বিহার নির্বাচন বিশেষ
।। বিহার নির্বাচন: ঝুঁকি নিয়েই দাবার চাল চেলেছেন চিরাগ ।।
কাজল ভট্টাচার্য , কলকাতা, ১৫ অক্টোবর
সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর আবেগে ভোটের লড়াইয়ে অনেকটাই এগিয়ে যাওয়া যাবে বলে ভেবেছিলেন বিহারের 'সুশাসন বাবু' নীতিশ কুমার। সঙ্গে অমিত শাহ, নরেন্দ্র মোদি টিম। তাই নায়কের মৃত্যুতে নীতিশ কুমার সিবিআই তদন্ত দাবি করে বসার সঙ্গে সঙ্গেই সেই আবেদনে, মঞ্জুরের সীলমোহর দেগে দিয়েছিল মোদি সরকার। বাস্তবে ওই ঘটনার তলে তলেও কাজ করছিলো এক প্রতিদ্বন্দিতা। কার বিহারপ্রেম কতো বেশি? সুশান্ত মৃত্যুরহস্য উদ্ধারে সিবিআই তদন্তের দাবি আর মঞ্জুরি দিয়ে, একে অন্যকে টেক্কা দিতে চেয়েছিলো দুই দল।
'না ভুলে হ্যায় না ভুলনে দেঙ্গে!' পোস্টারে ছয়লাপ হয়ে গিয়েছিল রাজ্যের রাজধানী শহর পটনা। উদ্যোক্তা বিজেপির সাংস্কৃতিক মোর্চা। আসলে ২০১৫ এর অভিজ্ঞতা ভোলেনি পদ্ম শিবির। নীতিশের জনতা দল ইউনাইটেড থেকে অনেকটা পিছিয়েই ইনিংস শেষ করতে হয়েছিল টিম মোদি- শাহকে। জনতা দল ইউনাইটেডের হাতে এসছিলো ৭১টি আসন। সেখানে বিজেপি গুটিয়ে গিয়েছিলো মাত্র ৫৩ তেই। তাই এক জবরদস্ত ইস্যুর দরকার ছিলো পদ্ম শিবিরের। কিন্তু আপাতত যা পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, তাতে আর সুশান্তর মৃত্যু, সিবিআই তদন্ত নিয়ে আবেগের অস্তিত্ব আবিষ্কার করা যাচ্ছে না। বরং এখন নজর কাড়ছেন বিহার রাজ্য- রাজনীতির এক নয়া নায়ক চিরাগ পাসোয়ান। এবার আর বাবা রামবিলাস পাসোয়ানের ছাতার তলায় থেকে লড়াই নয়। গোটাটাই লড়তে হবে নিজের বুদ্ধি, বিবেচনা আর ক্ষমতায়।
"নীতিশ কুমারের পাশে দাঁড়িয়ে নির্বাচনী লড়াই চালানো সম্ভব না," কোনও রাখঢাক না করেই বলে দিয়েছেন চিরাগ। এবার তাই তিনি এনডিএ জোটছুট। তবে এই সিদ্ধান্তে আসার আগে গোটা ঘটনার কথাই তিনি অমিত শাহ, জেপি নড্ডাকে জানিয়েছিলেন বলে চিরাগের দাবি। তাঁরা দুজনেই শান্ত হয়ে চিরাগের কথা শুনলেও কোনও মন্তব্য করেননি। নিজের ক্ষমতায় নির্বাচন লড়তে তাঁর প্রয়াত পিতা রামবিলাস পাসোয়ানও উৎসাহ দিতেন বলে তিনি জানান। সুদর্শন চিরাগ পাসোয়ানকেও একসময় দেখা গেছিলো বলিউডের পর্দায়। "তবে যাই করি না কেন, টার্গেট ছিলো রাজনীতি।" এক সর্বভারতীয় হিন্দি চ্যানেলের সাপ্তাহিক অনুষ্ঠানে বাবা প্রয়াত রামবিলাস পাসোয়ানের পাশে বসে জানিয়ে দিয়েছিলেন চিরাগ।
কিন্তু কীসের জোরে 'একলা চলো'র সিদ্ধান্ত নিলেন চিরাগ? কারণ পাঁচবছর আগের বিহার বিধানসভা নির্বাচনে প্রয়াত রামবিলাস পাসোয়ানের লোক জনশক্তি পার্টিকে দেখা গেছিলো, কোনরকমে নিজের অস্তিত্বটুকু টিকিয়ে রাখার লড়াই লড়তে। মোট ৪২ আসনে প্রার্থী দিয়ে, দখলে এসেছিলো মাত্র দুটি। এবার অবশ্য চিরাগ জানিয়ে দিয়েছেন, জনতা দল ইউনাইটেডের সঙ্গে প্রতিটি আসনে লড়াই চালাবে তাঁর দল।
আসন দখলের লড়াইয়ে নিতীশের জনতা দল ইউনাইটেডের কাছে গতবার পাত্তাই পায়নি পাসোয়ানের লোক জনশক্তি পার্টি। কিন্তু এবার সেই সামান্য ক্ষমতা নিয়েই চিরাগের কারসাজিতে কপালের ভাঁজ চওড়া হলো সুশাসন বাবুর। এমনকি চিড় ধরতে বসেছিলো জনতা দল ইউনাইটেড, বিজেপির এতদিনের সখ্যতায়। ব্যাপারটা কী?
পাঁচবছর আগে নীতিশের সঙ্গী ছিলেন লালুপ্রসাদ যাদব, সোনিয়া গাঁধি। ওই ত্রয়ীর গ্র্যান্ড অ্যালায়েন্সে সেরা ছিলেন লালু। তাঁর রাষ্ট্রীয় জনতা দল কবজা করেছিলো ৮০টি আসন। ৭১ আসন পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছিল জনতা দল ইউনাইটেড। আর ২৭ আসন পেয়ে সবশেষে ছিলো কংগ্রেস। সেবারে বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ'র জোটসঙ্গী হয়েই নির্বাচনী লড়াইতে নেমেছিলো লোক জনশক্তি পার্টি। তখন বিজেপি জোটের বিরোধী শিবিরে ছিলেন নীতিশ। ক্ষমতা দখলের হিসেব কষতে সেকথা বিজেপি ভুলে মেরে দিলেও, লোক জনশক্তি পার্টি তা পারেনি। আর তার সর্বশেষ পরিনতি, এনডিএ ছেড়ে লোক জনশক্তি পার্টির 'একলা চলা'র সিদ্ধান্ত।
নীতিশ বিরোধিতায় সোচ্চার হলেও চিরাগ কিন্তু সরাসরি জানিয়েছে আজও সে পদ্ম শিবিরের পাশে। "নরেন্দ্র মোদির ছবির পাশে আমার ছবি টানিয়ে প্রচারের দরকার নেই," বলে দিয়েছেন চিরাগ। "কারণ মোদিজিই আমার রাজনৈতিক প্রেরণা।"
কাগজ কলমে বিজেপি জোট এনডিএ ছাড়ার পরেও, চিরাগের এই বিজেপি প্রীতিকেই সন্দেহের চোখে দেখছেন নীতিশ। যদিও নীতিশের এই সন্দেহ কাটাতে চেষ্টার কসুর করেনি বিজেপি। দলের তরফ থেকে চিরাগ পাসোয়ানকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে নির্বাচনী প্রচারে নরেন্দ্র মোদির নাম বা ছবি, কোনওটাই ব্যবহার করা চলবে না। অন্যদিকে ছকে ফেলা হয় মোদির সঙ্গে নীতিশের যৌথ প্রচার অভিযান। কোপ পড়ে চিরাগ ঘনিষ্ঠ স্থানীয় কিছু বিজেপি নেতার ওপরেও।
এরইমধ্যে প্রচার শুরু করে দিয়েছে লোক জনশক্তি পার্টি। জোরদার হয়েছে নীতিশ বিরোধিতার আওয়াজ। চিরাগ জানিয়েছেন এবার দলের ইস্যু 'বিহার প্রথম, বিহারীই প্রথম'। কোনও জাতপাতের লড়াইয়ে তিনি থাকছেন না। তবে দলিত, সামাজিক অনগ্রসর জনগোষ্ঠির মধ্যে আদৌ কি লোক জনশক্তি পার্টির নিজের ভোটব্যাঙ্ক আছে? গতবারের বিধানসভা নির্বাচনে অন্তত তেমন কোনও প্রমাণ মেলেনি। তবে রামবিলাস পাসোয়ানের মৃত্যুতে দলিত ভোটব্যাঙ্কে সহানুভূতির বাতাস লাগবে কিনা, তা হলপ করে এখনই বলা যায় না। কারণ কুর্মি, কুশওয়াহা সমেত অন্যান্য কিছু দলিত অনগ্রসর শ্রেণির মধ্যে নীতিশেরও ব্যাপক প্রভাব আছে। ওদিকে গতবারের সেরা লালুর রাষ্ট্রীয় জনতা দল শেষ পর্যন্ত কী খেলা দেখায় তাও দেখার।
বিহারের রাজ্য রাজনীতির ঘনিষ্ঠজনেরা অবশ্য গোটা ঘটনায় বিজেপির এক সূক্ষ্ম চাল রয়েছে বলে মনে করছেন। তাঁদের ধারনা, চিরাগকে সামনে রেখে নীতিশের ডানা ছাঁটার ছক কষেছে বিজেপি। সুশাসন বাবুর এক বিকল্প মুখ তৈরি করতে চাইছে পদ্ম শিবির। তবে বিহার রাজনীতিতে রামবিলাস- পুত্র ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবেন তা নির্ভর করছে আসন দখলের অঙ্কে। পর্যাপ্ত সংখ্যার আসন জিততে পারলে সরকার তৈরিতে 'এক্স ফ্যাক্টর' হয়ে দেখা দিতে পারে চিরাগ পাসোয়ানের লোক জনশক্তি পার্টি।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন