দিন প্রতিদিন বিশেষ

 কাশ্মীর বিশেষ 


   ।। গুপকার প্রস্তাবে ফিরলো কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা ফেরানোর দাবি ।।

            


কাজল ভট্টাচার্য , কলকাতা 

এবার ড্রাগনের পিঠে চেপে ফিরবে জম্মু কাশ্মীরের হৃত মর্যাদা। 
সেই আশাতেই দিন গুনছেন জম্মু কাশ্মীরের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লা। শুধু দিন গোনাই না, সেই দিনটাকে এগিয়ে আনতে ফারুক পাশে পেয়ে গেছেন রাজ্যের আর এক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতিকেও। এই ঘটনা ফারুককে এতটাই উৎসাহী করেছে যে ইতিমধ্যেই তিনি সতর্কবাণী উচ্চারণ করে স্পষ্টাস্পষ্টি জানিয়ে দিয়েছেন- জম্মু কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা উঠিয়ে দেওয়াকে মেনে নেয়নি চিন। তারা(চিন) বলেছিল, যতদিন না ফের ওই ধারা লাগু হয়, ততদিন থামবে না। এই ইস্যু এখন সর্বজনীন। তাদের(চিনের) মদতেই ৩৭০ ধারা পুনরুদ্ধার হবে।

আসলে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদার জিগির তুলে মুফতি, আবদুল্লা পিতাপুত্র দু'পক্ষই পুনরুদ্ধার করতে চাইছেন তাঁদের বংশানুক্রমিক ক্ষমতার গদি। ওই গদির লোভেই ২০১৯ সালের ৪ অগাস্ট পর্যন্ত তাঁরা খেয়োখেয়ি করে এসছেন। মোদি সরকার আচমকাই সেই গদির পাট তুলে দেওয়ায়, এক ঢিলেই কাত হয়েছিলেন দুই পক্ষ- মেহবুবা মুফতি, আবদুল্লা পিতাপুত্র। 

অগত্যা চটজলদি বিবৃতি দিয়ে মুফতির থেকে নিজেকে কয়েক কদম এগিয়ে রাখতে চেষ্টা করলেন ফারুক আবদুল্লা। এমনিতেও বিতর্কিত কথাবার্তা বলে প্রচারের আলোতে থাকাই তাঁর স্বভাব। এর আগেও পাক অধিকৃত কাশ্মীরকে তিনি ভারতের অংশ বলতে মানতে চাননি। এবারেও তিনি সেই পুরনো রাস্তাতেই হাঁটলেন। গত ২৩ সেপ্টেম্বর সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশন শেষ হতেই তিনি বলে বসলেন, "জম্মু কাশ্মীরের মানুষরা আজ ভারতীয় থাকতে চান না। আজ তাঁরা ক্রিতদাস। চিনের শাসনে থাকাই তাঁরা পছন্দ করবেন।" 
আচমকাই এই বাক্যবোমা বিস্ফোরণের কারণটা বোঝা গেল ঠিক তার পরের কথাতেই। ফারুকের অভিযোগ, তাঁকে অন্ধকারে রেখেই কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার চক্রান্ত করেছিল মোদি সরকার। তারজন্যই দিল্লির চেয়ে বেজিংকেই এগিয়ে রাখলেন ফারুক।

মেহবুবা মুফতিই বা কম যান কিসে? নজরবন্দির রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত হয়েই তিনি গর্জে উঠলেন- 'দিনে ডাকাতি' করেছে মোদি সরকার। গভীর রাতের ওই ভিডিও টুইটবার্তায় এরপরেই তিনি সবাইকে ডাক দেন লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে। যে কোনও মূল্যে জম্মু কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা ফিরিয়ে আনতেই হবে। 

ফারুকের কথায় সরাসরি জাতীয়তা বিরোধী আঁচ পেয়েই তেড়ে আসে বিজেপি। ফারুকও রণেভঙ্গ দেওয়ার পাত্র না। এবার তিনি সরাসরি খোঁচা মেরে বসলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে। "আমি চিনের প্রেসিডেন্টকে এখানে ডেকে আনিনি," বললেন ফারুক। "আমাদের প্রধানমন্ত্রীই তাঁকে নেমন্তন্ন করে গুজরাতে নিয়ে গিয়ে দোলনায় দুলেছিলেন। তাঁকে চেন্নাই ঘোরাতে নিয়ে গেছিলেন। একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করেছিলেন।" এরপরেই দ্বিধাহীন স্বরে ফারুক জানিয়ে দেন, শি জিনপিং ওতে মোটেই সন্তুষ্ট হননি। জম্মু কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা উঠিয়ে দেওয়াকে তিনি সুনজরে দেখেননি।

যে অশান্তি এড়াতে ফারুক, মুফতির মতো কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদার পক্ষধারী নেতাদের সক্রিয়তায় লাগাম পড়িয়ে মোদি সরকার জম্মু কাশ্মীরের শান্তিরক্ষা করতে চেয়েছিল, সেই লাগাম শিথিল হতেই ফের অশান্তির স্পষ্ট সঙ্কেত দিলো 'গুপকার প্রস্তাব'। পুরনো শত্রুতা শিকেয় তুলে, আপাতত তাঁদের পাখির চোখ দিল্লি। 
কাশ্মীরের স্বার্থরক্ষা করতে পারিবারিক পুরনো বিবাদকে কবরে পাঠিয়ে মুফতি, আবদুল্লা পরিবার পাশাপাশি দাঁড়াবে, সংসদের বাদল অধিবেশন শেষ হওয়ার পর দিল্লিতে বসেই জানিয়ে দিয়ে এসেছিলেন ফারুক। এরপর কাশ্মীরে ফিরেই তাঁদের আগামী রণকৌশল নিয়ে শলা- পরামর্শ করতে বসেন ফারুক আবদুল্লা, মেহবুবা মুফতি। ওই বৈঠকে যোগ দেওয়ার কথা ছিলো ফারুকের ন্যাশনাল কনফারেন্স, মুফতির পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি- সহ আরও পাঁচ দলের স্থানীয় নেতারা। তবে শরীর খারাপের কারণ দেখিয়ে জম্মু কাশ্মীরের প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি গুলাম আহমদ মীর ওই বৈঠক এড়িয়ে যান।

গত বৃহস্পতিবারের ওই বৈঠকের পর প্রকাশ্যে আনা হয় 'গুপকার প্রস্তাব'। এবার অবশ্য ওই প্রস্তাবের নাম- পিপলস অ্যালায়েন্স ফর গুপকার ডিক্লেরেশন'। প্রস্তাবে দাবি করা হয়েছে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার। সেই সঙ্গে দাবি জানানো হলো রাজনৈতিক বন্দি মুক্তির। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আবার বৈঠক ডাকা হবে বলে জানিয়েছেন ফারুক।

এর আগেও অবশ্য 'গুপকার ডিক্লারেশন' প্রকাশ হয়েছিল।
জম্মু কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা ওঠানোর ঠিক একদিন আগে ৪ অগাস্ট জম্মু কাশ্মীরের বেশ কয়েকজন স্থানীয় নেতা শ্রীনগরের গুপকার রোডে ফারুকের বাড়িতে শলা পরামর্শে বসেছিলেন। আলাপ আলোচনার পর জারি করা হয়েছিল এক যৌথ প্রতিবেদন। জানানো হয়েছিল, জম্মু কাশ্মীরের পরিচিতি, স্বায়ত্ত্ব, বিশেষ মর্যাদার ওপর কোনও আঘাত লাগতে দেওয়া হবে না।


কাশ্মীরের স্থানীয় নেতাদের মারমুখী মনোভাব মোকাবিলা করতেই, আঁটঘাট বেঁধে ৩৭০ ধারা অবলুপ্তির পথে হেঁটেছিল মোদি সরকার। রাজ্যের শান্তিশৃঙ্খলা সুনিশ্চিত করতে, নিজেদের বাড়িতেই নজরবন্দি করা হয় আবদুল্লা, মুফতির মতো নেতাদের। নাগাড়ে ১৪ মাস সেই বন্দিদশা থাকার পর,গত মঙ্গলবার রাতেই মুক্তি পান মেহবুবা মুফতি। তার কয়েক মাস আগেই মুক্তি পেয়েছিলেন ফারুক এবং ওমর আবদুল্লা। তারপর থেকেই পিতা পুত্র টুইটে বারবার আবেদন জানিয়ে চলেছিলেন মেহবুবা মুফতির মুক্তির জন্য। গত মঙ্গলবার মুফতি মুক্তি পেতেই বুধবার তাঁর বাড়িতে ছুটে যান সপুত্র ফারুক। আমন্ত্রণ জানিয়ে আসেন পরদিনের বৈঠকে যোগ দিতে। আগামিদিনে বিরোধিতা কোন পথে এগোবে তার ছক কষতেই বৃহস্পতিবারের ওই বৈঠক বলে মনে করছে রাজ্যের রাজনৈতিক মহল।


চিনের মদতে জম্মু কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা পুনরুদ্ধারে ফারুকের মন্তব্যের নিন্দা করেন রাজ্যের প্রাক্তন রাজ্যপাল এবং প্রবীণ কংগ্রেস নেতা করণ সিং। তিনি বলেন, 'ফারুক আবদুল্লার হতাশার কারণ বুঝতে পারি। তাঁর নজরবন্দি থাকা নিয়ে সমর্থকদের এক আলাদা আবেগ কাজ করে। কিন্তু তাঁর এধরনের বক্তব্য কাশ্মীরকে ফের অশান্ত করে তুলবে।"

সংসদের গত বর্ষাকালীন অধিবেশন শেষ হতেই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন ফারুক। কড়া সমালোচনা করেন
লোকসভা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধেও। তিনি জানান, অধ্যক্ষ তাঁকে সময় দেওয়ার কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কথার খেলাপ করাতেই, অধিবেশন চলার সময় রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা ছিনিয়ে নেওয়া নিয়ে রাজ্যবাসীর ক্ষোভের কথা সংসদে ওঠাতে পারেননি। 

ওদিকে বসে নেই মুফতিও। নজরবন্দি থেকে মুক্তি পাওয়ার কয়েকঘণ্টার মধ্যেই টুইটে সক্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। মঙ্গলবার গভীর রাতের এক অডিও টুইটবার্তায় তিনি জানান- "কোনরকম আইন, সংবিধান, গণতান্ত্রিক রীতিনীতির তোয়াক্কা না করেই, গত ৫ অগাস্ট আমাদের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে আমাদের হাজারো মানুষ জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। এবার আমাদের সক্রিয় হতেই হবে,"।

গোটা কাজটাই বেশ কঠিন বলে মনে করেন পিডিপি সভাপতি মেহবুবা মুফতি। তবে তাঁর বিশ্বাস, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে লড়াই চালালে লক্ষ্যে পৌঁছনো যাবেই। এই লক্ষ্যে পৌঁছনোর লড়াইটা কতটা শান্তির রাস্তায় এগোয়, এখন সেটাই দেখার। তবে রাজ্য রাজনীতির ঘনিষ্ঠজনরা আশঙ্কা করছেন, ফারুক, ওমর, মুফতির ইন্ধনে কাশ্মীর ফের উত্তাল হতে পারে।




 

মন্তব্যসমূহ