রবিবাসরীয় দিন প্রতিদিন বিশেষ

   পুজোর খাবারের সেদিন 

 ।। ঘুগনি, চপ আর চায়েই পরমানন্দ।।


   কাজল ভট্টাচার্য ,কলকাতা


(তখন রোল, চাওমিন, মোমো, পিৎজার নামও শোনেনি বাঙালি। পুজোর আড্ডায় ঘুগনি, চা, চপেই সে মহাসুখী। স্বাদের বিবর্তন হয়েছে। রকমারি খাবারদাবার বেড়েছে। সুখের স্বাদটা গিয়েছে কমে।)




থুতু এখন ড্রপলেট।
থুতু এখন জুজু। থুতুর থেকে কমপক্ষে দু'মিটার দূরে। আর সেই পুজো আড্ডার ব্যাপারটাই ছিলো থুতুময়। সিগারেটের ফিলটারে থুতু মাখামাখি। সিগারেট ফোঁকার নামে সিগারেট চোষা। তাও ইচ্ছে করে পাশের জনকে দেখিয়ে দেখিয়ে। যাতে সিগারেট শেয়ার না করতে হয়। তবু বেপরোয়া। শেয়ার করবি না মানে? খিস্তি মারতে মারতে সেই সিগারেটেই টান মারা। পুজোর আড্ডাতে এই ব্যাপারটা উঠতো চরমে। 

তখন কাগজ বা প্লাস্টিকের কাপ বাজারে আসেনি। মাটির ভাঁড়ে চা খাওয়া। আর সেই চা যদি হতো পোড়া দুধের গন্ধওয়ালা, তাহলে তো ডাবল মেজাজ। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারটাও অবশ্যই থাকতো। পুজো প্যান্ডেলের একটু দূরে, ঘাসের গালিচায় ম্যারাথন আড্ডা। সবারই খিদে লাগতো বৈকি।

তখনও চাওমিন, পাস্তা, মোমো, পিৎজার নাম শোনেনি বাঙালি। এমনকি রোলের নামগন্ধও আকাশ বাতাসে ছিলো না। সত্তর থেকে আশির দশকের সময়। তারমানে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছর আগের কথা। সময়ের ঘড়িতে তা মারাত্মক কিছু নয়। তবে তখন যারা দাপিয়ে বেড়াত, আজ তাদের অনেকেই ঘর ঢুকে গেছে। বাইরের খাবার খাওয়া মানা। সকালে ছানা, দুপুরে এককাপ গরম ভাতজাতীয় খানা। রাতে দুধের মধ্যে কর্নফ্লেক্স। চপ সিঙারা ফুলোরি ঘুঘনির স্বাদটাও বোধহয় তারা ভুলে মেরে দিয়েছে। বেঁচে থাকতে হলে ওরকম অনেককিছুই ভুলে যেতে হয়। নইলে আগেভাগেই বিদায় নিতে হয়। দু একজন যে নেয়নি এমনটাও নয়। 

আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখনকার মোমো বলতে ঘুঘনি। মোমোর মতোই ওই ঘুগনিও ছিল দুরকমের- ভেজ, ননভেজ। হয় প্লেন, নাহয় মাংসের ঘুগনি। অ্যালুমেনিয়ামের ডেকচি ভর্তি। সেই ডেকচির ওপর একবাটি ভর্তি কুঁচো পেঁয়াজ, লঙ্কা আর বিটনুন। ফরমায়েশ মতো বিক্রেতা ঘুগনিতে ওগুলো মিশিয়ে দিতো। অনেকের কাছে আরও দুটো জিনিস থাকতো- পাতিলেবু আর শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো। বললেই ঘুগনিতে কয়েক ফোঁটা লেবুর রস। আর ওপরে ছড়িয়ে দিতো ওই লঙ্কার গুঁড়ো। গরম ঘুগনিতে ওই পাতিলেবুর টক আর লঙ্কাগুঁড়ো মিলেমিশে সে এক জগঝম্প ব্যাপার। যে খেয়েছে সেই জানে। ঘুগনি হজম হয়ে যাওয়ার পরেও জিভের ঝাল কাটতো না। সে ততক্ষণে গোত্তা মারতো ব্রহ্মতালুতে।




আর একরকম ঘুগনি ছিলো। সে উচ্চবর্ণের। সেই ঘুগনির ওপর ঢালা হতো কয়েক বড় চামচ প্রায় দুধের মতোই পাতলা দই। আর সেই দই এমনই টক যে তেতুলের গায়ে ঢাললে, তেতুলও লজ্জায় মুখ লুকাতো। তার ওপর পাপরি ভেঙে ছড়িয়ে দেওয়া। আর সবশেষে বুকের পাটা মেপে শুকনো লঙ্কাগুড়ো। ওই রগরগে ঘুগনির নাম ছিলো পাপরিচাট।

চপ আর ফুলোরির সঙ্গে থাকতো চাটনি। 
কাঁচালঙ্কার সঙ্গে পোদিনা পাতা বেটে তৈরি হতো সেই চাটনি। কটকটে ঝাল আর টকের জোট যে কতটা মারাত্মক, তা বোঝা যেত জিভে ওই চাটনির ছোঁয়া লাগলেই। গরম চপ, ফুলোরির সঙ্গে সেই চাটনি, অবধারিতভাবেই তেজ বাড়িয়ে দিতো বাঙালির। তখন পেটরোগা বাঙালির সংখ্যাও ছিলো কম।




এরপর শেষপাতে গরম চা। তখন ওসব লাল চা, লিকারের ব্যাপারের ছিলো না। চা মানেই দুধ চা। ওই টকঝাল মাখানো জিভে গরম চায়ের ছ্যাঁকা, বরদাস্ত করা খুব একটা সহজ ব্যাপার ছিলো না। চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দেওয়ার পর যে তরল গলা দিয়ে নামতো তার দাপটই আলাদা। করোনার ভাইরাস গলায় বাসা বেঁধে থাকলেও বাপ বাপ বলেও পালানোর পথ পেতো না। তাই বোধহয় তখন ওই সব রোগবালাই মানুষের আশপাশে ঘেঁষতেও সাহস পেতো না।

সবকিছু চুকেবুকে গেলে সিগারেট। সে এক তুরীয় মেজাজ। কেউ পকেট থেকে সিগারেট বার করলেই মুহূর্তে প্যাকেট ফাঁকা। আর প্যাকেট শেষ হলেও যদি কারুর পকেটে দু- একটা পড়েও থাকতো, তাহলেই শুরু হতো সিগারেট চোষা।

সপ্তমীতে ঘুগনি হলে অষ্টমীতে চপ। এক রাউন্ড মাংসের চপ হলে, পরের রাউন্ডে ভেজ চপ। টাকাপয়সার একটা হিসেব করতেই হতো। ঝামেলাও বাঁধতো। দলের মধ্যে এমনও কেউ কেউ থাকতো যারা হাড় কঞ্জুষ। তখন চাঁদা তোলা হতো। প্রথম রাউন্ডের জন্য চারজন টাকা দিলো। দ্বিতীয় রাউন্ডের সময় অন্য চারজন। ঝগড়াঝাটিও চলতো, মুখও চলতো। আর ঘুগনি, চপের মাঝেমাঝে স্বাদবদলের জন্য ফুলোরি।

নবমীতে আড্ডার মেজাজটা বেশ বদলে যেত।
দেরি হতো সকালের আড্ডা ভাঙতে। যে বন্ধুরা একটু দূর থেকে আসতো, তারা দুপুরে বাড়ি ফিরতো না। সামনাসামনি থাকে এরকম কোন না কোনও বন্ধুর বাড়িতেই দুপুরের খাবারটা সেরে নিতো। তারপর সন্ধে নামতে না নামতেই পায়ে- পায়ে সবাই এসে জড়ো হতো আড্ডায়।

নবমীর রাতের আড্ডায় চপ ঘুগনি চায়ের জন্য আর কেউ চাঁদা তুলতো না। এমনকি নিজে থেকে দিতে গেলেও বলতো, "চায়ের অর্ডারটা করিস।" কার পকেটে কটাই বা টাকা। তবুও নির্দ্বিধায় পকেট খালি করার নেশা ভর করতো প্রায় সবার ওপর। ঠিক জমতে চাইতো না সেরাতের আড্ডাটা। সবার ওপর ভর করতো এক অন্তহীন বিষাদ। কলেজে উঠেই বন্ধুদের অনেকে বাইরের কলেজে ভর্তি হয়েছিল। হস্টেলে থাকতো। সারাবছরে সবার সঙ্গে দেখা সাক্ষাতও হতো না। একমাত্র ওই দুর্গাপুজোর সময়েই সব একজায়গায় জড়ো হতো। তখনও হাতে মোবাইল আসেনি। যোগাযোগ মানে চিঠি লেখা। ওসব হয়ে উঠতো না। 

নবমীর আড্ডাতেই দশমীর বিষাদের সুর। নানা সমস্যার কথা। হস্টেলের খাবারদাবার থেকে নিয়ে সাংসারিক, একেবারেই ব্যক্তিগত নানা সমস্যার কথা। তারপর দোলাচলের ভবিষ্যতের কথাতো থাকতোই।
যে দুটো ছাড়া একটা চপ খাওয়ার কথা শুনলেও রেগে যেত, তার চপে অরুচি। তবে চায়ের রাউন্ডের সংখ্যা যেত বেড়ে। আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সিগারেট ফোঁকা। 



রাত গড়াতো, ভিড় বাড়তো। অন্যদিন ওই ভিড় দেখে চোখের শান্তি হতো। আবার ভিড়ের মধ্যেই একটা মুখ মনে গাঁথা হয়ে যেত। পরের বছর হয়তো দেখা যেত, কোনও এক বন্ধু সপ্তমী বা অষ্টমীর আড্ডা থেকে গায়েব। পরের দিন চেপে ধরলেই শোনা যেত, গতবারের পুজোয় চোখাচোখি হয়েছিল। এবার হাতে হাত ধরে ঘোরাঘুরি হলো। তবে আড্ডার একটা শর্ত ছিল, দুনিয়া রসাতলে গেলেও নবমীর রাতের আড্ডা মিস করা চলবে না। সবসময় সবাই যে সেই অলিখিত নিয়ম মেনে চলতো, তা নয়। তবু কারুর জন্য আড্ডা থেমে থাকতো না। 

দশটা নাগাদ শুরু হতো ঘড়ি দেখা।
- কিরে উঠবি নাকি।
- হ্যাঁ উঠবো। বোস, আর একটা সিগারেট ধরা।
- চা হবে নাকি আর একবার?
- খাবি কিছু? আমার খিদে পেয়েছে?
- নারে, ইচ্ছে নেই।
আর কথা বাড়াতো না ক্ষুধার্ত বন্ধু। চুপচাপ একটা সিগারেটে আগুন দিতো। সিগারেট জ্বলতো আমরা পুড়তাম। সিগারেট ছোট হওয়ার মতোই আমাদের আড্ডার সময়টাও ছোট হয়ে, শেষের দিকে এগুতো। শেষরাতের আড্ডায় কেউ কাউকে ড্রপলেট মাখামাখি সিগারেট শেয়ার করতো না।


মন্তব্যসমূহ