রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন

 

 আমাদের নিয়মিত সাহিত্য সাধনার দিন প্রতিদিন  




আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিকপত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম । আজ তাঁর ধারাবাহিক থেকে একটু চোখ ফিরিয়ে আবার স্বাদ নিই  ধারাবাহিক উপন্যাসের।এবার থেকে  প্রতি রবিবার প্রকাশিত হবে এক একটি পর্ব। কারণ কিছুই নয় সন্দীপের উপন্যাসের এক একটি অধ্যায় মানে এক একটি গল্প। তাই রবিবাসরীয় একটা সাহিত্যের আড্ডা ভরানো থাক সন্দীপের উপন্যাসে।   

ঝুলবারান্দার নীচে #৩৩



সন্দীপ চক্রবর্তী

জীবন মাস্টারের টোড়ি আমার হৃদয়ের গহন অরণ্যের কোন বাঁকে হারিয়ে গেল কে জানে! আবার কখনও তাকে খুঁজে পাব কিনা, পেলেও সে আমাকে আজকের এই সন্ধ্যার মতো মাতাল করে তুলবে কিনা জানি না। শুধু এইটুকুই জানি, কলকাতার জনারণ্যে জীবন মাস্টার নামের এক জাদুকর থাকবেন। আমার জীবনে কোনওদিন যদি মুখ লুকিয়ে কাঁদার দিন আসে তা হলে ওর কাছেই যাব। আমি তীর্থযাত্রী, তিনি দেবতা-- ফিরিয়ে নিশ্চয়ই দেবেন না।
নিজের ভাবনায় বেশ বুঁদ হয়ে ছিলাম, হঠাৎ উচ্চকিত হাসির শব্দে সুতোটা ছিঁড়ে গেল। মনে পড়ল চিরকুটের কথা। অগত্যা গণ্ডী থেকে বেরোতে হল। রজতের ঘরে পা রেখে বুঝলাম আসর বেশ জমে উঠেছে। যদিও কথার আসর, সুরের নয়। তবু আসর তো বটে। তিনজনের হাতেই হুইস্কির গ্লাস। চোখে মদালস দৃষ্টি। হংস মধ্যে বক যথা হয়ে বসলাম।
রজত বলল, তোকে দেখে মনে হচ্ছে ঘুম থেকে উঠে এলি!
রসিকদের আসরে বসে রসিকতা করার ইচ্ছে হল। বললাম, ঘুমোইনি তবে ঘোর লেগেছিল।
ছবি বলল, কীসের ঘোর জানতে পারি সন্দীপদা?
টোড়ির। তাও বাঁশিতে। জীবন মাস্টার কিন্তু বেশ গুণী লোক রজত। এত ভালো টোড়ি অনেকদিন শুনিনি।
রজত স্বীকার করল, গুণী তো বটেই। আজকাল আমাদের লাইনে ক্লাসিকাল জানা মিউজিশিয়ান ক'জনই বা আসে!
শুভঙ্করও জীবন মাস্টারের ফ্যান। বলল, মাস্টারের সব থেকে বড়ো গুণ নাটকের বাজনা বাজানোর সময় নিজের জ্ঞান জাহির করে না। মিউজিক ডিরেক্টর যতটুকু বলে ততটুকুই বাজায়।
এক্স্যাক্টলি। আর্টিস্টের পরিমিতিবোধ না থাকলে সে আর্টিস্টই নয়।
এই আলোচনা হয়তো আরও কিছুটা দীর্ঘ হত। হল না ছবির জন্য। আমি দেখেছি মহিলাদের মধ্যে কেউ কেউ এরকম থাকেন যারা পুরুষের অ্যাটেনশন খুব পছন্দ করেন। পুরুষসঙ্গীদের ফোকাস অন্যদিকে ঘুরে গেলে তারা ক্ষুব্ধ হন। ছবিও বোধহয় সেই দলের। কোনও কারণ ছিল না। দিব্যি চুমুকের পর চুমুকে গ্লাস খালি হচ্ছিল। হঠাৎ হাতদুটো দু'দিকে ডানার মতো ছড়িয়ে দিয়ে আড়মোড়া ভাঙার ভঙ্গী করে ছবি বলল, যাই বলো বাপু, আমাদের জীবন মাস্টার কিন্তু নতুন লোক পেলে বেশ বশ করতে পারে। জানে সন্দীপদার হাতযশ আছে। তাই আগে থাকতে গলা সেধে রাখল। দু'দিন পর মেয়ের কথা তুলবে।
রজত জড়ানো গলায় বলল, কী ব্যাপার ছবিরানি! কথায় এমন হুল কেন? এ তো ভালো জিনিস নয়।
তোমার যদি হুল মনে হয় আমার কিছু করার নেই রজতদা। যা সত্যি আমি তাই বললাম। শুভঙ্কর তুই চুপ করে আছিস কেন? লোকটা তোকে দুর্গার কথা বলেনি?
শুভঙ্কর মাথা নাড়ল। আমি এতক্ষণ শুনছিলাম। এবার বললাম, দুর্গা কে?
জীবন মাস্টারের মেয়ে কাম একমাত্র শিষ্য। খুব নাকি ভালো বাজায়। তাই মাস্টার যাকে পায় প্রথমে মেয়ের বাজনা শোনার কথা বলে তারপর কোনও কনফারেন্সে বাজানোর চান্স করে দেওয়ার কথা বলে।
সাধারণত কোথাও বেড়াতে গেলে আমি বিতর্ক এড়িয়ে চলি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পারলাম না। বললাম, আমরা যারা শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত তাদের প্রায় সবাইকেই কেউ না কেউ প্রথমে চান্স দেয় ছবি। আমাকেও একজন দিয়েছিলেন। রজতের হয়তো তার কথা মনে আছে।
রজত ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, প্রমোদদা। তাই না?
হ্যাঁ। কবি প্রমোদ বসু। হাওড়ায় থাকতেন। আজ তুমি আমাকে যা দেখছ তার অনেকটাই প্রমোদদার হাতে গড়া। বাকিটা আমার চেষ্টা আর ঈশ্বরের আশীর্বাদ। সুতরাং দুর্গা বা ওর বাবা যদি একটা সুযোগের জন্য কাউকে বলেন তা হলে সেটা অপরাধ হয়ে যায় না।
ভেবেছিলাম আমার কথা শুনে ছবি বিরূপ হয়ে উঠবে। কিন্তু না, হল না। মুখের সামনে তুড়ি দিয়ে হাই তুলে বলল, হবে হয়তো। তবে সন্দীপদা আপনার সঙ্গে আমার কিন্তু অনেক কথা আছে। সেসব কথা না শুনে আপনি যেতে পারবেন না।
বেশ তো, শুনব।
থ্যাঙ্কস। এখন তা হলে উঠলাম। খুব ঘুম পাচ্ছে।
ছবি চলে গেল।
রজত দরজার দিকে তাকিয়ে বলল, দু'জন অ্যাডাল্ট মানুষ যখন কথা বলে আমি ইন্টারফিয়ার করি না। কিন্তু সন্দীপ তুই আমার বন্ধু। তাই বলছি। বি কেয়ারফুল! ছবি কিন্তু কাঁচা আগুন।
মোহরের মুখটা মনে পড়ল। মনে হল আমার বুকের ভেতর মেঘ আছে। বৃষ্টির আদরে আমি সারাক্ষণ সমুদ্র হয়ে থাকি। আগুনের সাধ্য কী আমাকে পোড়ায়! কিন্তু এসব কথা রজতদের বলা যায় না। বললাম, সম্রাট তুই, আমি তোর অতিথি। আমার নিরাপত্তার দায়িত্ব তো তোরই রজত।
শুভঙ্কর হো হো করে হাসল। রজত কিছু বলল না।
তবে স্বীকার করি ছবির আচরণ আমাকে বিস্মিত করেছে। আমার আনন্দযাত্রার পথে পথে মানুষের বিচিত্র রূপ দেখেছি। সব মুখই সুন্দর কিন্তু সব সৌন্দর্য নিখুঁত নয়। গোলাপেও যেমন পোকা লাগে আর পোকা লাগলে গোলাপ যেমন মাধুর্য হারিয়ে ম্লান হয়ে যায় ঠিক তেমনই রিপুর তাড়নায় মানুষের অপাপবিদ্ধ মুখ তার গরিমা হারায়। কখনও ঈর্ষা, কখনও লোভ আবার কখনও ভয় এসে তাকে ভুলিয়ে দেয় সে কে! তার এই জীবন কীসের জন্য! ছবিও এমনই একজন দিশাহারানো মানুষ। নয়তো নাটকের হিরোইন হয়ে সামান্য একজন ফ্লুটমাস্টারকে ঈর্ষা করত না। দুর্গার উন্নতিতেও বাধা দিত না। কিন্তু কেন এমন করে ছবি? আত্মবিশ্বাসের অভাব? জীবনের অনিশ্চয়তা? জানি না। তবে জানতে হবে। জীবন যখন কোনও গুহামুখ খুলে দেয় তখন আমার মতো সত্যসন্ধানীর ভেতরে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
পরের দিন সন্ধ্যেবেলায় যাত্রিকের আসর। সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়েছিলাম। নদীয়া জেলার গ্রাম আমি আগেও দেখেছি। এইসব গ্রামে কত যে রাধাকৃষ্ণ আর চৈতন্য মহাপ্রভুর মন্দির আছে তা বোধহয় গুনে শেষ করা যাবে না। আর আছে আশ্রম। এমনই এক আশ্রমের মহন্ত গৌরদাস বাবাজীর সঙ্গে আলাপ হল। আমার পরিচয় জেনে বললেন, লেখক মানেও তো সাধক। তবে পথটি আলাদা। আপনি মানুষের মধ্যে তাঁকে খোঁজেন আর আমি তাঁর মধ্যেই তাঁকে খুঁজি। এ জগৎ তো তাঁর সৃষ্টি। সবেতেই তিনি। তা হলে তাঁকে খোঁজার জন্য আলাদা করে শুধু মানুষ লাগবে কেন?
মনে হল রবীন্দ্রনাথ তো তাঁর গানে গানে গৌরদাস বাবাজীর কথাটিই বলে গেছেন। আমরা সাধারণ। অখণ্ডকে দেখার চোখ আমাদের নেই। তাই আমরা তাঁকে ভেঙে নিয়ে ছোট করে অসংখ্য রূপে দেখি। আশ্বিনের মনোরম সকালটি আরও স্নিগ্ধ হয়ে উঠল। আশ্রমের বাগান থেকে কাঁঠালিচাঁপার মন আলো করা গন্ধ ভেসে আসছে। আশ্রমে আসার সময় বাগানে থলকমলের মেলাও দেখেছি। কী যে সুন্দর কী বলব! সত্যিই সবেতে তিনি! কিন্তু সবেতে যে তিনি, এই জ্ঞান তো মানুষেরই অর্জন। সুতরাং জ্ঞানের অমৃত আর অমৃতের পুত্রকে একেবারে অস্বীকার করতে পারি না।
গৌরদাস বাবাজীর কথার রঙে মনটি রাঙিয়ে নিয়ে আস্তানায় ফিরে এলাম। কিন্তু এসে দেখি একতলায় ধুন্ধুমার বেঁধে গেছে। একদিকে সামান্য পৃথুলা বছর পঁয়ত্রিশের এক মহিলা। নাম অদিতি। যতদূর জানি পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেন। অন্যদিকে দাশরথী। বয়েস আঠারো-ঊনিশের বেশি হবে না। দলে এর কী ভূমিকা আমার জানা নেই। অদিতির অভিযোগ সে যখন স্নান করে এসে ঘরে পোশাক বদলাচ্ছিল তখন দাশরথী চা দেওয়ার নাম করে ঢুকে পড়েছে। দাশরথী অভিযোগ অস্বীকার করেনি। ওর বক্তব্য, ও জানত না অদিতি পোশাক বদলাচ্ছে। তাই ঢুকে পড়েছিল। তবে ঘরে ঢুকলেও ও কিছু দেখেনি। এই নিয়ে বেঁধেছে ঝগড়া।
জায়গাটা পেরিয়ে গেলাম। সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাঁদিকের প্রথম ঘরটিতে সদাশিব নন্দীর বাস। যেতে যেতে ওর দরাজ গলায় দু'কলি রামপ্রসাদী শুনে দাঁড়ালাম। কলকাতায় যাত্রিকের অফিসে যেদিন ওর সঙ্গে আলাপ হল সেদিনই ওকে বেশ ভালো লেগেছিল। ওর সঙ্গে রজতের অনেক মিল আছে আবার অমিলও আছে। দু'জনেই মেজাজি--মজলিশি। দু'জনেই রাজসিক। কিন্তু রজত রাজা আর সদাশিববাবু পড়তি দশার জমিদার।
আমাকে দেখতে পেয়ে সদাশিববাবু ডাকলেন, আরে বাইরে দাঁড়িয়ে কেন মশাই! ভেতরে আসুন।
আপনার গান শুনে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। ভারী সুরেলা গলা আপনার।
হতেই হবে। আমি মশাই হাওড়া জেলার কুলগাছিয়ার নন্দী বাড়ির ছেলে। আমাদের বাড়িটাই গানবাজনার বাড়ি। ঠাকুর্দা ভালো টপ্পা গাইতেন। বাবার ছিল খেয়াল আর ঠুমরির শখ। আহা সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে আজও গায়ে কাঁটা দেয় মশাই। তখন আমার সাত-আট বছর বয়েস। বাবা আমাকে নিয়ে রোজ কাকভোরে সূর্যপ্রণাম করতে যেতেন। রোজ দেখতাম পুব দিগন্তে সূর্য উঠছে আর বাবা উদাত্ত গলায় ভৈরবীর সুর ভাঁজছে। কে বলবে বলুন তো লোকটা জমিদারের ছেলে। আমি না হয় জমিদারি দেখিনি কিন্তু বাবা তো দেখেছে।
অবাক হয়ে বললাম, আশ্চর্য! আপনাকে দেখার পর আমার মনে হয়েছিল আপনি নিশ্চয়ই জমিদার বংশের ছেলে। আমার অনুমান তা হলে মিলে গেল। এই প্রসঙ্গে আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই।
করে ফেলুন
জমিদার বংশের ছেলে হয়ে এ লাইনে এলেন কী করে?
সদাশিববাবু হো হো করে হেসে বললেন, সে এক মজার গল্প মশাই। ছোটবেলা থেকেই আমি যাকে বলে ইয়ে মানে একটু বারমুখো। পড়াশোনা ভালো লাগত না। হয় টো টো করে ঘুরে বেড়াতাম নয়তো রেললাইনের ধারে দাঁড়িয়ে ট্রেন দেখতাম। আর ভাবতাম একদিন আমি ট্রেনে করে অনেকদূরে চলে যাব। সেসময় দোল-দুর্গোৎসবে গ্রামে যাত্রাদল আসত। পালাগান শুনতে আমার খুব ভালো লাগত। ইচ্ছে করত আমিও সেজেগুজে অভিনয় করি। একবার মা বীণাপাণি অপেরা এল। আর আমি ওদের সঙ্গে পালালাম।
মানে!
মানে আর কী! যে নৌকোয় ওদের বাক্স-প্যাটরা বাঁধা হচ্ছিল তার ছইঘরে ঘাপটি মেরে পড়ে রইলাম। নৌকো ছেড়ে দিল। আর আমি মাঝির ভাওয়াইয়া শুনতে শুনতে রওনা দিলাম দূরের দিকে। পালাবার চেষ্টা আমি এর আগেও করেছি। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারিনি। ধরা পড়ে গেছি। সেবার আমায় কেউ ধরতে পারেনি।
দলের লোকেরা যখন জানতে পারল তখন কী হল?
হুজ্জোতি হল একটু। একে জমিদারের ছেলে তাতে আবার মোটে বারো বছর বয়েস-- ঝামেলা তো হবেই। তবে আমিও ছাড়বার পাত্র নই। মিনতি গায়েন তখন যাত্রার নামকরা অভিনেত্রী। বীণাপাণির হিরোইন। আমি তার পায়ে গিয়ে পড়লাম। বললাম, আমি অভিনয় করতে চাই। ব্যাস, কেল্লা ফতে! সেদিন থেকে তিনি আমার মিনুমা আর আমি তার ভুলোছেলে।
কুলগাছিয়ার বাড়িতে যান?
না
আফসোশ হয় না?
প্রাণোচ্ছল মানুষটি হঠাৎই উদাস হয়ে গেলেন। বললেন, জীবনে আফসোশ আমার একটাই সন্দীপ। মিনুমা আমার হাতে জল খেয়ে স্বর্গে যেতে চেয়েছিলেন। তখন তিনি কাশীতে আর আমি তমলুকের এক আসরে। আসর শেষ করে ছুটলাম। কিন্তু যখন পৌঁছলাম তখন তিনি চলে গেছেন। সেই থেকে জল দেখলে আমার চোখে জল আসে। দরকারের বেশি একবিন্দু জলও আমি খেতে পারি না। রঙিন জল পান করি অঢেল। কারণ ওতে চোখে জল আসে না।
তাকিয়ে রইলাম মানুষটির দিকে। মনে হল আমি এক পারাপারহীন সমুদ্রের তীরে এসে দাঁড়িয়েছি। যে সমুদ্র দূরকে চিনেছে। দূরকে ছুঁয়েছে। দূরকে মা বলে ডেকেছে।
(ক্রমশ)

মন্তব্যসমূহ