রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন

 

 আমাদের নিয়মিত সাহিত্য সাধনার দিন প্রতিদিন  




আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিকপত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম । আজ তাঁর ধারাবাহিক থেকে একটু চোখ ফিরিয়ে আবার স্বাদ নিই  ধারাবাহিক উপন্যাসের।এবার থেকে  প্রতি রবিবার প্রকাশিত হবে এক একটি পর্ব। কারণ কিছুই নয় সন্দীপের উপন্যাসের এক একটি অধ্যায় মানে এক একটি গল্প। তাই রবিবাসরীয় একটা সাহিত্যের আড্ডা ভরানো থাক সন্দীপের উপন্যাসে।   


ঝুলবারান্দার নীচে #৩২


সন্দীপ চক্রবর্তী
মাঝে মাঝে আকাশের উড়নি পাখিও মানুষকে সঙ্গ দেয়। জাতীয় সড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় এক সোনালি ডানার চিল আমাদের সঙ্গী হল। গাড়িতে রজত আর আমি। রজত মোবাইলে কথা বলতে ব্যস্ত। আমার চোখ আকাশে। সোনালি ডানা ঝাপটিয়ে উড়তে উড়তে সম্রাট আমাকে অবহেলা ভরে দেখলেন ক'বার। মনে হল তিনি বুঝি আমায় কিছু বলতে চান। কিন্তু কোথায় কী! যে অবহেলায় তিনি আমার দিকে কৃপাদৃষ্টি মেলে ধরেছিলেন, তার দ্বিগুণ অবহেলায় আমাকে ত্যাগ করলেন। সম্ভবত যোটক মিলল না।
আপাতত আমরা চলেছি নদীয়ার বল্লালদিঘিতে। সেখানেই যাত্রিকের প্রথম শো। গাড়ির ব্যবস্থা ত্রিবিধ। আমি আর রজত একটা গাড়িতে। অন্য আর একটিতে শুভংকর আর ছবি। বাকিরা লাক্সারি বাসে। আমরা একসঙ্গেই যেতে পারতাম। আমার প্রস্তাব অন্তত তাই ছিল। কিন্তু রজত বলল, বাপ-কাকাদের আলাদা যাওয়াই ভালো। তাতে ছেলে-ছোকরারা খুশি হয়। বয়েসে হয়তো আমি ওদের বাপ-কাকাদের দলে পড়ি না। কিন্তু দলের মালিকের সামনে তো আর বিড়ি-সিগারেট খাওয়া যাবে না। ইয়ার্কি-ঠাট্টাও করা যাবে না। আমাকেও পদমর্যাদার খাতিরে জেঠামশাই সেজে বসে থাকতে হবে। তার চেয়ে এই ভালো।
দুপুর গড়িয়ে গড়িয়ে বিকেলের দিকে ঢলতে শুরু করেছে। আশ্বিনের ফাঁকিবাজ সূর্য তল্পিতল্পা গোটানোতে ব্যস্ত। শেষ বেলার রোদ্দুরে এখনই ছায়ার ইঙ্গিত। আমি দূর দিগন্তের দিকে চেয়েছিলাম। সম্ভবত আমার হারিয়ে ফেলা সম্রাটকে খুঁজছিলাম। রজত বলল, মনে হচ্ছে এবারের ট্রিপটা স্পেশাল হবে।
স্পেশাল হবে কেন?
এই যে তুই যাচ্ছিস। একজন জলজ্যান্ত লেখককে সঙ্গে পাওয়া কম কথা নাকি! বীথি তোর কথা খুব বলত। বলত যে, তুমি ওকে যাবার কথা বলো না কেন? ওর মতো একজন ক্রিয়েটিভ মানুষ সঙ্গে থাকলে তোমার রাইটাররা অনেক কিছু শিখতে পারবে।
প্রশংসায় বিগলিত হতে পারলাম না। কারণ যাত্রাপালা যারা লেখেন তারা অনেকেই খুব কৃতি মানুষ। বললাম, তুই নিজেও তো ক্রিয়েটিভ। এক সময় নাটক লিখতিস। তোর লেখা নাটক তো আমরা অভিনয়ও করেছি।
ধুর! সে তো সিন্ধু সভ্যতার কথা। সরোদটা শিখলাম সেটাই বাজাবার সময় পাই না। তার জন্য বেলা কত রাগ করে জানিস?
তোর সেই বান্ধবীর নাম বুঝি বেলা?
ডাকনাম। ভালো নাম বলব না। কোথায় আবার গ্যালগ্যাল করে লিখে দিবি। আমাকে কেউ চরিত্রহীন লম্পট বললে কিছু যায় আসে না। কিন্তু ওকে বললে যায় আসে।
সিগারেট ধরিয়ে বললাম, তুই ওকে বিয়ে করছিস না কেন?
নো স্যার। ওটি হবে না। বীথির জায়গায় আমি কাউকে বসাতে পারব না। মন্দিরের বিগ্রহ বদলাতে পারি কিন্তু আমার একমাত্র ঈশ্বরীকে কী করে বদলাব!
দেখলাম রজতকে। আমি ভাগ্যবান। এমন একজন বন্ধু পেয়েছি যাকে শ্রদ্ধা করা যায়। কারও মুখে কোনও কথা নেই। ইঞ্জিনের শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দও নেই। কিছুক্ষণ পর রজত বলল, তা ছাড়া বেলা আমাকে বিয়ে করতেও চায় না। বলে, বাঘ-সিংহের জঙ্গলে থাকাই ভালো। খাঁচায় পুরলে যদি ম্যানইটার হয়ে যায়! কী জানিস সন্দীপ, মেয়ে দু'ধরনের হয়। বাঘিনি আর শূকরী। আমার গাড়ি দেখে, বাড়ি দেখে, স্টেটাস দেখে যারা লোভে পড়ে বিয়ে করতে চায় তারা শূকরী। আর যারা মানুষ রজতকে দেখে তাকে ভালোবাসতে পারে তারা বাঘিনি। আমার বাঘিনি পছন্দ, শূকরী নয়।
সন্ধ্যে নামার কিছুক্ষণ আগে বল্লালদিঘিতে পৌঁছে গেলাম। আমাদের থাকার ব্যবস্থা স্থানীয় একটি স্কুলে। কোথাও গেলে ধুলো পায়ে তীর্থদর্শন করতে বেরিয়ে পড়া আমার স্বভাব। এখানেও সেরকম ইচ্ছে ছিল। কিন্তু যাত্রাপালার সংগঠকদের তারিফ করতে হয়। আমরা পৌঁছনো মাত্র তারা আমাদের জন্য চায়ের ব্যবস্থা করে ফেললেন। চা খেয়ে বেরোতে যাব, এমন সময় পড়ল দ্বিতীয় বাধা। এ বাধা বড়ো মধুর তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কে যেন বাঁশি বাজাচ্ছে। শুনেছিলাম দলের যন্ত্রীদের থাকার ব্যবস্থা নীচে করা হয়েছে। অর্থাৎ বাদক নিশ্চয়ই জীবনবাবু। যাত্রিকের ফ্লুটমাস্টার। দলের সবাই যাকে জীবন মাস্টার বলে ডাকে।
আমার আর কোথাও যাওয়া হল না। চন্দ্রাহতের মতো পায়ে পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে দাঁড়ালাম জীবন মাস্টারের ঘরের সামনে। কেন জানি না মনে হয়েছিল তমালতরুতলে যাবার প্রবেশাধিকার জুটবে না। দূর থেকেই শুনতে হবে তার বাঁশি। কিন্তু আমার ভাগ্য ভালো। জীবন মাস্টার আমাকে দেখতে পেলেন। ডাকলেনও, আসুন স্যার। কালকে আসর তো, তাই একটু ঝালিয়ে নিচ্ছিলুম।
আমি নিজে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের চর্চা কোনওদিন করিনি। কিন্তু শুনি প্রচুর। শুনতে শুনতে কান তৈরি হয়েছে বলে মনে হয়। তাই একটু অবাক হয়েই বললাম, এই সুর আপনাকে যাত্রাপালায় বাজাতে হয়?
না না, এটা তো আমি আমার গুরুর বন্দনা করছিলাম। ঝালানো শুরু হবে এবার।
খুব যদি ভুল না করি তা হলে আপনি টোড়ি বাজাচ্ছিলেন, তাই না জীবনবাবু?
জীবন মাস্টার হাসলেন, বাবুর মুখে শুনেছি বটে। আপনি গানবাজনা ভালোবাসেন। তা স্যার ঠিকই বলেছেন। এটা টোড়ি। দাঁড়ে বসে থাকতে থাকতে পাখির মন যখন ছটফট করে তখন একটু বাজাই।
আপনার দাঁড়ের পাখির বাজনা আমায় একদিন শোনাবেন? বড়ো ভালো বাজান আপনি!
একদিন কেন! আজই শুনুন না।
বাজনা শুরু হল। মানুষ চিনতে আমাদের ভুল হয়। প্রায়শই আমরা মানুষের পোশাক দেখে, প্রতিষ্ঠা দেখে তার সম্বন্ধে একটা ধারণা করে নিই। স্বীকার করি আমিও তার ব্যতিক্রম নই। যাত্রাদলের একজন ফ্লুটমাস্টারের কাছে আমি এমন পরিশীলিত টোড়ি আশা করিনি। নিজেকে ভারী ছোট মনে হল। কিন্তু আমার আত্মগ্লানি বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। গঙ্গা যেমন আবর্জনাকেও ভাসিয়ে নিয়ে যায়, বিষকেও করে তোলে অমৃত এবং তার পরেও পূতপবিত্র থেকে যায় ঠিক তেমনি করে জীবন মাস্টারও আমার মর্মবেদনা আত্মস্থ করে ফেললেন। আমার হাত ধরে নিয়ে গেলেন এক আদিগন্ত সমুদ্রের ধারে। তখন সূর্যাস্ত হচ্ছে। আকাশে অস্তরাগের আলো। দূরে কোথাও বাঁশি বাজছে। টোড়ি। যেন সুর নয়, মায়ের হাতের ছোঁয়া। অনেকদিন পর মাকে পেলাম। মমতার টানে আমার গ্লানি এক লহমায় ভেসে গেল। ক্ষমা যে এত সুন্দর হয় আমি জানতাম না। সত্যিই জানতাম না।
বাজনা শেষ হল এক সময়। জীবন মাস্টার বললেন, ভালো লেগেছে স্যার?
মনে মনে বললাম, চাঁদে কলঙ্ক লেগেছিল। আপনার বাজনা শুনে চাঁদ আজ নিষ্কলঙ্ক হল। কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারলাম না। অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম ওর মুখের দিকে। জীবন মাস্টার বোধহয় কিছু বুঝলেন। হেসে বললেন, আবার আসবেন স্যার। আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব।
ফিরে চললাম নিজের ঘরে। যেতে যেতে দেখলাম রজতের ঘরে আলো জ্বলছে। ভেতর থেকে কথাবার্তার আওয়াজ ভেসে আসছে। তিনজনের গলা চিনতে পারলাম। রজত, ছবি আর শুভঙ্কর। আর কেউ আছে কিনা জানি না। আমার ও ঘরে যাবার কোনও তাড়া নেই। এখন অন্তত আধ ঘন্টা আমার নিজের জন্য চাই। জীবন মাস্টারের বাঁশি থেমেছে। কিন্তু ওর সুর এখনও আমার ভেতরে বাজছে। আমি শুনতে চাই। ডুবতে চাই আরও গভীরে।
কিন্তু ঘরে ফিরে একটা অদ্ভুত জিনিসের মুখোমুখি হলাম। আমার মোবাইলের নীচে চাপা দেওয়া রয়েছে একটা চিরকুট। তাতে লেখা, রজতদা বলছিল আপনাকে ছাড়া আমাদের আসর জমবে না। কিন্তু আপনাকে ডাকতে এসে দেখলাম আপনি নেই। সম্রাট ও সুন্দরীকে ছেড়ে কোথায় যান বলুন তো? শীগগির চলে আসুন। ছবি।
জোরে হাসতে গিয়ে শেষ মুহূর্তে নিজেকে সংবরণ করতে হল। নতুন জায়গা, না জানি কে কী মনে করে! রজতকে সম্রাট মানতে আমার কোনও দ্বিধা নেই। ওর মধ্যে সহজাত একটা আভিজাত্য আছে। কিন্তু সুন্দরী যদি নিজেই নিজেকে সুন্দরী বলে তা হলে তাকে কী বলব? অহংকার নাকি বোকামি! থাক, সে কথা। আপাতত আমি টোড়িতে মুহ্যমান। সম্রাট এবং সুন্দরী অপেক্ষা করুক কিছুক্ষণ।
চিরকুটটা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে জানলা দিয়ে উড়িয়ে দিলাম।
(ক্রমশ)

মন্তব্যসমূহ