেশের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হুসেন মহম্মদ এরশাদ। বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের গায়ে সিলমোহর পড়েছিলো ইসলামি রাষ্ট্রের। ১৯৯১ সালে সংখ্যালঘুর সংখ্যা আরও কমে ঠেকলো ১০.৫১ জনে। এরপরেও গ্রাফের অধোগতি থেমে থাকেনি। ২০১১ সালের জনগণনায় বাংলাদেশের প্রতি একশোজনের মধ্যে হিন্দু বাঙালির সংখ্যা দাঁড়ালো সাড়ে আটজনের একটু বেশি, ৮.৫৪ জন।
এই ধারাবাহিক পরিসংখ্যানেই সরাসরি প্রতিফলিত হচ্ছে অতীতে বাংলাদেশ সরকার বাহাদুরের রাষ্ট্রের ধার্মিক পৃষ্ঠপোষকতার চেহারা।
সেদিন বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের স্বস্তি ফিরিয়ে দিয়েছিলো সেখানকার সর্বোচ্চ আদালত। সাল ২০১০। জিয়াউর রহমানের পঞ্চম সংশোধনী এনে সংবিধানের ধর্মনিরপক্ষেতা অবলুপ্তির ঘটনাকে অবৈধ বলে চিহ্নিত করলো আদালত । রাষ্ট্রধর্মের প্রস্তাবনা খারিজ হয়ে যাওয়ায় ফিরে আসার রাস্তা পরিষ্কার হয়েছিল রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের। আজকের অশান্তির পরিবেশে দাঁড়িয়ে হাসিনা দেশের সংখ্যালঘুদের আশ্বস্ত করেছেন, খুব তাড়াতাড়ি সংসদে বিল পেশ করে সংবিধানে ১৯৭২ এর ধর্মনিরপক্ষেতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে।
মূর্তির ওপর কট্টরপন্থীদের এই তীব্র বিদ্বেষ বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন ঘটনায় বারেবারে সেই বিদ্বেষের আঁচ লেগেছে হাসিনা সরকারের গায়।
২০১৭ সালের ঘটনা। ঢাকা সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে গ্রিকদেবী থেমাস, যাঁকে অনেকেই চেনেন 'লেডি জাস্টিস' নামে, তাঁর ভাস্কর্য সরিয়ে নেওয়ার দাবি তুলেছিল হেফাজতে ইসলাম। তার সঙ্গে ছিল আরও কয়েকটা অন্যান্য ইসলামি সংগঠন। কারণ সেই এক ও অভিন্ন- ইসলামি ভাবাবেগ আহত। ইসলামে মূর্তি বর্জনীয়। কট্টরপন্থীদের সেই চাপের কাছে মাথা ঝুঁকিয়ে, ভাস্কর মৃণাল হকের শিল্পকর্মকে সরিয়ে নিয়েছিল হাসিনা সরকার।
এরপরেই পাল্টাচাপে পড়ে যায় সেখ হাসিনা সরকার। ভাস্কর্য সরিয়ে নেওয়ার ঘটনায়, প্রতিবাদে পথে নামে গণজাগরণ মঞ্চ। কিছুদিনের মধ্যেই ওই মূর্তি ফিরে আসে কোর্ট চত্বরে। তবে তা মূল ভবনের সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় অ্যানেক্স বিল্ডিংয়ের সামনে। উপর্যুপরি দুটি ঘটনায় পরিষ্কার, দুটি চাপের কোনওটির মুখে পড়েই, সেদিন মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর স্পর্ধা দেখায়নি হাসিনা সরকার।
সেদিনই কিন্তু সরকারকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মেহবুব আলম। বলেছিলেন, 'হেফাজতে ইসলামের দাবিকে পাত্তা দিলে, আগামিদিনে জটিলতা বাড়বে।' আশঙ্কা জাহির করেছিলেন দেশের অন্যান্য মূর্তি, ভাস্কর্য নিয়েও প্রশ্ন উঠবে ভবিষ্যতে। মেহবুবা আলমের সেই আশঙ্কা যে কতদূর সত্যি, তা বোঝা গেছিলো গতবছরের এক ঘটনাতেই।
খোদ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বসানো নিয়ে সরকারকে সাফ হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন ইসলামি আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব মওলানা গাজি আতাউর রহমান। কোনও রাখঢাক না করে তিনি বলেছিলেন, 'স্কুল করেন কলেজ করেন বিশ্ববিদ্যালয় করেন মসজিদ করেন মাদ্রাসা করেন। প্রয়োজনে মন্দিরও করেন, আমাদের আপত্তি নেই। তবে মূর্তি বা ভাস্কর্য নয়।'
সোজা কথায় খোদ 'বঙ্গবন্ধু'র ভাস্কর্যকেও বাংলাদেশের মাটিতে জায়গা ছাড়তে রাজি হয়নি ইসলামি কট্টরপন্থীরা। সেখানে কৈলাসবাসিনী দেবীমূর্তি ভাঙচুরের ঘটনা তো নিছকই এক মামুলি ঘটনা।
স্থাপত্য, ভাস্কর্য, মূর্তিবিহীন এই দুনিয়ার ছবিটা কেমন হতে পারে, তা একবার ভেবে দেখতে পারেন শিল্পী, কলাকুশলীরা। কট্টরপন্থীদের উৎপাত আজ কিন্তু শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়। তাদের খোয়াব গোটা পৃথিবীটাকে একছাদের তলায় শরিয়তের শাসনে বেঁধে ফেলা। আফগানিস্তানে তালিবান রাজ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরমুহূর্ত থেকেই এই আশঙ্কা আরও বেড়েছে।
পরিস্থিতি যে ক্রমেই ঘোরালো হয়ে উঠছে, তা বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের বক্তব্যেও পরিষ্কার। হেফাজতে ইসলাম, জামাত- ই- ইসলামির মতো সংগঠনগুলোর যোগসাজশেই দুর্গাপূজাকে টার্গেট করা হয়েছিল বলে প্রাথমিক তদন্তে মনে করা হচ্ছে। সন্দেহের ঘেরাটোপে চলে এসছে পাকিস্তানের ভূমিকাও। আফগানিস্তানে তালিবান রাজ কায়েম হওয়ার পরেই বাংলাদেশে সক্রিয়তা বাড়িয়েছে পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই, এমনটাই খবর সেদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক সূত্রের।
তবে পুজোমণ্ডপ ভাঙচুরের ঘটনাকে ছোট ঘটনা, বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা বিরোধী শিবিরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে, ঘটনার দায় থেকে হাত ঝেড়ে ফেলেননি সেখ হাসিনা। দোষীদের পাকড়াও করতে হাসিনা সরকারের পদক্ষেপে মনের জোর ফিরে পেতে শুরু করেছেন ওপার বাংলার সংখ্যালঘু হিন্দু বাঙালিরা। তবে পুলিসের ভূমিকায় বারেবারে সোচ্চার হয়েছেন হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে মানবিকতার ধর্মে বিশ্বাসী মানুষ। কারণ কার্যত বিনা বাধায় লম্বা সময় ধরে ঘটে গেছে একের পর আর এক হামলাবাজির ঘটনা। লুঠতরাজ এমনকি অভিযোগও উঠেছে ধর্ষণেরও।
বাংলাদেশ সরকারের কঠোর পদক্ষেপে ঘটনা একদিন মিটে যাবে। দোষীরা শাস্তি পাবে। কিন্তু স্বজন হারানোর যন্ত্রণার কী হবে?
একসময় পুজো সংখ্যার জন্য স্বপন চক্রবর্তী এক গান বেঁধেছিলেন- সজনী গো প্রেমের কথা। রাহুল দেব বর্মনের গাওয়া সেই গানের অন্তরাতে ছিলো-
'ভাঙলে জোড়া লাগে তামা পিতল
মন ভাঙলে জোড়া লাগে না।'
মন আর আয়না, এই দুটি বস্তু ভাঙলে আর জোড়া লাগে না। চিড় থেকেই যায়। অতীতে ওই চিড়ের ফাঁক গলেই, ভিটেমাটি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল উদ্বাস্তুর স্রোত।
দেবীমূর্তি ভাঙার ঘটনায় শুধু ওপার বাংলার সংখ্যালঘু বাঙালিদেরই না, মন ভেঙেছে এপার বাংলার বেশকিছু বাঙালিরও। যাঁরা একসময় জাতিদাঙ্গার থেকে প্রাণ বাঁচাতে এপার বাংলার নিরাপদ আশ্রয়ে উদ্বাস্তু হয়ে এসেছিলেন। তাঁদের আত্মীয় স্বজনদের অনেকেই সেই সুযোগও পাননি। আবার অনেকেই রাজি হননি বাস্তুজমির টান ছেড়ে পালিয়ে আসতে। পশ্চিমবঙ্গের সেই বাঙালিদের উৎসবের দিনগুলি ভরে গেছে উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তায়।
তাঁদের সাবধান করে দেওয়া হয়েছে, জলঘোলা করবেন না। তাতে এপার বাংলার সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্য নষ্ট হতে পারে। ঘোলাজলে মাছ ধরার সুযোগ পেয়ে যাবেন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মহাজনরা। আর বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্র স্বার্থত্যাগের মন্ত্রে তো এপার বাংলা সেই কবে থেকেই দীক্ষিত। তাই আপাতত মহাত্মার তিন বাঁদরের মতো অবস্থান নেওয়া ছাড়া গতি কী? তবে তাঁদের সাবধান না করলে তাঁরা 'যুদ্ধং দেহী' বলে দৌড় লাগাতো এমনটাও মোটেই নয়। আপাতত এপার বাংলার কানচাপা, চোখঢাকা আর মুখে কুলুপ।
তবু এই পরিস্থিতিতে অন্ধকারের মধ্যেও যেন খানিকটা আশার আলো দেখতে পেয়েছিলেন ওপার বাংলার সংখ্যালঘু বাঙালিরা। হাসিনা জমানায় ফের তাঁরা সুযোগ পেয়েছেন দেশের মাটিতে কিছুটা হাত- পা ছড়ানোর। অঙ্কের হিসেবেও সেরকমই ইঙ্গিত।
২০০৮ সালে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের তিনবছর পর জনগণনায় প্রতি একশোজন বাংলাদেশীর মধ্যে ৮.৫৪ জন ছিলেন হিন্দু। গত এক দশকে ওই সংখ্যা বেড়ে, ২০২১ সালে তা দাঁড়িয়েছে ১০- এ।
এরই পাশাপাশি বাংলাদেশে আজও রয়ে গেছেন হাতেগোনা কিছু বৌদ্ধ সমেত অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। অঙ্কের হিসাবে দেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ০.৯ শতাংশ। সে জায়গায় ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা ৮১.৯।
পাটিগণিতের এই তথ্যই বলে দিচ্ছে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যায় আজও কোনও ভারসাম্য নেই। ওই ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা গেলে উদ্বেগের কালোমেঘ কাটার সম্ভাবনা প্রবল। তার আগে সরকারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই ওপার বাংলার সংখ্যালঘুদের।
আগামী কিছুদিন ওপার বাংলার দিকে তাকিয়ে বসে থাকবেন এপার বাংলার অনেকেই। ঘনঘন কথাবার্তা হবে মোবাইল কলে। বার্তা বিনিময় হোয়াপ, মেসেঞ্জারে। মনখারাপ করলে ভিডিও কলে প্রিয়জনের মুখটা একবার দেখে নেওয়া। মনের উদ্বেগ পুষে রাখতে হবে মনেই।
কোন ঘটনায় মুর্দাবাদ বলতে হবে আর কোন ঘটনায় জিন্দাবাদ, তা ঠিক করে দেবে রাজনীতি। এই পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে ভীষণ মনে পড়ে যায় দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া এক বাঙালির কথা- নীরদ সি চৌধুরী। তিনি যেন দিব্যচোখে দেখতে পেয়েছিলেন বাঙালির ভবিষ্যত। আর সেই দেখার ফসলের নাম দিয়েছিলেন- আত্মঘাতী বাঙালি।
সেই কবেই ১৯৬৫ সালে, এই দ্বিচারিতার কথা ফাঁস করে দিয়েছিলেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। ওই প্রবাদের মূলেও ছিলো ধর্মান্ধতা আর দ্বিচারিতার ঘটনা। সেই ঘটনাই ফিরে ফিরে আসে রূপ বদলে।
একটা গোটা দেশ তাও শুধু বাঙালির জন্য, এমনতরো চাওয়ার স্পর্ধা দেখিয়েছিলেন 'বঙ্গবন্ধু'। ভারতের মদতে তিনি তা আদায় করেই ছেড়েছিলেন। মাত্র সাড়ে তিনবছর কাটতেই ক্ষমতা দখলের রাজনীতিতে সপরিবারে খুন হয়ে গেলেন জাতির জনক মুজিবুর রহমান। ঘটনার নেপথ্যে যোগসাজশ ছিলো বঙ্গবন্ধুর নিজের দল আওয়ামি লিগের বিক্ষুব্ধ সদস্য আর কিছু সামরিক কর্তাদের।
ক্ষমতা দখলের রাজনীতি ঢুকে পড়ার পরেই ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য দরকার হলো ধর্মের। আর সেইসঙ্গেই বাঙালির আপনভূমে উধাও হলো কমপক্ষে চারটি জিনিস। বঙ্গবন্ধুর বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজবাদ, গণতন্ত্র আর ধর্মনিরপক্ষেতা। ধর্মের অজুহাতে আরও একবার ভাগ হয়ে গেলো বাঙালি। আর এই ভাগাভাগি সম্পূর্ণ হতেই মৌরুসিপাট্টা গেড়ে বসতে চাইলেন রাষ্ট্রের ক্ষমতালোভী শাসকরা।
'বঙ্গবন্ধু' মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের বাংলাদেশের মাটিতে মহাষ্টমীর দিন থেকে যে তাণ্ডবের ছবি ধরা পড়লো, তলেতলে তার প্রস্তুতি চলছিলো অনেকদিন ধরেই।
১৯৭৭ সালে ক্ষমতায় এসেই পঞ্চম সংশোধনী এনে রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে ধুয়েমুছে সাফ করে ফেলেন জিয়াউর রহমান। কমতে লাগলো সংখ্যালঘু বাঙালির সংখ্যা।
১৯৭৪ সালের সরকারি জনগণনায়, প্রতি একশোজন বাংলাদেশীর মধ্যে হিন্দু বাঙালির সংখ্যা ছিলো ১৩.৫ জন। ১৯৮১ সালে তা দাঁড়ালো ১২.১৩ জনে। এরপর থেকে গ্রাফ ক্রমেই নিম্নমুখী।
এরপর ১৯৮৮ সালে কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতে দিলেন দেশের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হুসেন মহম্মদ এরশাদ। বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের গায়ে সিলমোহর পড়েছিলো ইসলামি রাষ্ট্রের। ১৯৯১ সালে সংখ্যালঘুর সংখ্যা আরও কমে ঠেকলো ১০.৫১ জনে। এরপরেও গ্রাফের অধোগতি থেমে থাকেনি। ২০১১ সালের জনগণনায় বাংলাদেশের প্রতি একশোজনের মধ্যে হিন্দু বাঙালির সংখ্যা দাঁড়ালো সাড়ে আটজনের একটু বেশি, ৮.৫৪ জন।
এই ধারাবাহিক পরিসংখ্যানেই সরাসরি প্রতিফলিত হচ্ছে অতীতে বাংলাদেশ সরকার বাহাদুরের রাষ্ট্রের ধার্মিক পৃষ্ঠপোষকতার চেহারা।
সেদিন বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের স্বস্তি ফিরিয়ে দিয়েছিলো সেখানকার সর্বোচ্চ আদালত। সাল ২০১০। জিয়াউর রহমানের পঞ্চম সংশোধনী এনে সংবিধানের ধর্মনিরপক্ষেতা অবলুপ্তির ঘটনাকে অবৈধ বলে চিহ্নিত করলো আদালত । রাষ্ট্রধর্মের প্রস্তাবনা খারিজ হয়ে যাওয়ায় ফিরে আসার রাস্তা পরিষ্কার হয়েছিল রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের। আজকের অশান্তির পরিবেশে দাঁড়িয়ে হাসিনা দেশের সংখ্যালঘুদের আশ্বস্ত করেছেন, খুব তাড়াতাড়ি সংসদে বিল পেশ করে সংবিধানে ১৯৭২ এর ধর্মনিরপক্ষেতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে।
মূর্তির ওপর কট্টরপন্থীদের এই তীব্র বিদ্বেষ বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন ঘটনায় বারেবারে সেই বিদ্বেষের আঁচ লেগেছে হাসিনা সরকারের গায়।
২০১৭ সালের ঘটনা। ঢাকা সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে গ্রিকদেবী থেমাস, যাঁকে অনেকেই চেনেন 'লেডি জাস্টিস' নামে, তাঁর ভাস্কর্য সরিয়ে নেওয়ার দাবি তুলেছিল হেফাজতে ইসলাম। তার সঙ্গে ছিল আরও কয়েকটা অন্যান্য ইসলামি সংগঠন। কারণ সেই এক ও অভিন্ন- ইসলামি ভাবাবেগ আহত। ইসলামে মূর্তি বর্জনীয়। কট্টরপন্থীদের সেই চাপের কাছে মাথা ঝুঁকিয়ে, ভাস্কর মৃণাল হকের শিল্পকর্মকে সরিয়ে নিয়েছিল হাসিনা সরকার।
এরপরেই পাল্টাচাপে পড়ে যায় সেখ হাসিনা সরকার। ভাস্কর্য সরিয়ে নেওয়ার ঘটনায়, প্রতিবাদে পথে নামে গণজাগরণ মঞ্চ। কিছুদিনের মধ্যেই ওই মূর্তি ফিরে আসে কোর্ট চত্বরে। তবে তা মূল ভবনের সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় অ্যানেক্স বিল্ডিংয়ের সামনে। উপর্যুপরি দুটি ঘটনায় পরিষ্কার, দুটি চাপের কোনওটির মুখে পড়েই, সেদিন মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর স্পর্ধা দেখায়নি হাসিনা সরকার।
সেদিনই কিন্তু সরকারকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মেহবুব আলম। বলেছিলেন, 'হেফাজতে ইসলামের দাবিকে পাত্তা দিলে, আগামিদিনে জটিলতা বাড়বে।' আশঙ্কা জাহির করেছিলেন দেশের অন্যান্য মূর্তি, ভাস্কর্য নিয়েও প্রশ্ন উঠবে ভবিষ্যতে। মেহবুবা আলমের সেই আশঙ্কা যে কতদূর সত্যি, তা বোঝা গেছিলো গতবছরের এক ঘটনাতেই।
খোদ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বসানো নিয়ে সরকারকে সাফ হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন ইসলামি আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব মওলানা গাজি আতাউর রহমান। কোনও রাখঢাক না করে তিনি বলেছিলেন, 'স্কুল করেন কলেজ করেন বিশ্ববিদ্যালয় করেন মসজিদ করেন মাদ্রাসা করেন। প্রয়োজনে মন্দিরও করেন, আমাদের আপত্তি নেই। তবে মূর্তি বা ভাস্কর্য নয়।'
সোজা কথায় খোদ 'বঙ্গবন্ধু'র ভাস্কর্যকেও বাংলাদেশের মাটিতে জায়গা ছাড়তে রাজি হয়নি ইসলামি কট্টরপন্থীরা। সেখানে কৈলাসবাসিনী দেবীমূর্তি ভাঙচুরের ঘটনা তো নিছকই এক মামুলি ঘটনা।
স্থাপত্য, ভাস্কর্য, মূর্তিবিহীন এই দুনিয়ার ছবিটা কেমন হতে পারে, তা একবার ভেবে দেখতে পারেন শিল্পী, কলাকুশলীরা। কট্টরপন্থীদের উৎপাত আজ কিন্তু শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়। তাদের খোয়াব গোটা পৃথিবীটাকে একছাদের তলায় শরিয়তের শাসনে বেঁধে ফেলা। আফগানিস্তানে তালিবান রাজ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরমুহূর্ত থেকেই এই আশঙ্কা আরও বেড়েছে।
পরিস্থিতি যে ক্রমেই ঘোরালো হয়ে উঠছে, তা বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের বক্তব্যেও পরিষ্কার। হেফাজতে ইসলাম, জামাত- ই- ইসলামির মতো সংগঠনগুলোর যোগসাজশেই দুর্গাপূজাকে টার্গেট করা হয়েছিল বলে প্রাথমিক তদন্তে মনে করা হচ্ছে। সন্দেহের ঘেরাটোপে চলে এসছে পাকিস্তানের ভূমিকাও। আফগানিস্তানে তালিবান রাজ কায়েম হওয়ার পরেই বাংলাদেশে সক্রিয়তা বাড়িয়েছে পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই, এমনটাই খবর সেদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক সূত্রের।
তবে পুজোমণ্ডপ ভাঙচুরের ঘটনাকে ছোট ঘটনা, বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা বিরোধী শিবিরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে, ঘটনার দায় থেকে হাত ঝেড়ে ফেলেননি সেখ হাসিনা। দোষীদের পাকড়াও করতে হাসিনা সরকারের পদক্ষেপে মনের জোর ফিরে পেতে শুরু করেছেন ওপার বাংলার সংখ্যালঘু হিন্দু বাঙালিরা। তবে পুলিসের ভূমিকায় বারেবারে সোচ্চার হয়েছেন হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে মানবিকতার ধর্মে বিশ্বাসী মানুষ। কারণ কার্যত বিনা বাধায় লম্বা সময় ধরে ঘটে গেছে একের পর আর এক হামলাবাজির ঘটনা। লুঠতরাজ এমনকি অভিযোগও উঠেছে ধর্ষণেরও।
বাংলাদেশ সরকারের কঠোর পদক্ষেপে ঘটনা একদিন মিটে যাবে। দোষীরা শাস্তি পাবে। কিন্তু স্বজন হারানোর যন্ত্রণার কী হবে?
একসময় পুজো সংখ্যার জন্য স্বপন চক্রবর্তী এক গান বেঁধেছিলেন- সজনী গো প্রেমের কথা। রাহুল দেব বর্মনের গাওয়া সেই গানের অন্তরাতে ছিলো-
'ভাঙলে জোড়া লাগে তামা পিতল
মন ভাঙলে জোড়া লাগে না।'
মন আর আয়না, এই দুটি বস্তু ভাঙলে আর জোড়া লাগে না। চিড় থেকেই যায়। অতীতে ওই চিড়ের ফাঁক গলেই, ভিটেমাটি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল উদ্বাস্তুর স্রোত।
দেবীমূর্তি ভাঙার ঘটনায় শুধু ওপার বাংলার সংখ্যালঘু বাঙালিদেরই না, মন ভেঙেছে এপার বাংলার বেশকিছু বাঙালিরও। যাঁরা একসময় জাতিদাঙ্গার থেকে প্রাণ বাঁচাতে এপার বাংলার নিরাপদ আশ্রয়ে উদ্বাস্তু হয়ে এসেছিলেন। তাঁদের আত্মীয় স্বজনদের অনেকেই সেই সুযোগও পাননি। আবার অনেকেই রাজি হননি বাস্তুজমির টান ছেড়ে পালিয়ে আসতে। পশ্চিমবঙ্গের সেই বাঙালিদের উৎসবের দিনগুলি ভরে গেছে উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তায়।
তাঁদের সাবধান করে দেওয়া হয়েছে, জলঘোলা করবেন না। তাতে এপার বাংলার সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্য নষ্ট হতে পারে। ঘোলাজলে মাছ ধরার সুযোগ পেয়ে যাবেন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মহাজনরা। আর বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্র স্বার্থত্যাগের মন্ত্রে তো এপার বাংলা সেই কবে থেকেই দীক্ষিত। তাই আপাতত মহাত্মার তিন বাঁদরের মতো অবস্থান নেওয়া ছাড়া গতি কী? তবে তাঁদের সাবধান না করলে তাঁরা 'যুদ্ধং দেহী' বলে দৌড় লাগাতো এমনটাও মোটেই নয়। আপাতত এপার বাংলার কানচাপা, চোখঢাকা আর মুখে কুলুপ।
তবু এই পরিস্থিতিতে অন্ধকারের মধ্যেও যেন খানিকটা আশার আলো দেখতে পেয়েছিলেন ওপার বাংলার সংখ্যালঘু বাঙালিরা। হাসিনা জমানায় ফের তাঁরা সুযোগ পেয়েছেন দেশের মাটিতে কিছুটা হাত- পা ছড়ানোর। অঙ্কের হিসেবেও সেরকমই ইঙ্গিত।
২০০৮ সালে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের তিনবছর পর জনগণনায় প্রতি একশোজন বাংলাদেশীর মধ্যে ৮.৫৪ জন ছিলেন হিন্দু। গত এক দশকে ওই সংখ্যা বেড়ে, ২০২১ সালে তা দাঁড়িয়েছে ১০- এ।
এরই পাশাপাশি বাংলাদেশে আজও রয়ে গেছেন হাতেগোনা কিছু বৌদ্ধ সমেত অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। অঙ্কের হিসাবে দেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ০.৯ শতাংশ। সে জায়গায় ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা ৮১.৯।
পাটিগণিতের এই তথ্যই বলে দিচ্ছে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যায় আজও কোনও ভারসাম্য নেই। ওই ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা গেলে উদ্বেগের কালোমেঘ কাটার সম্ভাবনা প্রবল। তার আগে সরকারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই ওপার বাংলার সংখ্যালঘুদের।
আগামী কিছুদিন ওপার বাংলার দিকে তাকিয়ে বসে থাকবেন এপার বাংলার অনেকেই। ঘনঘন কথাবার্তা হবে মোবাইল কলে। বার্তা বিনিময় হোয়াপ, মেসেঞ্জারে। মনখারাপ করলে ভিডিও কলে প্রিয়জনের মুখটা একবার দেখে নেওয়া। মনের উদ্বেগ পুষে রাখতে হবে মনেই।
কোন ঘটনায় মুর্দাবাদ বলতে হবে আর কোন ঘটনায় জিন্দাবাদ, তা ঠিক করে দেবে রাজনীতি। এই পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে ভীষণ মনে পড়ে যায় দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া এক বাঙালির কথা- নীরদ সি চৌধুরী। তিনি যেন দিব্যচোখে দেখতে পেয়েছিলেন বাঙালির ভবিষ্যত। আর সেই দেখার ফসলের নাম দিয়েছিলেন- আত্মঘাতী বাঙালি।
চিত্র সৌজন্যঃ সংগৃহীত
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন