দিন প্রতিদিন বিশেষঃ

 বিহারের নির্বাচনী বিশেষঃ 


              ।। নির্বাচনী তরজায় ভাইরাল "বিহার মে কা বা" ।।






   
কাজল ভট্টাচার্য ,কলকাতা, ২০ অক্টোবর 

বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান।
নাকি অন্য কিছু? ডিভাইড অ্যান্ড রুল। সেই ব্রিটিশ পলিসি।
দুর্জনে বলছে, আঞ্চলিকবাদ। প্রথমেই ভোজপুরি, তারপরেই কোথাও মগধি (মগহি) কোথাও মৈথেলি। মোটামুটি পাঁচটি আঞ্চলিক ভাষার বোলবালা বিহারের বিভিন্ন প্রান্তে। আর সেই সব ভাষার দাপটেই হিন্দি গায়েব। 

আঞ্চলিকতার এমনই বাড়াবাড়ি হিন্দি হার্টল্যান্ড বিহার, উত্তরপ্রদেশ। সেই বিহারেই চলছে নির্বাচনী প্রচার। মঞ্চ থেকে ভাষন দেওয়ার সময় বাইরে থেকে উড়িয়ে আনা প্রার্থীরা হিন্দি বলছেন ঠিকই, তবে তাতেও যে আঞ্চলিকতার ছোঁয়া থাকছে না এমনটা নয়। ঠিক যেমন নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহরা বাংলাতে এসে বক্তব্যের শুরুতে এক দু লাইন বাংলা বলেন। শুভেচ্ছা জানান বা রবীন্দ্রনাথ কোট করেন। সঙ্কেত দেন 'আমি তোমাদেরই একজন'। আমরাও অমনি গলে জল। ঠিক তেমনি ভোটের স্টার ক্যাম্পেনাররাও বিহারে ভোজপুরি, মগধির লাইন দিয়ে শুরু করেন, বাকীটা হিন্দিতে সারেন। প্রাদেশিকতা থেকে সরাসরি আঞ্চলিকতা। আসলে, ভোট বড় বালাই। তাই যে ফুলে যে দেবতা তুষ্ট, সেই ফুলই মুখে গুঁজে আনেন হিল্লি- দিল্লির রাজনৈতিক পুরোহিতরা। নরনারায়ণ সেবায় কাজে লাগে।




তবে এই আঞ্চলিক ভাষার সুবাদেই এবারের চরম প্রাপ্তি দুই তরুণী গায়িকা। একজনের বয়সতো আবার সবে আঠারো। অন্যজনের তেইশ। তাঁদের ঘিরেও শুরু হয়ে গেছে ভোটের লড়াই। তবে ওই দুই কন্যার লড়াইটা ব্যালটে না, সুর আর ছন্দে। ফেসবুক, ইউ টিউব মাতিয়ে দিয়েছে এই দুই কন্যার লড়াই। আর এই দুই তাজা রক্তের শিল্পীর লড়াইয়ে বলতে গেলে চিৎপাত হয়ে গেছেন আগের প্রজন্মের মনোজ তিওয়ারি। এতদিন ভোজপুরী গানে তিনিই ছিলেন মুকুটহীন সম্রাট।




আসলে বিহার নির্বাচনে বরাবরই ব্যাপক প্রভাব পড়ে ওই আঞ্চলিকবাদের। পাশাপাশি আছে জাত ধর্ম বর্ণের রাজনীতি। সবার ভোটব্যাঙ্ক আলাদা। প্রয়াত জয়প্রকাশ নারায়নের সমাজতান্ত্রিক গান্ধিবাদী আন্দোলন থেকে উঠে আসা নেতারাও কেউ একজোট থাকতে পারেনি। সমাজতন্ত্র শিকেয় তুলে গদি দখলের লোভে, তাঁরাও ওই জাতপাতের রাস্তাতেই হেঁটেছিলেন। কেউ সফলতার হাত ধরে বিহারের গদি কবজা করেছিলেন, আবার কেউ বিরোধী আসনে বসেছিলেন। 
যেমন ধরুন লালুপ্রসাদ যাদব, নীতিশ কুমার, সদ্যপ্রয়াত রামবিলাস পাশোয়ান। একই ভাবাদর্শের আন্দোলন থেকে উঠে আসা এই ত্রয়ীর পারস্পরিক সম্পর্ক আজ সাপে নেউলে। মিল এক জায়গাতেই। এঁরা সবাই তথাকথিত দলিত, সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণির ভোটব্যাঙ্কের ওপর ভরসা করেন। একেবারেই আঞ্চলিক রাজনীতির কারবারী। 




লালুর ভোট রাজনীতি বিখ্যাত হয়েছিল 'MY' সমীকরণে। মুসলিম, যাদব ভোটব্যাঙ্ক। অন্যদিকে নীতিশ কুমার হোন বা প্রয়াত রামবিলাস পাশোয়ান, তাঁদের ভোটব্যাঙ্ক কুর্মি, কুশওয়াহার মতো অন্যান্য অনগ্রসর, অতি অনগ্রসর শ্রেনির মানুষরা। বিহারে এই জাতপাত বর্ণ বৈষম্যের চেহারাটা হামেশাই বিভিন্ন ঘটনায় প্রকাশ হয়ে পড়ে। বলা যায় 'ওপেন সিক্রেট'। 

কংগ্রেস, বিজেপির মতো জাতীয় স্তরের দলগুলিরও নিজেদের কিছু ভোটব্যাঙ্ক আছে বৈকি বিহারে। বিহারে কংগ্রেসের সুদিন এখন বেশ স্তিমিত। তবে বিজেপি সমানে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। পদ্ম শিবিরের গায়ে বিহারের রাজনৈতিক তথ্যভিজ্ঞ মহল অনেক আগেই বর্ণহিন্দুর সীলমোহর দেগে দিয়েছে। দলের প্রার্থী নির্বাচন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, ঘটনা নিছক অমূলক না।
মোট ২৪৩ আসনের বিহার বিহারসভায় এবার পদ্মছাপ জার্সি গায়ে নামবেন ১১০জন প্রার্থী। তাঁদের মধ্যে ৫১ জনই তথাকথিত 'উঁচু জাত'- এর। এঁদের মধ্যে ২২ জন রাজপুত, ১৫ জন ভূমিয়ার। ব্রাহ্মণদের সন্তুষ্ট করতে তাঁদের ১১জন আর তিন কায়স্থপ্রার্থী। ভূমিয়াররা কিন্তু বরাবরই বিজেপি ঘেঁষা বলে পরিচিত। রাজপুতদেরও তারমধ্যে সামিল করার চেষ্টা করেছে বিজেপি। আনুপাতিক হিসেবে ১২ কোটি মানুষের বিহারে, প্রতি একশোজনের মধ্যে এই উচ্চ সম্প্রদায়ের মানুষ মাত্র ১৬ জন।

বাদবাকী ৫৯ আসন বিলি হয়েছে ওবিসি প্রার্থীদের মধ্যে। তারমধ্যে ১৫ জন যাদব, যাঁরা ওবিসি'র মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী। জনসংখ্যার গড়প হিসেবে বিহারের প্রতি একশোজনের মধ্যে ওবিসির সংখ্যা ৭৪ জন। একসময় এই ভোটব্যাঙ্কের সুবাদেই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছিল লালুপ্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দলের। খেয়াল করার ব্যাপার হলো, মাত্র ১৬ শতাংশ উচ্চ বর্ণের ভোটের জন্য ৫১জন প্রার্থী, আর ৭৪ শতাংশ অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেনির জন্য বরাদ্দ মাত্র ৫৯ জন প্রার্থী। বিজেপি'র ধুরন্ধর নেতারা কি সহজ পাটিগনিতেও এত কাঁচা? মোটেই না। আসলে বিজেপি'র টার্গেট বর্ণহিন্দু ভোট। তারপর যা পাওয়া যায়, তা পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা।




ওদিকে বিজেপি'র জোটসঙ্গী নীতিশ কুমারের জনতা দল(ইউনাইটেড)- এর টিকিট বিলির অঙ্কটা দেখুন। জোটসঙ্গী বিজেপি'র ঠিক উল্টো ছবি। দলের মোট ১১৫ জন প্রার্থীর মধ্যে উচ্চবর্ণের মাত্র ১৯ জন। ১০ জন ভূমিয়ার, রাজপুত সাতজন আর দুজন ব্রাহ্মণ। দুই জোটসঙ্গী লড়াই চালাবে দুই ফ্রন্টে। উচ্চবর্ণ, নিম্নবর্ণের ভোট মিলেমিশে একাকার হয়ে গদি দখল। নীতিশ কুমার, নরেন্দ্র মোদি তখন হাত ধরাধরি করে গাইতেই পারেন- মিলে সুর মেরা তুমহারা।

জাতের ভাগাভাগি এখনও শেষ হয়নি। অগ্রসর, অনগ্রসরের পরে আছে অতি অনগ্রসর শ্রেনি (এক্সট্রিম ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস)। স্বাধীনতার তেয়াত্তর বছর পরেও ভারতের ছবিটা এরকমই। সংখ্যাটাও এঁদের আদৌ কম নয়। প্রতি একশোজন বিহারবাসীর মধ্যে ২৬ জনই অতি অনগ্রসর শ্রেনির মানুষ। কথায় বলে, গরীবের পছন্দ থাকতে নেই। এঁদেরও নেই। জাতপাত, বর্ণ, ধর্ম দেখে এঁরা ভোট দেন না। যে প্রার্থীকে দেখে মনে হয় ভরসা করা যাবে, এঁরা তাঁকেই ভোট দেন। একসময় এঁদের পছন্দের খাতায় ছিলেন লালুপ্রসাদ যাদব। লালুর সেই ভোটব্যাঙ্ক ভাঙতে নীতিশ এক মোক্ষম চাল চালেন। ওবিসি কোটার এই জনগোষ্ঠিকে আলাদা করে চিহ্নিত করে, বিশেষ কিছু সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করে দেন। ওই ঘটনার পরেই ধাক্কা খায় লালুপ্রসাদের দল। 

এবারের ভোটে সবার নজর সমাজের একবারে নীচুতলার এই অতি অনগ্রসর শ্রেনির মানুষগুলির দিকে। কারণ নীতিশের জনতা দল(ইউনাইটেড) এবার সরাসরি লড়াই চালাবে লালুপ্রসাদের রাষ্ট্রীয় জনতা দলের সঙ্গে। আবার ওদিকে লড়াইয়ের জন্য ময়দানে নেমে পড়েছেন চিরাগ পাসোয়ানের লোক জনশক্তি পার্টি। তিনদলেরই টার্গেট বিহারের ওই ২৬ শতাংশ ভোটব্যাঙ্ক। এখন দেখার সদ্যপ্রয়াত পিতা রামবিলাস পাসোয়ান নামের সহানুভূতির ঝড় তুলে, চিরাগ আদৌ নিজেকে এগিয়ে রাখতে পারেন কিনা। 

নেতারা উন্নয়নের ফিরিস্তি শুনিয়ে চলেছেন শহর গ্রাম গঞ্জে। আগামিদিনে আরও কী উন্নতি হবে বিলি করে চলেছেন তার ঢালাও প্রতিশ্রুতি। এসব শুকনো কাঠখোট্টা রাজনীতির কচকচানির মধ্যেই গান বেঁধে বিজেপি'র প্রচারে নেমে পড়েছেন নামডাকওয়ালা ভোজপুরী গায়ক মনোজ তেওয়ারি। বারানসীতে জন্মালেও আসলে তিনি বিহারের কৈমুর জেলার অটরোলিয়ার মানুষ। মনোজ অবশ্য পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ। উত্তর পূর্ব দিল্লির বিজেপি সাংসদ। গেরুয়া শিবিরের অতি পরিচিত স্টার ক্যাম্পেনার। 
মানুষ ভিড় করে শোনেন তাঁর ভোজপুরি গান। 



কিন্তু এবার আচমকাই ধুমকেতুর মতো হাজির হয়েছেন নয়া প্রজন্মের দুই বিহার কন্যা। তাঁরা অবশ্য রাস্তায় নামেননি। বরং বলা ভালো, বিহারবাসীদের মনের কথা শোনাচ্ছেন তাঁরা। তবে সেখানেও জোর বিরোধ আছে। কিন্তু খেয়োখেয়ি নেই। সম্ভবত নয়া প্রজন্মের শর্ত মেনেই তাঁরা হাজির সোশাল মিডিয়া, ইউ টিউবে। তাঁদেরও লড়াই চলছে, তবে সেই লড়াইয়ে ঝাঁজ নেই। সরাসরি কোনও দলের স্তুতি বা নিন্দা নেই। আছে উন্নয়ন, অনুন্নয়নের তরজা। বিহারকে তাঁরা দেখেছেন নতুন চোখ দিয়ে। সেই চোখে জাতপাতের ছায়া নেই। আছে করোনা, পরিযায়ী শ্রমিক, বন্যা, কল কারখানার আকাল।

এই দুই শিল্পীর মধ্যে একজনের নাম নেহা সিং রাঠোর। জীবনের তেতইশটি বসন্ত পার করেছেন। বেশ কেতাদুরস্ত মেয়ে। তাঁকে টেক্কা দিতে হাজির মাত্র আঠারোর, মৈথিলি ঠাকুর। টিভি'র রিয়েলিটি শোয়েও মাতিয়েছিলেন তিনি। কৈমুর জেলার নেহা সিং রাঠোর শোনান ভোজপুরি লোকগান । মৈথিলি ঠাকুর মধুবনির, তাঁর ভাষা মৈথেলি। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে দক্ষ আঠারোর মৈথিলির ভোজপুরি গানেও শ্রোতারা মুগ্ধ। 

নেহা সিং রাঠোর তাঁর গানে প্রশ্ন তুললেন- "বিহার মে কা বা/ করোনা সে বিমার বা/বাড় সে বদহাল বা...!" যার বাংলা মানে করলে দাঁড়ায়- বিহারে কীই বা আছে? করোনা রোগিরা আছে। বন্যায় ভেসে যাওয়া আছে। তাঁর নিজের লেখা নিজের সুর। তবে গানটা তৈরি হয়েছিল এক হিন্দি সিনেমার গানের আদলে।
জবাব দিলেন মৈথিলি। "কা বা কা বা/ রট লগাওলে অল্লর বল্লর গাওয়ই ছই..!" ছন্দে ছন্দে জবাব। "কী আছের রটনা লাগিয়ে চলেছ। উল্টোপাল্টা গেয়ে চলেছ!" গানের গীতিকার ডক্টর চন্দ্রমনি ঝা।

মৈথিলি বললেন, "মিথিলায় সবকিছু আছে। দ্বারভাঙ্গায় এয়ারপোর্ট, আবার তৈরি হচ্ছে এমস-এর হসপিটাল। সব গ্রামে সড়কে তো চব্বিশ ঘণ্টা আলো। ঝুপড়ির স্কুল আজ পাকাবাড়িতে।" এরপরেই নেহাকে খোঁচা, "মানুষকে ভুল বোঝাবেন না।"
"লোকসঙ্গীত শিল্পীদের কাজ লোকের অভাব অভিযোগের কথা বলা। মৈথিলি যেন সেকথা না ভুলে যান," জবাব নেহার।

রাজনীতির কারবারীরা একটুও দেরি না করে দলের প্রচারে জুড়ে দিয়েছেন নেহা, মৈথিলির গান। নেহার গানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই তা বাজছে নীতিশ- মোদির এনডিএ বিরোধী শিবিরে। ওদিকে এনডিএ লুফে নিয়েছে মৈথিলির গান। আর রাজনীতির এই তরজায়, দুই বিহার কন্যা রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন গোটা ভারতবর্ষে।
লোকভাষার মজাই আলাদা। মেজাজেও সহজ সরল। সবমিলিয়ে তাদের লড়াইও বড় মধুর। আর তাই নেট দুনিয়ায় নেহা, মৈথিলির সুরেলা সওয়াল জবাব এখন ভাইরাল।

মন্তব্যসমূহ