বেহালার দিন প্রতিদিন এর ক্যানভাস কথায় আজ ফ্রিউইংস এর চার শিল্পীর সৃষ্টির কথা

 দিন প্রতিদিন ক্যানভাস কথা 


ফ্রিউইংসের চার শিল্পী



ধ্রুবজ্যোতি নাথ এর সৃষ্টি 


কাজল ভট্টাচার্য 

মহামায়ার জগত। এক দেবীর বিসর্জনের রেশ মিটতে না মিটতেই, আবাহন আর এক দেবীর।
দেবীর রূপান্তর হয়। কখনও তিনি মহিষাসুরমর্দিনী তো কখনও করালবদনী কালী। কখনও তিনি স্বর্ণাঙ্গী, আবার কখনও তমসারূপী। তবে তিনি এক ও অনন্যা। ঠিক যেমনটির দর্শন মিললো ধ্রুবজ্যোতি নাথের দুই ক্যানভাসে- মহামায়া এক, মহামায়া দুই।
ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজের স্নাতক। রংরেখার ইন্দ্রজালে ধরতে চেয়েছেন সেই মহামায়ার দুই ভিন্নতর রূপকে। একই অঙ্গে দুই রূপের সহাবস্থান। আলোছায়ার খেলায়। স্বর্গের দেবীকে নামিয়ে এনেছেন মর্তে। দেবী সালঙ্কারা। হাতের বালায় ভৈরবের ত্রিশূলের প্রতীক। শক্তিরূপিনী ত্রিনয়নীর কপাল জুড়ে লাল আভা। বিদ্রোহের ললাটলিখন কীসের ইঙ্গিত?
সবুজ মনোরম প্রেক্ষাপটে ফুলের বাহার। দেবীর অধিষ্ঠান। দেবীর শান্তমুখ, চোখের দৃষ্টি উধাও সুদূরে। যেন নিজেতেই সমাহিত। আবার অন্য ক্যানভাসে মহামায়ার ঠোঁটের অতলে স্মিত হাসির ছোঁয়া। সবুজ প্রেক্ষাপটে শিউলি ঝরে। মুখের যেদিক আলোময়, সেদিকে দুর্গাদর্শন। ছায়াঢাকা দিকে বিরাজ করেন মা কালী।

রুচিরা মজুমদার পালের সৃষ্টি 

রুচিরা মজুমদার পালও সেই নারীশক্তির কথা বলেন। নারীজীবনের সাতকাহন। আর তাই নারী আর প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার। গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের রুচিরা নারীর হয়ে সওয়াল করেন। তবে তা ক্যানভাসে। তা বলে তিনি যে একপেশে ঘোর নারীবাদী এমনটা মোটেই না। 
নারীপুরুষ যুগলমিলনেই অনাবিল আনন্দস্রোত। আর সেই আনন্দযজ্ঞ থেকেই সৃজন। দুজনাতেই সম্পূর্ণ। সদাই মঙ্গলময়।
ছবি আঁকার পাশাপাশি নানা রঙবেরঙের টুকরো কাপড় সেলাই করে, বা আঠা দিয়ে জুড়ে এক রূপকল্প তৈরি করা শখ রুচিরার। বলা যায় টুকরো কাপড়ের কোলাজ। নয়নাভিরাম সেই শিল্পকর্ম। 'কথায় যা বলা যায় না,' রুচিরা বলেন, 'তা বলা যায় রংয়ে রেখায়।' ছবি দেশ কাল ভাষা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক। সেই কথাই তাঁর অনুরাগী দর্শকদের শুনিয়ে গেলেন তিনি।

ইন্দ্রাণী ঘোষএর সৃষ্টি

ক্যানভাসের পরিসরেই সংসার খুঁজে পেয়েছেন ইন্দ্রাণী ঘোষ। জীবন রং তুলির জগতে। দিব্য মনের কথা উজার করে ঢেলে দেন ক্যানভাসে। সেখানে তাঁর কল্পজগতের নারীরা অঙ্কুর থেকে বিকশিত হয়ে মহীরুহর রূপ নেয়। আবার সেই মহীরুহই কোনও এক ঝিঁঝিঁঢাকা সন্ধ্যায় হয়ে ওঠে এক নারী।
সবুজরঙা হাতের পাতা আলতো করে পাতা থাকে গাছের গায়। সেই নারীই আবার মাতৃসম্ভবা। তাঁর ক্যানভাসের নারীরা যেন গাছকে জড়িয়ে মাথা তুলে আকাশ দেখে। প্রেম ভালবাসা সব গাছময়। আবেগের মণিকোঠায় সেই গাছ ডালপালা মেলে। সম্পর্ক জীবনের নানা রূপ, তার ছন্দপতনের সাক্ষী ইন্দ্রাণী নিজে। ছ'বছর আগে অ্যাকাডেমিতে এক্সিবিসন করার পরেই জেদ চেপে বসে। পরিস্থিতির সংঘাতে পথ চলায় ছেদ পড়লেও তা যে থেমে যায়নি, তার প্রমাণ 'ফ্রিউইংস'- এর এই এক্সিবিসনে ইন্দ্রাণীর ভাগিদারী।
শুভঙ্কর সিংহএর সৃষ্টি 


ঘননীলের জগতে বাস তরুণ শিল্পী শুভঙ্কর সিংহর। পছন্দের রং বলতে প্রুসিয়ান ব্লু। পাড়ার আঁকার স্কুলে হাতেখড়ি। সেখান থেকে গ্যালারিতে পৌঁছে যাওয়া। কবজির জোর থাকলে এরকম অনেককিছুই করা যায়। আবার গ্যালারি থেকে ছবি বিক্রিও করে ফেলা যায়। আর সেটাই একলব্যের মতো দেখিয়েছেন শুভঙ্কর।
শিল্পীর ক্যানভাস জুড়ে সেই আঙুলের ছাপ। ইমপ্যাস্টোতে ভীষণরকম প্রকট।
দুনিয়ার ব্যাপ্তিটা বেশ বড় এই তরুণ শিল্পীর। পরিচালনার কাজে জড়িয়ে ছিলেন শর্ট ফিল্মে। 'যেভাবেই হোক ফিচার ফিল্ম তৈরি করবো,' বলেন শুভঙ্কর। সিনেমার ছায়াজগতের মতোই তাঁর অমোঘ টান আকাশ পেরিয়ে গ্রহ নক্ষত্রের দেশে। সেখানেই কী স্বর্গাধিপতি দেবদেবীদের বাস? নাকি ওই দেবদেবীরা আসলে নিছক গ্রহান্তরের মানুষ? আবার গোটাটাই মনগড়াও হতে পারে। প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ডানিকেনের বই হাতড়েছেন। শেষ পর্যন্ত নিজের কথা জনতার দরবারে পেশ করতে নিজেই একটা বই লিখে ফেলেছেন- গড: অ্যানসেন্ট এলিয়েন অর আ মিথ। ২০১৭ সালে সেই বই প্রকাশ হওয়ার পরে আপাতত শিল্পী ব্যস্ত তাঁর পরের বই 'হোয়াই দ্য ইউনিভার্স ইজ এক্সপ্যান্ডিং' লিখতে। রংতুলির সঙ্গে সমানতালে নিজের কল্পলোকের রূপ ফুটিয়ে চলেছেন শব্দের সমাহারেও।


মন্তব্যসমূহ