দিন প্রতিদিন বিশেষ

 হাথরস বিশেষঃ সাংবাদিকদের ঢুকতে মানা  



                          ।। হাথরসের সেই অদৃশ্য 'ওপরওয়ালা' কে ।।


   কাজল ভট্টাচার্য , কলকাতা 

প্রশ্ন দুটোই।
এক, কী লুকোতে চাইছে উত্তরপ্রদেশ পুলিস? 

দুই, ওপরওয়ালা কে? তিনি ঠিক কত ওপরের? যার ফতোয়াতে হাথরসের গোটা বুলগড়হি গ্রামটাই কারাগারের চেহারা নিয়েছে। সাংবাদিকতো দূরের কথা, কাকপক্ষীরও ঢোকা মানা। অথচ যার নামটাও মুখে আনতে সাহস পাচ্ছেন না পুলিসকর্তা থেকে ম্যাজিস্ট্রেট স্তরের পদস্থরাও। তাদের মুখে একটাই কথা- ওপরওয়ালার আদেশ। কাউকে ঢুকতে দেওয়া যাবে মানা। 

হাথরস কন্যার মৃত্যুর পর শুরু হওয়া অবরোধ শেষ হলো শনিবার সকাল দশটা দশ নাগাদ। মিডিয়ার চাপের কাছে একরোখা জেদ ভাঙতে বাধ্য হলো উত্তরপ্রদেশ পুলিস প্রশাসন। গ্রামের রাস্তা খুলে দেওয়া হলো সাংবাদিকদের জন্য। হেঁটেই সাংবাদিকরা রওনা দিলেন মৃতার বাড়ির দিকে।

বুলগড়হি থেকে প্রায় ন'শো মিটার দূরে, যেখানে মূলরাস্তা থেকে নেমে গ্রামের রাস্তা শুরু সেই রাস্তায় পুলিসের ব্যারিকেড। শুক্রবার দুপুর নাগাদ সেখানে আচমকাই পৌঁছে গেলেন তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও'ব্রায়েন, সঙ্গে কাকলি ঘোষ দস্তিদার, প্রতিমা মণ্ডল আর মমতাবালা ঠাকুর। শুরু হলো কথা চালাচালি। একসময় তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও'ব্রায়েনকে দেখা গেল মাটিতে পড়ে যেতে। তবে শেষ পর্যন্ত তাঁকেও ফিরতে হলো ওই মোড় থেকেই।
ওদিকে চোরপুলিস খেলার মতো সাংবাদিকরা যে যার মতো ঘুরপথে পৌঁছনোর চেষ্টা করছে গ্রামে। কেউ খেতের আলপথ ধরে পায়ে হেঁটে পৌঁছে গেছিলেন গ্রামের সামনাসামনি। তারপরেই পড়ে গেলেন পুলিসের নজরে। সেখানেই যাত্রার ইতি। 



মিডিয়ার সাংবাদিক, ক্যামেরাপার্সনকে আটকাতে অনেক জায়গায় এগিয়ে এলেন সাধারণ পোশাকের কিছু মহিলা। সবার চোখ বাদ দিয়ে গোটা মুখটাই ঢাকা। শোনা গেল, তাঁরা সবাই ওই গ্রামের মহিলা। তাহলে তাঁরাও কি মিডিয়াকে গ্রামে ঢুকতে দিতে চান না, নাকি তাঁরাও 'ওপরওয়ালা'র চোখ রাঙানিতে পথে নেমেছেন? জবাব নেই।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে পড়ে নাজেহাল উর্দিধারীরা। মিডিয়াকর্মীরা বারবার জানতে চাইছেন,- "কেন আমাদের রাস্তা আটকানো হচ্ছে?" পুলিসকর্তারা কখনও বলছেন সিটের তদন্ত চলছে। তাই এখন ঢোকা যাবে না। আবার কখনও বলছেন কোভিড সংক্রমণের কথা। দোহাই একশো চুয়াল্লিশ ধারার। কোনও অজুহাতই যখন ধোপে টিঁকছে না, তখন ঘুরেফিরে সেই 'ওপরওয়ালা'র আদেশের গপ্পো। 
- "ওপরওয়ালা কে?"
এই প্রশ্ন শুনেই পদস্থ কর্তাদের কেউ আকাশের দিকে তাকিয়ে, আবার কেউ মাথা নীচু করে পাতালে সেই 'ওপরওয়ালা'কে খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন।

সাংবাদিকরা আদেশ দেখতে চাইলেই কখনও বাদ- বিবাদ, অথবা মুখে কুলুপ উর্দিবাহিনী থেকে ম্যাজিস্ট্রেটের। কনস্টেবল থেকে ইন্সপেক্টর, এমনকি ম্যাজিস্ট্রেটও মুখ ফুটে বলতে পারছেন না, আদেশটা কার। ওদিকে গ্রামে ঢুকতে নাছোড়বান্দা সাংবাদিকদের সঙ্গে তর্কাতর্কিতে মেজাজ হারিয়ে ফেলছেন তারাও। তাঁদের অবস্থা ওই শাঁখের করাতের মতো। একদিকে ওপরওয়ালার আতঙ্ক, অন্যদিকে মিডিয়ার চাপ।
ঘটনা যে এরকম দিকেই মোড় নিতে চলেছিলো তা বোঝা গেছিলো প্রথমদিনেই। নিউজ চ্যানেলের এক ভিডিওতে দেখা গেছিলো হাথরস জেলাশাসক প্রবীণ কুমারকে। তিনি মৃতার বাবাকে হুঁশিয়ারি দিচ্ছিলেন, মিডিয়াকে পাত্তা না দিতে। কারণ মিডিয়া এক- দু'দিনের মধ্যে কেটে পড়বে। তখন তাঁদের থাকতে হবে এই পুলিসের ভরসাতেই।

ওদিকে নানারকম সূত্র থেকে খবর জোগাড় করে সাংবাদিকরা জানাচ্ছেন, গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে মৃতার গোটা পরিবারকে। তাঁদের সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে, বাইরে কারুর সঙ্গে যেন যোগাযোগ না করা হয়। এমনকি মোবাইল কেড়ে নিয়েছে পুলিস। ঘরের বাইরে পা রাখাও মানা। মাঝেমধ্যেই ঘরে ঢুকে পড়ছে পুলিস। সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়লেই হুঁশিয়ারি। মৃতার পরিবারের একজন বুকে প্রবীণ কুমারের লাথি খেয়ে বেহুঁস হয়ে পড়েছিলেন বলেও খবর।




বুলগড়হি গ্রামের রাস্তা, প্রতিটা অলিগলিতে পুলিসে ছয়লাপ। গাছের ছায়াতে দলবেঁধে বসে উর্দিধারীরা। নিজেরা হাসছেন, কথাবার্তা বলছেন। কিন্তু চোখ ঘুরছে সবুজ ফসলের মাঠ পেরিয়ে আলপথে। সদাসতর্ক নজর। গলির মোড়ে কোনও বাড়ির ছায়ায় দাঁড়িয়ে দু'দন্ডের বিশ্রাম উর্দিধারীর। ইন্সপেক্টর বা উর্ধ্বতন কাউকে এসে পড়তে দেখলেই মুহূর্তে টানটান। কেউ আবার টহলদারিতে ব্যস্ত। মোটকথা গোটা গ্রাম জুড়ে যেন এক যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি। হাথরসের প্রত্যন্ত এক গ্রাম বুলগড়হিকে রাতারাতি 'বধ্যভূমি' বানিয়ে ফেলেছে উত্তরপ্রদেশ পুলিস।

সন্ত্রাসবাদী হানার সম্ভাবনা থাকলেও এক জায়গায় এতো পুলিস চোখে পড়ে না। পুলিসের সংখ্যা যতো বেশি সন্দেহও তত বেশি। যত বেশি নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা তত বেশি কৌতুহল। আর সেই সন্দেহ, কৌতুহলের মাত্রাকে আকাশছোঁয়া করে দিতে একশোভাগ সফল উত্তরপ্রদেশ পুলিস। সেই অদৃশ্য 'ওপরওয়ালা'র আদেশে দিনভর তাঁরা এতটাই সক্রিয় ছিলেন যে সন্দেহ, কৌতুহলকে, আশঙ্কা বানিয়েই ছাড়লেন। পুলিসের এই অতি সক্রিয়তাই যোগী বিরোধিতার তুরূপের তাস তুলে দিলো বিরোধী শিবিরের হাতে।

সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরা থেকে কী এমন রহস্য আড়াল করতে এত কড়া পুলিসপ্রহরা? এমন কী কথা থাকতে পারে মৃতার পরিবারের যা কোনভাবেই যেন বাইরে না আসতে পারে, তা সুনিশ্চিত করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে জেলা পুলিস প্রশাসনের কাছে? সারাদিন এই প্রশ্নটাই ঘুরপাক খেয়েছে দেশজুড়ে। বাল্মিকী সম্প্রদায়ের তরুনীর মৃতদেহ রাতারাতি নিজের হাতে পুড়িয়েও যা শেষ করা যায়নি। কিছু নিউজ চ্যানেলের সন্দেহ, জেলাশাসকের সম্মতি ছাড়া মৃতদেহের দায়সারা সৎকার সম্ভব ছিলো না। ওদিকে মৃতার পরিবারের ওপর দমননীতি, অত্যাচার চালানোরও বারংবার অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। জেলা শাসকের কীর্তি ধামাচাপা দিতেই গ্রামে সংবাদমাধ্যমের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পুলিসের মুখে বারবার যে 'ওপরওয়ালা'র কথা উঠে এসছে, তিনিও সম্ভবত ওই জেলা শাসক।

ওদিকে শুক্রবার রাতেই 'সিট'- এর প্রাথমিক রিপোর্টের সুপারিশে এক এসপি সমেত কমপক্ষে আরও পাঁচ পুলিসকর্মীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। আগামিতে ওই জেলা শাসকের ভূমিকা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী কোনও পদক্ষেপ করেন কিনা, এখন সেটাই দেখার। তবে সিদ্ধান্ত নিতে মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যেই অনেক দেরী করে ফেলেছেন বলে রাজ্য- রাজনীতির ওয়াকিবহাল মহলের মত। ওদিকে শুক্রবার সারাদিন গড়িয়ে শনিবার গভীর রাতেও সংবাদমাধ্যম কর্মীরা গ্রামে ঢোকার অপেক্ষা করলেও পুলিসের ভূমিকা বদলায়নি। 
গ্রাম থেকে রহস্যের থেকে পর্দা উঠলেও কি কোনদিনই জানা যাবে সবার অলক্ষ্যে থাকা সেই 'ওপরওয়ালা' ব্যক্তিটি কে? যিনি দশাননের মতো দশজোড়া চোখে নজর রেখে চলেছিলেন গোটা গ্রামের ওপর।





মন্তব্যসমূহ