দিন প্রতিদিন বিশেষ

রাজনীতির ঘোলাজলে হাথরস   


।। রাজনীতির আড়ালে দাঙ্গার ছক হাথরসে ।।




   কাজল ভট্টাচার্য , কলকাতা

'জাস্টিস ফর হাথরস'।
রাতারাতিই তৈরি হয়ে গেছিল ওয়েবসাইট। এই জাস্টিসের স্বরূপটা কী? প্রশ্নের জবাবটাও ছিলো সেই ওয়েবসাইটে- মাস্ক পহনো অউর আগ লগাও। মাস্ক পরুন আর আগুন লাগান। আগুন লাগানোর সঙ্গে মৃত হাথরস কন্যার যোগাযোগটা কোথায়, কীভাবে, তা বোঝা মুশকিল। তবে ইঙ্গিতটা পরিষ্কার। 
উত্তরপ্রদেশ মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের কথায়, ওই আগুন দাঙ্গার। বিরোধীরা চেয়েছিলো, গোটা দেশে ওই আগুন ছড়িয়ে দিতে। এই বিস্ফোরক মন্তব্যটি করলেও যে কথাটি মুখ্যমন্ত্রী এড়িয়ে গেছিলেন তা হলো, পুলিস প্রশাসনের বেপরোয়া পদক্ষেপেই ঝামেলার সূত্রপাত। মৃতার পরিবারের ক্ষোভ মূলধন করেই ময়দানে নেমে পড়েন বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের নেতারা। আর ওই রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থার ফায়দা তুলতেই সক্রিয় হয়ে ওঠে দাঙ্গাবাজরাও। 



গত রবিবারই বিরোধী শিবিরের দিকে আঙুল তুলেছিলেন যোগী আদিত্যনাথ। কোনও রাখঢাক না করে তিনি বলেন, "হাথরস কাণ্ডের অজুহাতে সুপরিকল্পিত দাঙ্গা হাঙ্গামা বাঁধানোর চক্রান্ত চলেছিলো।" যোগীর ওই বক্তব্যের প্রতিধ্বনি শোনা গেছে মৃতার গ্রামের মানুষের কথাতেও। জাতপাত নির্বিশেষে গ্রামবাসীরা মিডিয়ার ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে সাফকথায় জানিয়েছেন, ঝামেলা পাকাচ্ছেন নেতারা। গ্রামে ঢুকে উত্তেজনা ছড়াচ্ছে বহিরাগতরা। চেষ্টা চলছে জাতপাতের জিগির তুলে বিভাজনের।




ঘটনায় পরিষ্কার রাজনীতির আড়ালেই চক্রান্ত চলছিলো জাতিদাঙ্গা বাঁধানোর। সেই চক্রান্ত নিয়ে এখনও যতটুকু জানা গেছে, তা খুবই অল্প। হিমশৈলের চূড়ামাত্র। কারণ সন্দেহজনক ওয়েবসাইটটি যেমন রাতারাতি কাজ শুরু করেছিল, বন্ধও হয়ে যায় তেমনি আচমকাই। 
তাহলে কি ওই ওয়েবসাইট পুলিসের নজরে আসার কথা জানতে পেরে গেছিলো ষড়যন্ত্রকারীরা? কিন্তু সেটাই বা সম্ভব হলো কী করে? এই পরিস্থিতির মধ্যেই সরকারের কপালের ভাঁজ আরও গভীর করে তুললো রাজ্যের সুরক্ষা এজেন্সির সতর্কবাণী।
তবে এপর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে তাতেই পরিষ্কার, এক ব্যাপক ষড়যন্ত্রের ছক কষা হয়েছিল। ঘটনার মূল চক্রী হিসেবে নাম উঠে এসেছে পিএফআই আর এসডিএফআই- এর। 

সন্দেহে ঘেরা ওই ওয়েবসাইট খোলা না গেলেও আইটি সেল সূত্রে তার কন্টেন্টস সম্পর্কে কিছু জরুরি তথ্য হাতে এসছে। ক্ষোভ উসকে দিতে ওই সাইটে ডাক দেওয়া হয়েছিলো- 'মাস্ক পহনো অউর আগ লগাও'। এর জেহাদে নামার আগে দশ দফা প্রস্তুতির পরামর্শও দেওয়া হয়েছিলো ওই ওয়েবসাইটে। তাতে জানানো হয়েছিলো 'জাস্টিস ফর হাথরস' আন্দোলনে যাঁরা সামিল হতে চান, তাঁদের কী 'করণীয়' আর কী 'নিষিদ্ধ'। পোশাক- আশাক থেকে সাজসজ্জা সবকিছু নিয়েই দেওয়া হয়েছিল জরুরি নির্দেশ। দাঙ্গার জন্য জায়গা নির্বাচন থেকে পুলিসের হাতে ধরা পড়লে কীভাবে তার মোকাবিলা করতে হবে, সাবধান করা হয়েছিলো তা নিয়েও। 

খবরে জানানো হয় ওই ওয়েবসাইট মারফত টাকা তোলা, 'ফান্ডিং'- এর কাজও শুরু হয়েছিল। বিদেশ থেকেও টাকা জমা পড়ে। ভূঁয়ো পরিচয়ে অনেকেই সেই সাইটের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল বলেই সন্দেহ। গোটা ব্যাপার খতিয়ে দেখতে ইতিমধ্যেই তদন্তে নেমে পড়েছে ইডি। ওদিকে ইতিমধ্যেই গ্রেপ্তার হয়েছে চারজন। সন্দেহ করা হচ্ছে এরাই দাঙ্গাবাজদের পান্ডা। দিল্লি থেকে হাথরস যাওয়ার রাস্তায় মথুরা টোল প্লাজায় ওই চারজন পুলিসের জালে ধরা পড়ে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে ল্যাপটপ সমেত বেশকিছু কাগজপত্র যা উত্তেজনা ছড়ানোর কাজে লাগতো। 
ওদিকে হাথরসে উত্তেজনা ছড়ানোর জন্য পুলিসের নজর পড়েছে দীপক শর্মা নামের এক ব্যক্তির ওপর। 'আপ' দলের সাংসদ সঞ্জয় সিং হাথরসে মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলার সময় আচমকাই তার ওপর কালি ছেটায় দীপক। শ্লোগান শোনা যায়- পিএফআই দালাল ফেরত যাও। এরপরেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। দীপক নিজের পরিচয় দেয় 'রাষ্ট্রীয় স্বাভিমান দল'- এর সদস্য বলে। এর আগেও একাধিক ঘটনায় উত্তেজনা ছড়ানোর অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। হাথরস ঘটনায় দীপকের ভূমিকা খতিয়ে দেখছে পুলিস।



এদিকে তদন্তকারী দলের বক্তব্য, ষড়যন্ত্রীরা পরিকল্পনা বদলেছে। যার ফলে দাঙ্গার চক্রান্তের সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে গেছে রাজনীতি। সেই পরিকল্পনামাফিক ধর্মর বদলে এবার চেষ্টা জাতিদাঙ্গার। যার সরাসরি প্রভাব পড়বে রাজনীতিতে। প্রসঙ্গত উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে নির্বাচনের ফলাফলে ব্যাপক প্রভাব পড়ে ধর্ম জাতি বর্ণ বিভাজনের ঘটনায়। অতীতে অনেকেই আঞ্চলিক রাজনীতির ওই রাস্তায় হেঁটে সফলতার মুখ দেখেছেন। বছর ঘুরলেই উত্তরপ্রদেশ নির্বাচন। হাথরসের ঘটনায় দাঙ্গা বাঁধিয়ে এবার কোনও নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরির চক্রান্ত করা হচ্ছিল কিনা, তাও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

দাঙ্গা বাঁধানোর সঙ্গে পিএফআই- এর নাম জড়িয়ে যাওয়া কোনও নতুন ঘটনা নয়। এর আগেও গত ফেব্রুয়ারি মাসে 'নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (সিএএ)' বিরোধিতায় দিল্লি দাঙ্গার মূল ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে উঠে এসেছিলো পিএফআই- এর নাম। প্রশাসনের দাবি, মৌলবাদী এই সংগঠনের রাজনৈতিক দল 'দ্য সোশাল ডেমোক্রাটিক পার্টি অফ ইন্ডিয়া' সংক্ষেপে এসডিপিআই। হাথরসের ঘটনায় পিএফআই- এর উপস্থিতির প্রমাণ হাতে আসার পরেই সক্রিয়তা বাড়িয়েছে রাজ্য পুলিস।

কংগ্রেস, সমাজবাদী বা বহুজন সমাজবাদী পার্টির মতো বিজেপি বিরোধী শিবির হাথরসের ঘটনা কেন্দ্র করে দাঙ্গা ছড়ানোর কথা মানতে নারাজ। উল্টে যোগী সরকারকে কটাক্ষ করে তাদের বক্তব্য, সরকারের ব্যর্থতা ঢাকতে জঙ্গি যোগসূত্রের গল্প ফাঁদা হয়েছে।




মন্তব্যসমূহ