দিন প্রতিদিন বিশেষ

আজকের বিশেষঃ দেবী দুর্গার বোধন 


বোধন





ডঃ সুমিত্রা খাঁ

( দেবী দুর্গার আগমন ঘটছে। তাঁর বোধন কি এবং কেন ? সেটা শান্তিনিকেতনের প্রবীনা আশ্রমিকের কলমে )

মাতৃশক্তির কাছে আদিম অবস্থা থেকেই মানুষ নত হয়েছে। সৃষ্টির মহা সঙ্গীত শুনেছে মাতৃজঠরে। সৃষ্টির পালন ক্ষমতাকে উপলব্ধি করেছে জননীর স্নেহে। কেবল দুর্বল নয়, সবল দুরন্তের ও প্রয়োজন হয়েছে মায়ের স্নেহ ভরা আঁচলের ছায়া। তাই রামায়ণে দেখি দুর্দান্ত প্রতাপশালী রাবণ শক্তির পুজারী। তাঁর সোনার লঙ্কা রক্ষা করেন ভদ্রকালী। রাবণ পুত্র মহী রাবণও দেবী ভক্ত। দুষ্ট রাবণেরা দেবতার অপ্রিয় হলেও দেবীর কৃপায় সর্বদা তারা বিজয়ী। তাই লঙ্কারাজ রাবণকে বধ করতে শ্রী রামচন্দ্রের প্রয়োজন হয় দেবীর কৃপা। অকালে উদ্বোধিত করে তিনি দেবীকে পূজা করেন। প্রচলন হয় অকাল বোধন।

বর্তমানে আমরা যে দুর্গতিনাশিনী দুর্গার আরাধনা করি , সেই দুর্গতিনাশিনী দেবী মহিষাসুরমর্দিনী । তিনি মহিষাসুরকে বধ করে দেবতাদের দেবরাজ্য পুনরুদ্ধার করেন।

মহিষাসুর হল আসুরী শক্তির প্রতীক। দৈবশক্তি এবং আসুরী শক্তি , উভয় শক্তিকেই সন্তুষ্ট রাখা মানুষের উচিৎ। আসুরী শক্তিকে বশে রেখে দৈব শক্তির অনুগ্রহ লাভ করতে পারলেই মানুষের সকল কাজই সিদ্ধ হয়। শুধু বহির্জগতেই নয় , অন্তর্জগতেও চলছে সর্বদা এই বিরুদ্ধ শক্তির দ্বন্দ্ব। মানবজীবনে নিবৃত্তি ও প্রবৃত্তির যুদ্ধ , সদবৃত্তির সঙ্গে নিয়তই চলছে। মহিষাসুর আসুরী শক্তির প্রতিক । তাই তাঁর তুস্টি বিধানের বিশেষ প্রয়োজন।

শরতের সোনার আলোয় ত্রিভূবন জননীর আরাধনা আমাদের কাছে সর্ব শ্রেষ্ঠ মহোৎসব। মাতৃমুর্তি যেন সংহতির বিজয়োৎসব ।

দেবী দুর্গার আরাধনা অনুষ্ঠিত হয় আশ্বিন মাসের শুক্লা সপ্তমী তিথি থেকে দশমী পর্যন্ত। চারদিন ধরে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আশ্বিন মাসের আমাবস্যা তিথিতেই দেবীর আবাহন শুরু হয়। ঐ তিথি মহালয়া নামে পরিচিত । এই দিন পিতৃপক্ষের সমাপ্তি ও দেবী পক্ষের সূচনা। মহালয়ার পূণ্য প্রভাতে দেবী আবাহনের বার্তা চারিদিকেই ভেসে ওঠে। মর্ত্যলোক আপ্লুত হয় মহালয়ার পূন্যপ্রভাতে আগমনী গানের সুরের ঝর্না ধারায়।

চারদিনের মহা পুজার আগে , ষষ্ঠীর দিন সন্ধ্যায় বিল্ব বৃক্ষ মূলে দেবীর বোধনের মধ্য দিয়েই এই পুজোর সূচনা হয়। বোধন শব্দের অর্থ জাগরণ।

পৌরানিক ব্যাখ্যায় বলা হয় – বর্ষার মাসগুলোতে দেবতারা বিশ্রাম করেন। বর্ষান্তে শরতে তাই দেবীর বোধন বা জাগরণ ঘটিয়ে ,তাঁর পুজো। আরও প্রবাদ আছে যে , সূর্যের দক্ষিণায়নকালে দেবতারা নিদ্রিত থাকেন। তাই এই অসময়ে বা অকালে দেবীর পুজা করতে হয়। এই জন্য শারদীয়া দুর্গাপুজোকে অকাল বোধন বলা হয় ।




দেবীর বোধন প্রতিমার সামনে না হয়ে বিল্ব বৃক্ষ মূলে অনুষ্ঠিত হয়। অনেকে মনে করেন , প্রাচীণ ভারতে এক সময়ে বৃক্ষ পূজার প্রচলন ছিল। এই বিল্ববৃক্ষকে সূর্যের প্রতীক হিসেবেই ভাবা হত।  “ বিল্বং জ্যোতিরিতি আচক্ষতে” , তাই সূর্য সর্ব শক্তির আধার বলে মহাশক্তিরুপিনী দেবী দুর্গার আবাহন বা বোধন বিল্ববৃক্ষমূলেই অনুষ্ঠিত হয়। কানে ভেসে ওঠে আগমনী সূর – যেখানে বলা হয়েছে-

“  বিল্ববৃক্ষমূলে করিয়া বোধন ,

   গণেশের কল্যানে গৌরীর আগমন ।

    ঘরে আনব চন্ডী , কর্ণে শুনবো চন্ডী ,

    আসবে যত দন্ডী , জটাজুট ধারী।“

আবার,

     “ গণেশ আমার শুভকারী হে গিরি

        গণেশ আমার শুভকারী।

         পুজে গণপতি পেলাম হৈমবতী

           চাঁদের মালা যেন চাঁদ সারি সারি।“

 

এই হলেন দেবী মহিষাসুরমর্দিনী , তাই দেবীর হাতে থাকে সমস্ত মঙ্গলের প্রতীক, মঙ্গলময়ী রূপের প্রতীক। তিনি মহিষাসুরমর্দিনী আবার চির কল্যান ,চির মঙ্গলদায়িনী।

মন্তব্যসমূহ