দিন প্রতিদিন বিশেষ

 পুজোর নস্ট্যালজিয়া 

                                               ।। চুলের পুজোছাঁট ।।




  কাজল ভট্টাচার্য , কলকাতা 

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর চন্ডীপাঠ শেষ হলেই পুজোছাঁট।
"চল, চুলটুল কেটে ভদ্র হয়ে আসবি।" কাকুর ওই কথাটা শুনলেই মনে হতো ভদ্রজনের অভদ্র প্রস্তাব।
ঠাকুমার ভাষাটা ছিলো আরও খোঁচা মারা- মাথায় বাবুই পাখির বাসা। 
কী আর করা। তখন কেউ ওসব ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের এতো নাম্বার ধারাকে পুছতো না। পাত্তা দিতো না, সংবিধানের অতো নাম্বার উপচ্ছেদ, অনুচ্ছেদকেও। নাবালকদের পিটিয়ে শায়েস্তা করতে গার্জিয়ানদের সবাই 'এক সে বড়কর এক'। 
তখন স্কুলের শেষদিক। অনেক বেয়াড়া বন্ধুবান্ধব ছিলো। তাদের অনেকের বাপ কাকারা ছিলো আরও বেয়াড়া। বন্ধুদের দেখতাম চুলের মুঠি ধরে হিড়হিড় করে সেলুনে নিয়ে যেতে। সব পুজোছাঁটের হিড়িক। সময় সময় মনে হয়, এই অগণতান্ত্রিক কাকাদের জন্যই দেশটার এই হাল।

তবুতো আমাদের কপালে সেলুন জুটতো। আসলে অবশ্য একরকম ঘাড় ধরেই সেলুন জোটানো হতো। অনেকের আবার বাড়িতেই সেলুন আসতো। হাতে একটা ছোট্টকাঠের বাক্স ঝুলিয়ে হাজির নরসুন্দর। তখন সব বাড়িতে সোফা থাকুক না থাকুক, পিঁড়ি অবশ্যই থাকতো। আর তাও যদি না থাকতো আশপাশের রাস্তা থেকে খানদুয়েক লালইটের থান তুলে আনতে হতো। সেটাই সেলুনের চেয়ার। একটা ইট আর একটার উপর খাপে খাপ না বসলে, কাগজ বা কোনও পিজবোর্ড প্যাকেটের টুকরো গুঁজে ঠিকঠাক করে নেওয়া। চুল কাটার সময় মাথা ঘাড়ে খুর, কাঁচির কোপ পড়বে। তখন একটুও হেলডোল হলেই বিপদ।
দাদুর জমানায় আমারও চুল কাটা হতো ওই 'হোম ডেলিভারি সেলুনে'।



নরসুন্দর প্রথমেই যে জিনিসটা করতো, তার পুঁচকে বাক্স খুলে সাদা চাদর বার করে জোড়া থানইটের ওপর বসা মানুষটার গায়ে আচ্ছা সে জড়িয়ে দিত। হাতটাত সব ভেতরে গুটিয়ে। গোটা ব্যাপারটা অপারেশন টেবিলে শুইয়ে এনাস্থেসিয়া করার মতো। দুর্গন্ধে মাখামাখি কাপড়। কাপড়ের শরীরময় বিচিত্র সব ছোপ। তাতে অবশ্য আমার হোঁশ কোনদিনই ওড়েনি। বরং আমি ওই ছোপে মজার ছবি দেখতে পেতাম। চেষ্টা করতাম ছোপগুলি খোটাখুটি করতে। ধমক খেতাম নরসুন্দরের চোখে পড়লেই। 

চোখ তুলে তাকাতে গেলেই আর এক ধমক। চোখের ভাষায় নীরব প্রতিবাদ জানানোর স্বাধীনতাও হরণ করা হতো। তখন তার দুই হাঁটুর হাড়িকাঠে ঠেকানো আমার মাথা। সেখানেও আবার বাস আর এক দুর্গন্ধের। আর নরসুন্দরের অত মেজাজের কারণ, পাশেই চেয়ারে বসে দাদু। নজর রাখছে চুলের ছাঁটকাট নিয়ে। নরসুন্দর তখন দাদুর প্রতিনিধি। সুতরাং সেও ওই সুযোগটা কাজে লাগাতো। বাবুদের কাছে বকা খাওয়ার ঝালটা তুলতো বাবুদের পোলার ওপর। নাপিতের বুদ্ধি বলে কথা!
আর ওই যে আগেই বললাম, সে যুগে কেউ আইন- ফাইনের পাত্তা দিতো না। নাবালক মানেই পাবলিক প্রপার্টি। পাশের বাড়ির কাকাই না, ওপাড়ার জ্যেঠা, বেপাড়ার দাদুরা, যে যখন ইচ্ছে হলেই ধমক ধামক দিতে পারতো। অবাধ স্বাধীনতা শাসকদলের। কেউ কেউতো আবার তেড়ে আসতো। 

এরপরেই সেই চরম মুহূর্ত। জোড়া হাঁটুর ফাঁকে চুল কাটতে বসা মানুষটার মাথা গুঁজে দিতো। ঘাড়ের দিকে চলতো ক্লিপার। কুটকুট করে সব চুল সাফ। শুধু গোড়াগুলো কোনরকমে বেঁচে থাকতো। যেন সহস্র পিঁপড়ের কামড় একসঙ্গে। আর মধ্যেমধ্যেই টান লাগতো সেই ছোট্ট চুলের গোড়ায়। ব্যাপারটা যেন রামচিমটি কাটার মতো। আর ওদিকে যতবার নড়ে ওঠা, ততবার ধমকধামক। আর জোড়া হাঁটুর চাপ বাড়া। নিজেকে তখন মনে হতো নির্ভেজাল এক রামপাঠা। হাড়িকাঠে গোঁজা মাথা।

সবমিলিয়ে এক দুর্গন্ধময়, যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা। যেদিন সকালে চুল কাটতাম, সেদিনই মনে মনে ইটালির লোকগুলোকে গালি দিতাম। বেটারা এরকম থানইটের ওপর বসে চুল কাটে কেন? ওদের ইটালিয়ান সেলুন থেকে আমাদের ইন্ডিয়ান সেলুন অনেক ভালো। 
আরও একটা কথা মাথায় ঘুরতো। ওই বিচ্ছিরি নরসুন্দরের নাম রামধনু কে রেখেছিল? আর নামে নরসুন্দর হলে কী হবে, আমিতো কোনও নরসুন্দরের মধ্যে গত ষাট বছরে বিন্দুমাত্র সৌন্দর্য আবিষ্কার করতে পারিনি। ওই নাপিত নামটাই ঠিক।
বুদ্ধি যদি কারও থেকে থাকে, সে হলো সাহেবরা। ওদের মতে নরসুন্দর হলো 'বার্বার'। বর্বরের মতোই বদামির অভ্যাস, তাই 'বার্বার'।

'শর্মা সেলুন'- এ কাকু নিয়ে যেত চুল কাটাতে। আমার চুল কাটতো দোকানের মালিক অনিল শর্মা নিজে। কারণটা অনেক পরে বুঝতে পেরেছিলাম। অনিল মাঝবয়সী। দোকানের আর দুই কর্মচারী ছোকরা। তারা আমাকে একটু সমঝে চলতো। পাড়ায় তখন আমিও সময় সুযোগ পেলে আড্ডা মারতাম। বন্ধুবান্ধব জোগাড় হয়ে গেছিল। কিন্তু অনিল ওসবে পাত্তা দিতো না। তাই কাকু ঠিক যতটা ছোট করে চুল কাটতে বলতো, অনিল তারচেয়েও একটু বেশি ছোট ছাঁট মারতো। আমি আড়চোখে তাকে সাবধান করলেও, পাত্তা দিতো না। উল্টো আমার অপছন্দের চুল ছেঁটে আমার মাথার পেছনে আয়না ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করতো- দেখিয়ে কেয়সা হুয়া?

মুখ গোমড়া করে বাড়ি ফিরতাম। পুজোর আনন্দটাই যেন মাটি। এরকমই ছিলো সে যুগের কাকু, দাদুরা। চরম ফ্যাসিস্ট। হিটলারি তাদের রক্তে। কিছু অদ্ভুত ধারনা নিয়ে বাঁচতো তারা। এখন বুঝতে পারি, তাদের বিশ্বাস ছিলো ভাইপো, নাতি তাদের নিজের সম্পত্তি। তাদের ভালমন্দ সবের দায়িত্ব তাদের। ব্যক্তি মানেই কোনও 'ইনডিভিজুয়াল' না। তাই ভালবাসা, স্নেহর সঙ্গে এধরনের অত্যাচারগুলোও সহ্য করতে হতো। সবমিলেই এক পরিবার।

"দেখ, যেটা ভালো বোঝ!" এধরনের উদারবাদী গা- বাঁচানো দর্শনের মধ্যে ছিলো না সে যুগের কাকু, দাদুরা। কখনোই তারা ভাইপো, নাতির বন্ধু হয়ে নিজেদের একসারীতে নামিয়ে আনতো না। তাদের হিম্মত ছিলো ক্যাপ্টেন হওয়ার। ঝড়ঝঞ্জা থেকে নৌকোকে কূলে ভেড়ানোর দায়িত্ব নেওয়ার মতো ক্ষমতা ছিলো তাদের। অদ্ভুত এক আত্মবিশ্বাসে গোটা পরিবারকে বেঁধে রাখতো এক ছাতার তলায়। অনেকসময় পারতো, অনেকসময় পারতো না। তবু চেষ্টার কসুর ছিলো না। 

আজ সপ্তমী। চারদিকে হইচই। চুল বেড়ে কাঁধ ছুঁয়েছে। দাড়িতে মুখ ঢাকা। নিজেই অস্বস্তিতে ভুগি। সেলুনের জায়গা নিয়েছে পার্লার। তবু যেতে সাহস হয় না। করোনার ভয়। পুজোছাঁটের কথা, এখন আর কেউ বলার নেই।




মন্তব্যসমূহ