বেহালার দিন প্রতিদিন বিশেষ সাংবাদিক কাজল ভট্টাচার্যের কলমে - শিল্পশহরে মহালয়ার রাত উৎসবের দুম দ্রাম!

 
শিল্পশহরে মহালয়ার রাত উৎসবের  দুম দ্রাম!

-
কাজল ভট্টাচার্য

তখন রাত দশটা পেরিয়ে গেছে। এইরাত ঘুমানোর রাত না। গাঝাড়া দিয়ে জেগে উঠছে শিল্পশহরের মানুষরা। শব্দবাজির প্রবল বিক্রমে তারই ঘোষণা। 'আমি জেগে আছি। তুমিও জেগে থাকো।' পিতৃপক্ষের শেষ। শুরু দেবীপক্ষের। আজকের পূণ্যরাতে ঘুমানো মানা। এইরাত তো পুনর্মিলনের। প্রয়াত পিতৃপুরুষ মাতৃপুরুষরা নেমে আসবেন উত্তরপুরুষদের অনুভবে। তাঁদের বরণ করে নিতে এইরাত উৎসবের।

তিলোত্তমার রাতে সেই জৌলুস নেই। সেখানে ছবিটা অন্যরকম। ঘড়ির কাঁটায় টিকটিক। রাত বাড়ে। একসময় তিলোত্তমার গতি হারায়। বিশাল অ্যানাকোন্ডারা গা পেতে শুয়ে পড়ে শহরের রাস্তায়। তন্দ্রা ভর করে শহরের বুকে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর ডাকে রাতের শেষ প্রহরে আজও বিছানা ছেড়ে ঠিক কজন উঠে পড়ে জানি না। তবে 
কলকাতায় মহালয়ার রাতটা কাটে বড্ড নিশ্চুপ। মনে হয় যেন এও এক আবহ তৈরির চেষ্টা। পরলোক থেকে নিঃশব্দে নেমে আসেন পিতৃ- মাতৃপুরুষরা। ঠিক যেন ছেড়ে যাওয়া ভিটেমাটি দেখতে আসা। ব্রাহ্ম মুহূর্তের ফুরফুরে নির্মল বাতাসে গা জুড়িয়ে নেয় তাঁদের সূক্ষ্মদেহ। তিলোত্তমার ইহলোক তাই মুখে কুলুপ এঁটে অপেক্ষার প্রহর গোনে। 

শিল্পাঞ্চলের রাতটা কিন্তু উৎসবমুখর। বিশেষ করে আসানসোল শিল্পাঞ্চল থেকে নিয়ে বাংলার গাঘেঁষা ঝাড়খণ্ডেও। রাতের শেষপ্রহর শুরু মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠান দিয়ে। অনেক পুজো কমিটি তার আগেই চোঙা ঝুলিয়ে দেয় পাড়ায় পাড়ায়। গৃহস্থরাও তৈরি হতে থাকেন। 

ঘুমকাতুরেরও সেই রাতে ঘুমটা মোটেই জম্পেশ হয় না। আর হবেটাই বা কেমনে? তুবড়ির আলোয় ঝলমল। বিধিনিষেধ উড়িয়ে শব্দবাজির দুড়ুম- দাড়ুম। রাত যত গড়ায়, নিঃশব্দতা যত বাড়ে, তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বাড়ে হরেকরকমের বাজির তাণ্ডব। বাড়ে উৎসবের মেজাজ। সবমিলিয়ে সে এক জগঝম্প ব্যাপার। তটস্থ নিদ্রাদেবী। 

গৃহস্থের ভদ্রাসনে ঝোলে অলিখিত নোটিস- নিদ্রাদেবীর প্রবেশ নিষেধ। সেরাতে ইনসোমনিয়ার রুগিদেরও ঘুমের বড়ি খাওয়া মানা। তবু মওকা খোঁজেন নিদ্রাদেবী। সুযোগ পেলেই খপ করে ঘাড়ে চেপে বসা। ভর করা চোখের পাতায়। ঘুম আসতেও দেরি হতো না। কারণ বছর দশেক আগেও মহালয়ার রাতে বেশ একটা হিমহিম ভাব নেমে আসতো শহরের বুকে। রমনীয় আবহাওয়া। কখন যেন সেটা উবে গেলো!
টেবিল ঘড়িটা সেদিন অনেকের বিছানায় বালিশ ঘড়ি হয়ে যেতো। নিজের ওপর চরম অবিশ্বাস। আর সেইসঙ্গে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার চেষ্টা ঘড়ির মদতে।

আকাশবাণীর ঐতিহ্য, পরম্পরা মেনে ঘড়ির কাঁটায় চারটে বাজলেই শুরু মহিষাসুরমর্দিনী। সেটা অবশ্য আকাশবাণীর সম্প্রচার না। ক্যাসেটবন্দি সংস্করণ। তবে মূল ব্যাপারটা একই। গোটা শহর জুড়ে তখন এক আনন্দহাট। ওদিকে শব্দবাজির দাপটও তখন চরমে। প্রদীপ নেভার আগে দপ করে জ্বলে ওঠার মতো।
উত্তরসূরীরা আনন্দেই আছে দেখে অবশ্যই পূর্বপুরুষরাও নিশ্চিন্ত হন। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের চণ্ডীপাঠ জোর ধরলেই নিস্তেজ হয়ে আসে বাজির দামালগিরি। চারদিকে তখন এক অন্য পরিবেশ। 

একবার ঘুম ভেঙে গেলে আর বিছানার দিকে তাকানো না। মুখটুখ ধুয়েই চা বিস্কুট দিয়ে শুরু। অনেকেই সেদিন নস্টালজিয়ার হাত ধরে রেডিয়োর মহিষাসুরমর্দিনী শোনেন। বছরের অন্তত একটা দিন বরাদ্দ রেডিয়োর জন্য। ওই অনুষ্ঠানের দৌলতেই পরলোক থেকে বাংলায় প্রত্যাবর্তন হয়েছে রেডিয়োর। তারপর মার্কোনি সাহেবের ওই বিস্ময় আবিষ্কারকে জীবনদান করেছে 'মিটার ফ্রিকোয়েন্সি'। আবার অনেকে রেডিয়োর কাজ চালান মোবাইলে। 

মহিষাসুরমর্দিনীতো অজুহাত। শেষরাতের আড্ডাটাই আকর্ষণ। ওই কাকভোরে শিল্পশহরের রাস্তায় বেরোলে সেরকমটাই সন্দেহ হয়। বেশ একটা অন্য মেজাজ। অন্যদিন ওই সময়টা কাটে ঘুমের ঘোরে। এই একটা দিনই অন্ধকার থেকে পৃথিবীর আলোয় ফেরার সাক্ষী হওয়া। 
'বাজলো তোমার আলোর বেনু!' ভেসে আসে চোঙায়। কমবয়সীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাড়ার মোড়ে খোশগল্পে মাতে প্রবীণের দলও। সেদিন অনেকেরই মর্নিংওয়াক শিকেয় ওঠে। এই বিশেষ দিনটায় চায়ের দোকানের ঝাঁপও ওঠে সকাল সকাল। মাটির ভাঁড়ে চায়ে চুমুক দিতে দিতে তখন মনে হয়- শিল্পশহরের মেজাজটা আজও বাদশাহি। শিল্প অস্তাচলে গেলেও, শিল্পাঞ্চলের উষ্ণতা একটুও কমেনি। 

ওদিকে ততক্ষণে আরেকদল বেরিয়ে পড়েছে পিতৃতর্পণ সারতে।
চিত্রঃ সংগৃহীত 

মন্তব্যসমূহ