দিন প্রতিদিন বিশেষ

 অতিমারীর আবহে পুজো বিশেষ 



 করোনাসুরবধ অভিযানে নামার আগে বাঙালির 'লাস্টটাচ' 



কাজল ভট্টাচার্য , কলকাতা 

অগ্নিযুগের বাঙালি।
"..লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার..।"
সব লঙ্ঘিয়ে মৃন্ময়ী মাতৃদর্শনের জন্য প্রস্তুত সেই বাঙালি। মা অন্ত প্রাণ। রক্তমাংসের মা বৃদ্ধাশ্রমে বন্দি। মৃন্ময়ী মা আসছেন। সেই মাতৃদর্শনে বাঙালিকে রোখে কার সাধ্য? বছর ঘুরলেই ভোট আছে না! তখন দেবে টাইট দিয়ে।

পুজোর জামাকাপড় জুতোমোজা সব কিনেছেন তো? তাহলে এবার অন্তত একটা বই কিনে ফেলুন। এখন আর কেউ বই- ঠই পড়ে নাকি? 'গুগল'দাইতো আছে। সর্বসমস্যার মুশকিল আসান। এখন বই কেনা মানে ফালতু খরচ।
আরে মশাই পুজোবাজারে একটু আধটু নাহয় ফালতু খরচ করলেন। বাস ট্রাম মেট্রোতো আছেই। আবদারে গিন্নীকে নিয়ে একটা ক্যাবে চড়েই পুজোবাজার করতে গিয়ে দেখুন, নিজেকে বেশ বাদশা টাইপের কিছু একটা মনে হবে। একটু নাহয় হলো ফালতু খরচ। ঠিক সেরকমই ওই বইটা কিনে আর একটা ফালতু খরচ করে ফেলুন। প্লিজ। চটি বই।
লেখকও জানতেন, ঢাউস বই পড়া আধুনিক বাঙালির কম্ম নয়। বাঙালির সংস্কৃতি জ্ঞানগম্যি আর সেকুলারিজমতো উপচে পড়ে। তাই তিনি ওরকম খানকয়েক চটি বইও লিখে রেখে গেছিলেন। সেই চটি দামেও সস্তা। একটা কিনেই ফেলুন। পুজো সংখ্যার বই আর গানের রেকর্ড কেনাতো একসময় রেওয়াজ ছিলো বাঙালির। তারপর ভিড়বাজারে না হয় ফের বাজার করতে লেগে যান।


না, শুধু ওই জুতোর দোকানে উপচে পড়া ভিড়ের দিকে আঙুল তুলি কেন? মলগুলির ভিড়ভাট্টাতেই পরিষ্কার, বেশ জমে উঠেছে পুজোবাজার। শুনশান গড়িয়াহাট মোড় আমারও দেখতে ভালো লাগতো না। বিশ্বাস করুন, মা দুগ্গার দিব্যি। তা এখন সেখানেও অনেকটাই জৌলুস ফিরেছে। জুতো কেনার হিড়িকের ছবিতো সোশাল মিডিয়ায় অনেকেই পোস্ট করেছেন। গিজগিজ করছে মাথা। বড় বুড়ো সাদাচুল কালোচুল সব একাকার। অনেক মা বাবাই হাত ধরে নিয়ে গেছেন ছেলেপুলেদের। এদিকে স্কুল বন্ধ, চলছে অনলাইন ক্লাস।
- "আরে ছাড়ুন মশাই। স্কুল ক্লাস পরীক্ষাতো সারাবছর ধরে, একটার পর আর একটা আছেই। পুজোতো বছরে একবার।"
আমি বলি কী একবার না, শেষবার কিনা সেটাই ভেবে দেখুন।
অনেক বিজ্ঞজনই আবার সরাসরি আঙুল তুলেছেন নবান্নের দিকে। ভাবখানা এমন, নবান্ন বলেছে বলেই বাঙালি জুতোর দোকানে একে অন্যকে পাশ কাটিয়ে ঢুকে পড়ছেন। ভিড় জমাচ্ছেন মলে। নবান্ন একবার না করলেই হতো। তাহলেই যেন সব ধেড়ে বাঙালি লক্ষ্মীছানার মতো সোনামুখ করে ঘরে বসে থাকতো। তা মশাই সোশাল ডিসটেন্সিং, মুখে মাস্কের কথা পইপই করে বলতে বলতেতো নবান্নর মুখে থুতু উঠে গেলো! "ভিড় এড়িয়ে চলুন," সহস্রবার বলেছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী।

"এবছরটা একটু সামলে সুমলে উৎসব যাপন করুন।" হাতজোড় করে বলেছিলেন কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন।
এইতো গত মাসের কথা। সেপ্টেম্বরের এক তারিখেই ছিলো কেরলের দুর্গাপূজা- ওনাম। অনেকটা আমাদের নবান্ন উৎসবের মতো। পাকা ফসল ঘরে তোলার উৎসব। আঠাশ পদ রান্নার রীতি। উৎসব বলে কথা। বছরে একবার।
একেবারে লাঠিহাতে 'না' বলে দিলেই বিপদ। সংবিধানে দেশের প্রতিটি নাগরিককে স্বাধীন ধর্মচর্চার অধিকার দেওয়া আছে। আর সেই স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু করোনাকালে ওই দায়িত্ব হরণ করা যাবে কিনা বলা নেই। আর এখনতো আবার বলা নেই কওয়া নেই, একটা জনস্বার্থ মামলা ঠুকে দিতে কতক্ষণ? মামলা ঠুকবেন কাছারিতে, রায় দেবেন ইডিয়ট বক্সের বিশেষজ্ঞরা।

রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন পইপই করে সাবধান করেছিলেন- বেশি ভিড়ভাড়ে যাবেন না। উৎসবের জোয়ারে এবারটা অন্তত ভাসবেন না। যে যার ঘরে থেকেই উৎসবে মাতুন। পরিবারের লোকজন আছেই তো! আসছে বছর আবার হবে। তখন না হয় কড়ায় গণ্ডায় বাদবাকীটা পুষিয়ে নেবেন।
কে শোনে কার কথা?

রামভক্ত হনুমানও বোধহয় অতো বড়ো লাফ মারতে পারেননি। ওনামের আতিশয্যে ঠিক সেরকমই একটা অলিম্পিক লেভেলের লাফ মেরেছিলো কোভিড- ১৯। দেখতে না দেখতেই ছিলো একশো, হয়ে গেলো দুশো ছাব্বিশ পজিটিভ পেশেন্টের সংখ্যা। ওনাম উৎসবের পরেই একলাফে করোনা পজিটিভ রোগির সংখ্যা বেড়ে গেলো একশো ছাব্বিশ শতাংশ। তাও কেরলের মতো রাজ্যে।



ওসব গপ্পো শুনিয়ে বাঙালিকে ভয় পাওয়ানো যাবে না। খানদানি শিক্ষিত জাত। একশোজনের মধ্যে ৮০.৫ জনই শিক্ষিত। আর ওসব তথ্য- ঠথ্য দিয়ে কী হবে? শিক্ষার প্রশ্নে ভারতের সেরা কেরল হলেই বা বাঙালির কী আসে যায়? প্রতি একশোজনের মধ্যে ৯৬.২ জন শিক্ষিত বলে কি বাঙালির মাথা কিনে নিয়েছে? অনেক দেখা আছে মশাই ওসব ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল অফিসের হিসাব কিতাব।
কে বলবে কত দুধে কত জল?
কোভিড সংক্রমণে সেরা অন্ধ্রপ্রদেশ। তারপরেই কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র। করোনা সংক্রমণে চার নাম্বারে চলে এলো, দেশের এক নাম্বার শিক্ষিত রাজ্য কেরল।
সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে হাতের বাইরে পরিস্থিতি। বেড়ে গেলো মৃত্যু। ফসল তোলার উৎসব হয়ে গেলো পটল তোলার উৎসব।

কেরলেই বাংলার ভবিষ্যদ্বাণী লেখা হয়ে গেছিলো নাকি? কে জানে সময় বলবে।
তবে পুজো বন্ধ হলে তা নিয়ে যে রাজনীতি হতো না, এমন কথা হলপ করে বলা যায় না। কারণ দুর্গাপূজা নিয়ে বাঙালির এক আলাদা আবেগ আছে। সেই পুজো নিষিদ্ধ করা চাট্টিখানি কথা না। তারপর বাঙালির সেই আবেগকে কেউ উসকে দিলে ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়াতো হিতে বিপরীত।
তবে এরমধ্যেই হিম্মত দেখিয়েছে সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের পূজা কমিটি। পুজো হবে। তবে দর্শক নিষিদ্ধ। ম্যাডক্সে স্কোয়ারে বন্ধ আড্ডা।





কোনও সরকারই অতটা বেপরোয়া হতে পারে না। কেরল সরকারও পারেনি। বাংলায় আবার পরের বছরেই নির্বাচন। আসলে শাসক দলের অবস্থাটা দাঁড়ায় শাঁখের করাতের নীচে গলা পেতেও, মুণ্ডুকে অক্ষত রাখা। পুজোতে 'হ্যাঁ' করেও মুশকিল। 'না' করলেও মুশকিল। কোন মুশকিল বড়? বড় কঠিন সে হিসাব।

তবে পুজোবাজারের যে ছবিটা ধরা পড়ছে তাতেই স্পষ্ট পুজোর দিনগুলিতে ঠিক কী হতে চলেছে। কোনও শাসক বা বিরোধী দলই আমাদের ঘাড় ধরে গড়িয়াহাট, নিউ মার্কেটে পাঠায়নি। আর কয়েকদিন পরেই আমরা দলবেঁধে যাব মাতৃদর্শনে। আসলে সব জায়গাতেই যাই আমরা নিজের দায়িত্বে। রাজ্যে সংক্রমণের ছবিটাও সরকার লুকিয়ে রাখেনি। ইতিমধ্যেই বাড়তে শুরু করেছে করোনা সংক্রমণ। ওটা ঠিক কতদূর বাড়বে তা নির্ভর করছে বেপরোয়া বাঙালির ওপরে।
আবেগ আর যুক্তির সংঘাত। যুক্তি জিতলে এবারের দুর্গাপূজা মাটি। আসছে বছর আবার হবে। আবেগ জিতলে গ্যারান্টি থাকবে না আসছে বছরের। এবছরই শেষ হলেও হতে পারে।

বাজারের ভিড়ে স্পষ্ট ইঙ্গিত, আবেগে ভাসছে বাংলা। যুক্তি তর্ককে একেবারে মাটিতে ফেলে দুরমুশ করে ফেলেছে সাহসী বাঙালি। তবে ওই পুজোবাজার শেষে যে বইটা কেনার কথা বলছিলাম, সেটা 'প্লিজ' এক কপি কিনবেন। তাহলে আপনার নিজেকে, আশপাশের ওই ফর্সা, কালো, বাদামি, হাসিমুখ গোমড়ামুখ অগ্নিযুগের উত্তরাধিকারী নব্য বাঙালিকে চিনতে সুবিধা হবে। এক বাঙালির চোখ দিয়ে দেখা অন্য বাঙালিকে। যিনি দেখেছিলেন তাঁর নাম নীরদ সি চৌধুরী। আর তাঁর চোখ দিয়ে বাঙালিকে দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে যে বইটা লিখে ফেলেছিলেন, তার নাম



"আত্মঘাতী বাঙালি"।

( ছবি সৌজন্যঃ বিভিন্ন সংবাদপত্র প্রকাশিত ছবি) 

মন্তব্যসমূহ