দিন প্রতিদিন বিশেষ

 আবার নির্ভয়া , আবার রাজনীতি 


 ।। আরও এক ধর্ষণ, আবারও উত্তাল উত্তরপ্রদেশ রাজনীতি ।।





   কাজল ভট্টাচার্য , কলকাতা 

গ্রামে ফিরলো উন্নিশ বছরের ধর্ষিতার ছিন্নভিন্ন শরীর। 
রক্তমাংসের শরীরটা ছিল ধর্ষকের শিকার। কিন্তু প্রাণহীন শরীরটা যে এমন ভিভিআইপি হয়ে যাবে কে জানতো? খাকি উর্দিতে ছয়লাপ। ডিএম প্রবীণ কুমার এখনও অবশ্য ঘটনাকে ধর্ষণের ঘটনা বলতে রাজি না। কারণ অত্যাচারের চিহ্ন দেখা গেলেও, ধর্ষণের প্রমাণ মেলেনি। 

ওদিকে ততক্ষণে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসছেন ধর্ষিতা। শুরু হলো প্রতিযোগিতা, দলিত প্রেমের কৃত্রিম আবেগে কোন শিবির কতটা এগিয়ে। দিল্লি থেকে বেরিয়ে পড়লেন রাহুল গাঁধি সঙ্গে প্রিয়াঙ্কা ভাদরা। উত্তরপ্রদেশ কেন, রাজস্থানে যান- বললো বিজেপি শিবির। সেখানেও ধর্ষণ হয়েছে। ওদিকে লাঠিসোটা উঁচিয়ে, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তৈরি উত্তরপ্রদেশ পুলিস। কাউকে ঢুকতে দেওয়া যাবে না হাথরসে। 

বুধবার মাঝরাতের গাঢ় অন্ধকার। অ্যামবুলেনসে হসপিটালের সাদা চাদরে শরীর ঢেকে ঘরের দুয়ারে হাজির হয়েছিল সে। শেষবারের মতো। হোক নিস্পন্দ শরীর, তবু ঘরের মেয়ে তো। শেষবিদায়ের আগে একবার ঘরের দাওয়ায় নামানো হোক মৃতার শরীর। উত্তরপ্রদেশ পুলিসের কাছে অনুরোধ জানিয়েছিলেন ধর্ষিতার মা, বাবা, ছোট ভাই। পুলিসের হাতে সময় ছিলো না। পরিবারের অনুরোধ, উপরোধকে গায়ের জোরে উড়িয়ে অ্যামবুলেন্স এগিয়ে গেলো। 
অগস্ত্যযাত্রার শেষ মুহূর্তগুলিতে ১৪ সেপ্টেম্বরের ধর্ষিতার নিস্পন্দ শরীর তখন 'ভিভিআইপি' মর্যাদার। তার শবযাত্রায় হাথরস জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম বুলগড়হি গ্রামে হাজির জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা পুলিস সুপারের মতো পদস্থ অফিসাররা। পুলিসরাই চিতা সাজালো। ধর্ষিতার ছিন্নভিন্ন শরীরটাকে চড়িয়ে দিলো চিতায়। মৃতা মেয়ের মুখটাও শেষবারের মতো দেখতে পেলো না। স্বেচ্ছাসেবীর ভূমিকায় মুখাগ্নির দায়িত্বও নিলো পুলিস। তবে পুলিস প্রশাসনের দাবি, পরিবারের মানুষের উপস্থিতিতেই সৎকার করা হয়েছে। মিডিয়ার ক্যামেরায় ধরা পড়েছে উল্টো ছবিটাই।




গোটা ঘটনা রহস্যের চাদরে ঢাকা। বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই গোটা গ্রামটা চলে গেছিল পুলিস ব্যূহে। এমনকি সাংবাদিকদেরও ঢোকা মানা। পুলিস প্রশাসনের অজুহাত, এসআইপি তদন্ত আর করোনার কারণেই এই সিদ্ধান্ত। এমনকি গোটা গ্রামটাকেই ঘোষনা করা হতে পারে কোয়ারেন্টিন জোন। তবে বুধবারের ঘটনার পর থেকেই যে প্রশ্ন বারেবারে উঠছে, এত গোপনীয়তা কেন? কী আড়াল করতে চাইছে পুলিস? ওদিকে পুলিসের কাছে একটাই জবাব- ওপরওয়ালার নির্দেশ। কিন্তু এই ওপরওয়ালাই বা কে, তার কোনও জবাব দিতে পারেনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হাই প্রোফাইল পুলিসকর্তারা।


মিডিয়ার খবরে ঘটনায় রাজনীতি ঢুকে পড়েছিল সফদরজং হসপিটাল চত্বরেই। কংগ্রেস, দলিতদের সংগঠন ভীম সেনা ঘটনার প্রতিবাদে আন্দোলনে নেমে পড়ে। বৃহস্পতিবার বুলগড়হির রাস্তায় রওনা দিলেন রাহুল, প্রিয়াঙ্কা। "রাহুল প্রিয়াঙ্কা হম তেরে সাথ হ্যায়"- শ্লোগান দিলো ভীম সেনা। কোমর কষলো উত্তরপ্রদেশ পুলিস। উত্তরপ্রদেশে ঢুকতে দেওয়া যাবে না রাহুল প্রিয়াঙ্কার কনভয়। জারি করা হলো একশো চুয়াল্লিশ ধারা। সীল করা হলো দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ সীমান্ত। শেষ পর্যন্ত নয়ডা হাইওয়েতে ধাক্কাধাক্কি, বাদবিবাদের পর যাত্রাভঙ্গ হলো রাহুল প্রিয়াঙ্কার। অসম্ভব জেনেও রাহুল একা পায়ে হেঁটে হাথরস যেতে চাইলেও পুলিস রাজি হয়নি। পুলিসের আশঙ্কা হাথরসে রাহুল প্রিয়াঙ্কা গেলে সেখানে উত্তেজনা তৈরি হতে পারে। ওদিকে সকালেই সাংবাদিকদের ডেকে যোগি সরকারকে একহাত নিয়েছেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী। ঘটনার প্রতিবাদে হাথরসের রাস্তায় দলবল নিয়ে নেমে পড়েছেন স্থানীয় কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, আপ নেতারা।




ঘটনা সামাল দিতে নড়েচড়ে বসেছে উত্তরপ্রদেশ সরকার। এসআইটি এক সপ্তাহের মধ্যে তদন্তের রিপোর্ট দেবে বলে জানিয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ যোগী। তাঁকে কড়া পদক্ষেপের নির্দেশ দিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। 

হাথরস ঘটনায় ইতিমধ্যেই জাতপাতের রং লেগেছে। ধর্ষকরা জাতের বিচার করে ধর্ষন করে, এমনটা বোধহয় না। অন্তত ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডের তথ্য সেরকমটাই বলে। গতবছর দেশে ধর্ষণের সংখ্যা ছিলো বত্রিশ হাজার তেত্রিশ। তারমধ্যে দলিত সম্প্রদায়ের মহিলা ছিলেন তিনহাজার পাঁচশো চব্বিশজন। শতকরার হিসেবে এগারো শতাংশ। তবে উত্তরপ্রদেশে ওই সংখ্যা আঠারো শতাংশ। 
দলিত ধর্ষনের ঘটনাকে উচ্চবর্ণ নিম্নবর্ণের সংঘাত বলার পেছনে কাজ করছে এক সূক্ষ্ম ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতি। ঘটনার সঙ্গে ব্রাহ্মণ্যবাদকে জড়ানোর মূল কারণ পদ্ম শিবিরকে উচ্চবর্ণের দল বলে আরও একবার চিহ্নিত করে দেওয়া। যার সুযোগ তুলতে তৎপর বিজেপি বিরোধী শিবির। অতীতে এই রাস্তাতে হেঁটেই মায়াবতীর মতো দলিত সম্প্রদায়ের মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষমতায় ফেরার রাস্তা প্রশস্ত হয়। সেই পুরনো হিসেব কষেই বিজেপি বিরোধী শিবিরগুলির রাস্তায় নামা।

দলিত সম্প্রদায়ের মেয়ে, মহিলারা যে কারণের জন্য ধর্ষিতা হয়, তার সমস্যা অনেক গভীরে। আর সেই সমস্যার শেকড় ওপড়াতে গেলে দরকার এক দারুণ সদিচ্ছা। তারচেয়ে অনেক সহজ ওই জাতপাতের সমীকরণ এনে ঘটনার মোড় ঘুড়িয়ে দেওয়া। রাজনীতিবিদরা বরাবরই তাই করে এসছেন। মায়াবতীও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না।
আসলে দুর্বলের ওপর অত্যাচার করাটা নিরাপদ। দুর্বল মানে শারীরিক দুর্বল না, সহায় সম্বলহীন হওয়া। তা সে যে কোনও জাত ধর্ম বর্ণের হোক না কেন। ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষক ধর্ষিতার জাতবিচার করা মানে ঘটনার ব্যাপকতা কমিয়ে দেওয়া। তাকে এক নির্দিষ্ট সমাজের সমস্যা বলে সিলমোহর দেগে দেওয়া। সম্প্রদায়ের আবেগে সুড়সুড়ি দিয়ে সামাজিক বিভাজনের এই রণকৌশলে ভোটব্যাঙ্ক তৈরি অনেক সহজ। সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি আবারও। 

তাই রাজস্থান ধর্ষণকাণ্ডে বিজেপি'র খোঁচা খেয়েও মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন রাহুল গাঁধি, প্রিয়াঙ্কা ভাদরা। অভিযোগ ওঠে গত ১৯ সেপ্টেম্বর অপহরণ করা হয় বারা জেলার দুই নাবালিকাকে। বন্দি বানিয়ে তিনদিন তাদের ওপর গণধর্ষণ চালানো হয়। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলোট অভিযোগ উড়িয়ে জানান, দুই নাবালিকাই নিজেদের মর্জিতে অভিযুক্তদের সঙ্গে গেছিলো। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দিতে তারা সেকথা স্বীকার করেছে। রাজ্য পুলিসের তরফেও গণধর্ষণের ঘটনা অস্বীকার করা হয়েছে।

এবারেও দাবি উঠেছে ধর্ষকদের ফাঁসি চাই। দাবি মানা হলে ভুক্তভোগী পরিবারের মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক, ঘটনার প্রতিশোধ নেওয়া গেল। অনেকের মত, প্রাণদন্ডের মতো চরম শাস্তির ভয়ে ধর্ষণের ঘটনা কমবে। কিন্তু বাস্তবে আদৌ কি তা হয়? মাত্র কয়েক মাস আগেই ২০ মার্চ, দিল্লির নির্ভয়াকাণ্ডের চার আসামীকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল। ধর্ষণের ঘটনা থেকে ধর্ষকদের ফাঁসি পর্যন্ত পৌঁছতে সময় লেগেছিল সাত বছর তিন মাস চার দিন।

ধর্ষণের পর পরিস্থিতি মোকাবিলায় যে ধরনের যুদ্ধকালীন তৎপরতা দেখায় পুলিস, সরকার, রাজনৈতিক দলগুলি, তা অবশ্যই নজর কাড়ে। কিন্তু সব সাময়িক। সরকার বনাম বিরোধী শিবিরের ঘাত প্রতিঘাত, সংঘাতের মধ্য দিয়েই ঘটনার শেষ হয়। তারপরেই রাজ্যের পিছিয়ে পড়া মানুষরা যে তিমিরে সেই তিমিরেই। যতদিন না আরও এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। রাজনীতির এই চিরাচরিত প্রথার কথা ধর্ষকরাও জানে। আর তাই ধর্ষণ বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা আপাতত চোখে পড়ে না।




মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন