দিন প্রতিদিন বিশেষ

দুর্গাপুজোর ফ্যাশন 


 । জিনসের প্যান্ট ।






    কাজল ভট্টাচার্য ,কলকাতা

(আজ পুজো ফ্যাশনের গল্প। সময়কাল সত্তর থেকে আশির দশক। বেলবটমের বিদায়ঘণ্টা, ওদিকে জিনসের আগমনীবার্তা। সেই ফ্যাশন বিবর্তনের সাক্ষী আমার প্রজন্ম। সেই সঙ্গে একেবারেই ঘরোয়া কিছু স্মৃতিকথা পুজোবাজারের।)



জিনস তখন বেশ দামি।

তবুও কোনও অভাগা, ছেঁড়াফাটা জিনস পরে ঘুরতো না।


বাজারে যখন জিনস ঢুকলো, তখন আমি কলেজে। হোর্ডিং, ব্যানারে শ্লোগান- পুজোয় চাই 'অ্যাভিস জিনস'। লেটেস্ট ট্রেনড। খুব একটা ভ্যারাইটি তখনও বাজারে আসেনি। একটাই শেড। গাঢ় নীল। ডেনিম ব্লু এসছিলো তারও পরে।

পর্দায় রাজেশ খান্না যা পড়তো, সেটাই হিট। অমিতাভ বচ্চনও তখন দৌড় শুরু করেছে, তবে রাজেশ খান্নার কাছে পাত্তা পায় না। 

জিনস এলেও, বেলবটম তখনও বিদায় নেয়নি। রাজেশ খান্নার বেলবটমের পায়ের ঘের কত ইঞ্চি, তা নিয়ে রীতিমতো রিসার্চ চলতো বন্ধুদের মধ্যে। কোমড় থেকে হাঁটু পর্যন্ত মোটামোটি টাইট। হাঁটু থেকে নেমেই ঘের বাড়া শুরু প্যান্টের। আর সেই ঘের চরমে পৌঁছতো গোড়ালির নীচে মেজে ছুঁয়ে। কেউ বলতো, কম সে কম তিরিশ ইঞ্চি। আবার কেউ বলতো, না না অনেক বেশি।



সেই বলবটম নিয়েও কম ঝামেলা পোয়াতে হয়নি। নিজের জামাপ্যান্ট পছন্দ করে কিনবো, তখনও সেই মুরোদ ছিলো না। তাছাড়া সব পরিবারেই এক একটা রেওয়াজ ছিলো। আমাদেরও ছিলো। কাকুর সঙ্গে দোকানে যেতাম। সেটা ছিলো সিন্থেটিক কাপড়ের যুগ। জামার জন্য সুতি আর সিন্থেটিকের মিক্সচার। সিক্সটি- টুয়েনটি, এইট্টি- টুয়েন্টি, আরও কতো কী। আর ছিলো ইজিপশিয়ান কটন। 

তবে প্যান্ট বলতেই টেরিকটন। মধ্যে অবশ্য বাজার মাতিয়েছিল টেরিলিনের জামা, গ্যাবার্ডিন কাপড়ের প্যান্ট। কিন্তু ওই কাপড়চোপড়গুলি পরলেই শরীর ঘেমেনেয়ে একাকার। জামা প্যান্টের বিশেষ বিশেষ জায়গায় সাদা ঘামের ছোপ। তাই বেশিদিন চলেনি।


ওদিকে ব্র্যান্ডেড দোকান ছাড়া জামাকাপড় কেনা, কাকুর পছন্দের ছিলো না। তার ওপর পুজোবাজার বলে কথা। রেডিমেড জামাকাপড়ের চলন তখনও সেভাবে হয়নি। তাই থান থেকে জামাপ্যান্টের কাপড় কেনাই ছিলো দস্তুর। মুশকিলটা হতো অন্যখানে। ওই নামীদামী দোকানের জিনিস বা ব্র্যান্ডেড জামাপ্যান্টের কাপড়গুলো হতো সিম্পল। সেই চেক বা স্ট্রাইপ। চকরাবকরা কোনও আইটেম থাকতো না। তাই ঠিক যেমন কায়দা মারা পোশাক চাইতাম, তা মিলতো না। ওদিকে কাকুও ব্র্যান্ড ছাড়া কিছু কিনতে রাজি না।


এদোকান সেদোকান ঘুরেও, ঠিক পছন্দসই জামাপ্যান্ট কেনা হয়ে উঠতো না। জিনিস পছন্দ হলে খানিক দরদাম। দাম কিছু না কমিয়ে কাকুকে জিনিস গছাবে, ওটা অসম্ভব ছিলো। অনেকেই বলতো ওই বড়ো শোরুমে দরদাম চলে না। আমি জানতাম, সব দোকানেই দরদাম চলতো। ওটাও বোধহয় একটা শিল্প। এরকমও হয়েছে, দরদাম করতে গেলেই দোকানদার মেজাজে জানিয়ে দিয়েছে- ফিক্সড প্রাইজ। সঙ্গে সঙ্গে কাকুও অ্যাকশনে। আমার হাত ধরে টান মেরেই, চল 'অমুক' দোকানে। দোকানদারও ততক্ষণে জিনিস তুলে রেখেছে। কিন্তু দোকান থেকে বেরনোর মুহূর্তেই পিছুডাক- স্যার শুনুন। তখন কাকুর মেজাজ- কেন কী হলো? যা বলার তাতো বলেছি। 

তারপর নানাকথা। ধানাই পানাই। শেষ পর্যন্ত দোকানদারের ছাড়পত্র- ওনার বিলটা করে দাও।



জামাপ্যান্টের কাপড় কেনার পর দরজির দোকান। সেখানেও কাকুর সঙ্গে। নামকরা টেলর্স। দুজনেই জামাপ্যান্টের মাপ দেব। সেখানেও এক ঝামেলা। আমার পছন্দ ছিল পাড়ার দরজির দোকান। ওদের কায়দা- টায়দাগুলো ছিলো বেশ ঝাক্কাস। আর বড়ো টেলারিংগুলোতে সেই ছাপোষা স্টাইল। জামার দুদিকে দুটো পকেট দিতে বললেও আপত্তি। আর ফ্ল্যাপ- ট্যাপতো অসম্ভব ব্যাপার। তবু তারমধ্যেই যতটুকু হতো। আর ছিলো কলারের সাইজ। বেশ চওড়া কলার। সেটা তবুও খানিকটা সমঝোতা হতো।

তখন অবশ্য কলারের আর একটা স্টাইলও চলে এসছিলো। রাজেশ খান্না কলার। সেটা আসলে ধার করা হয়েছিল রাজেশ খান্না পাঞ্জাবি থেকে। সেটাকে পাঞ্জাবি না বলে কুর্তা বলাই ভালো। অথবা কম ঝুলের পাঞ্জাবি। থাইয়ের ওপর গিয়েই শেষ। সেই কলারে কোনও ফোল্ড থাকতো না। ওরকম যে দু- একটা জোটেনি তা নয়।


মূল ঝামেলাটা হতো প্যান্টের ঘের নিয়ে। কাকুর প্যান্টের ঘের হতো, যতদূর মনে পড়ে কুড়ি ইঞ্চি। আমারটা করতে বলতো ইঞ্চি দুয়েক বেশি। আমার মুখ গোমড়া দেখে টেলর মাস্টার অভয় দিত- দেখো, খুব সুন্দর ফিটিংস দেব। শেষ পর্যন্ত হয়তো আরও এক- দুইঞ্চি ঘের বাড়তো। তারপরেও কিছু বলতে গেলে, টেলার মাস্টার জানিয়ে দিতো ওই কাপড়ে কুলোবে না। আরও দশ সেন্টিমিটার বেশি কাপড় কিনলে তবেই বেশি ঘের হতো। ব্যাস, ঝামেলা শেষ। 

তাতেও কি সমস্যার শেষ? বেলবটম প্যান্ট পরার স্টাইল ছিলো নাভির ওপর। আর মেজেতে ঠেকানো পায়ের ঘের। ঘষা খেয়ে যাতে প্যান্টের নীচটা না ছেঁড়ে, তাই চেনের অর্ধেকটা জুড়ে দেওয়া হতো। সোয়েটরের একটা চেনকে ডান, বাঁদিক ভাগ করে নিলে যা হয় আর কী। দুপায়ের ঘেরে চেনের দুদিক।

টেলর মাস্টারের প্রবল আপত্তি। ওসব নাকি ফুটপাথের স্টাইল। 

ঘেরেও কিপটেমি, ঝুলেও টানাটানি। মেজাজতো রেগে টং। চায়ের কেটলি বসালে জল ফুটে যেত। ইচ্ছে করতো টেলর মাস্টারের মুখে, শত্রুঘ্ন সিনহার মতো 'ভিসুম' করে একটা কষাই। কলারটা ধরে জিজ্ঞেস করি- রাজেশ খান্না, অমিতাভ বচ্চন, শশী কপুর কোনটা ফুটপাথের?


পুজোয় বন্ধুরা আড্ডা মারতে বসে বেলবটমের ঘেরের মাপ নিয়ে সে কতো কথা। কেউ বলতো- "ধুর, একটা চাকরি- বাকররি জুটুক। বাবার সামনে তিরিশ ইঞ্চির ঘের নাচিয়ে দেখাবো।" অনেকে ছিলো আরও শাহনশাহ। "প্যান্টের ঘের সামলাতে একটা লোক রাখবো, বুঝলি।" আর আমার কেত ছিলো একটা ব্যাপারেই। ব্র্যান্ডেড কাপড়ে ব্র্যান্ডেড টেলার্সের ফিটিংস। এরপরেই কমতে লাগলো প্যান্টের পায়ের ঘের। কমতে কমতে একসময় ঠেকলো ওই আঠারো, কুড়ি ইঞ্চিতেই। আর সেই প্যান্টের নাম হলো প্যারালাল। 


একদিকে বেলবটমের বিদায়, অন্যদিকে টেরিকটনের কপাল পোড়াতে চলে এলো জিনস। কর্ড এলেও, জিনসের সঙ্গে লড়াইতে পেরে উঠলো না। আবার আমরা চললাম আমার পুজোবাজার করতে। কাকুকে মনের ইচ্ছেটা হালকা করে জানিয়ে রেখেছিলাম- জিনস চাই।


- "চল দেখবি, টেরিকটনের দারুণ প্যান্ট কিনে দেব।" এই বলে তো দোকানে নিয়ে গেল কাকু। ততদিনে রেডিমেডের ট্রেন্ড শুরু হয়েছে, তবে পপুলার হয়নি। যাই হোক প্যান্ট দেখা চলছে। কলেজে পড়ি। আমার পছন্দ অপছন্দের একটু মূল্য দেওয়া হচ্ছে। কোনও টেরিকটনের প্যান্টই আমার পছন্দ হয় না। এরপর কাকু নিজেই দোকানদারকে বললো, "জিনসের কী আছে দেখান দেখি।" ব্যাস, মন মে লড্ডু ফুটা! অ্যাভিস জিনস কেনা হয়ে গেলো। দামটা মনে নেই, তবে যে কোনও ভালো টেরিকটন প্যান্টের চেয়ে অনেকটাই বেশি। বড় হয়েছি, একটু মনে লাগলো। এত দাম দিয়ে প্যান্ট কিনবো? এবার আমিই বললাম, "জিনসের আর কী আছে দেখানতো।"

- এরচেয়ে কম দামের কিনলে, ভালো জিনিস পাবেন না। সেলস বয়ের জবাব।

- কেন, তোর পছন্দ না এটা? দারুণ দেখতে তো। কাকু জানতে চাইলো।

- তা হয়েছে। কিন্তু এতো দাম!

- দামের কথা তোর ভাবতে হবে না। পছন্দ হলে নিয়ে নে।

কাকুই সেলস বয়কে বললো প্যাক করে দিতে। আমি অবাক হয়ে গেলাম কাকুকে দরদাম না করতে দেখে। তারপর কাকু নিজের জন্য প্যান্ট পছন্দ করতে লাগলো। প্যান্ট দেখে, দাম দেখে। তারপর একটা পছন্দ হলো। আমার জিনসের থেকে অনেকটাই কম দাম সেই প্যান্টের।



আমার স্বপ্নের 'অ্যাভিস জিনস' নিয়ে বাড়ি ফিরছি। ছেঁড়াফাটা না, আস্ত গোটা একটা জিনস। মেজাজটাই আলাদা। তবু মনটা খচখচ করছিলো। মুখে যাই বলুক, ওই জিনস কাকুর মোটেই পছন্দ হয়নি। হঠাতই কাকুকে জিজ্ঞেস করলাম- তুমিও তো একটা জিনস নিলে পারতে।

- দেখলিতো কতো দাম।

- আমাকেতো কিনে দিলে।

- হ্যাঁ দিলাম। তুই খুশি হবি বলে।

একটু চুপ থেকে আমি ফের বললাম- আর কিছু টাকা দিলেই তো টেরিকটনের বদলে, তোমারও জিনস কেনা হয়ে যেত।

- আমার ওতেই কাজ চলে যাবে। কী দরকার অতো দামী প্যান্টের?

- তাহলে আমাকে যে বেশি দাম দিয়ে কিনে দিলে?

- জন্ম থেকেই তুই দামী পোশাকে অভ্যস্ত। আমাদের সময়ে সেটা ছিলো না। আর ছোটরা কিছু পেয়ে খুশি হলে, বড়রাও তাতেই আনন্দ পায়।


আজ আমি বড়ো ছাড়িয়ে বুড়ো হয়েছি। দিতেও ভালোই লাগে। তবে দেওয়ার অভ্যাসটা সেভাবে গড়ে ওঠেনি। কারণ ধর্মমতে ঠিকঠাক গার্হস্থ্য পালনের সুযোগ হয়নি। কিন্তু ওই পাওয়ার অভ্যাসটা ঢুকে বসেছিল রক্তের একেবারে গভীরে। আজও শুধু পেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু দেবেটা কে?

মন্তব্যসমূহ