রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন

 

রবিবারের গল্প


 ।। পৃথার চার দেয়াল ।।





  কাজল ভট্টাচার্য


"ভালো থেকো তুমি।

আর দেখা হবে না। তুমি আর আমি, আর কোনও রাত একসঙ্গে কাটাবো না। তোমাকে ভুলতেও পারবো না। তোমার জন্য মনকেমন করলে, চুপিচুপি দেখে যাব তোমাকে। ওই গেটের সামনে দাঁড়িয়ে। তুমি হয়তো জানতেও পারবে না।

মনে রেখ আমার ঠান্ডা হাতের ছোঁয়া। খুব অসভ্য তুমিও। তোমার গায়ে গাল ঠেকালেই, তুমিও নিঃশব্দে আমাকে হামি খেতে। ছড়িয়ে দিতে তোমার তাপ, শীতলতা, আমার সারা শরীরে। আবার যখন সারাদিনের একশরীর ক্লান্তি নিয়ে দরজার তালা খুলে তোমার কাছে আসতাম, তুমি যেন ঝাঁপিয়ে পড়তে আমার ওপর। জুড়িয়ে যেত সারা শরীর মন। তোমার আলিঙ্গনে ধরা দিতাম আমিও।"


"আর মাত্র কয়েকটা মুহূর্ত। তারপরেই আমার চিরবিদায়। ভুলে যেওনা আমায়।"

অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলো পৃথা। এঘর ওঘর করতে করতেই আপনমনে বকে চলেছিলো সে। কথায় বলে দেওয়ালেরও কান আছে। নইলে পৃথাই বা বলবে কেন? দেয়ালরাও কান পেতে শুনছিলো পৃথার দারুন অভিমানের কথা।

বেরোবার আগে অভ্যাসের ঠাকুর প্রণাম। তারপরেই এতদিনের নিয়ম ভেঙে না বেরিয়ে, দেওয়ালে গাল ঠেকিয়ে দাঁড়ালো পৃথা। দেওয়ালের শরীর ভরে দিয়েছিলো ছবি এঁকে। দুহাত ছড়িয়ে যেন আঁকড়ে ধরতে চাইছিলো নিষ্প্রাণ দেওয়ালের সেই শরীর। অথবা ওই দেওয়াল জড়িয়ে ডানা মেলতে চাইছিলো পৃথা। বাইরের আকাশে উড়ে যাওয়ার আগের মুহূর্ত।

পাগলের মতো চুমু খেলো দেওয়ালের এখানে ওখানে। বেশ কিছুদিন ধরে, এই ঘরটাকেই কতই না গালমন্দ করেছে পৃথা।

- "এবার একবার বেরোতে পারলে হয়। ভুলেও আর এঘরে ঢুকবো না। ঘরতো না, গারদ।" স্তব্ধতার কয়েক মুহূর্ত। কথায় বলে, রাগ পুষে রাখতে নেই। তাই এতদিনের পোষা রাগ সব ঝেরে ফেলে দিয়ে গেলো এই ঘরেই। বিচ্ছেদের পর যাতে আর কোনও অনুতাপ না হয়। শুভাগমন হয়েছিল। এবার শুভবিদায়।

ওয়াল ক্লকের পাখির ডাক মনে করিয়ে দিলো ন'টা বাজে।

দরজায় তালাবন্ধ করে, লিফটের দিকে এগিয়ে গেলো পৃথা।



কিছুদিনের লকডাউন কাটতে না কাটতেই, ফ্ল্যাটটা একেবারে অসহ্য হয়ে উঠেছিলো পৃথার কাছে। মনে হতো এতো ছোট ফ্ল্যাট বাসের অযোগ্য। ঠিক কতদিন ফ্ল্যাটবন্দি, তার হিসেবটাও আর মনে নেই। একদফা লকডাউন শেষ হতে না হতেই আর একদফা, দফার পরে দফা। মনে হতো যেন অনন্তকালের নির্বাসন। লকডাউন শুরুর দু চারদিন বেশ ভালোই কেটেছিলো। ঘরের ভেতর লাগামহীন জীবন। যখন খুশি ওঠা। যখন খুশি শোওয়া। খাওয়াদাওয়াও ইচ্ছে মতো। একেবারে কাছাখোলা জীবন। ঘড়ির শাসন নেই। বল্গাহীন। যেমনভাবে খুশি চালালেই হলো। কীভাবে যেন এতদিনের সব অভ্যাসগুলোই ধীরে ধীরে বদলে গেলো ওয়ার্কিং লেডি পৃথার।

কিন্তু সপ্তাহখানেক কাটতে না কাটতেই মন ছটফট। বাইরের হাওয়া একটু না খেলে চলে? মেট্রোর গুঁতো। রাস্তার গা ঘেঁষাঘেঁষি। খোলা আকাশের নীচে দাঁড়ানো।

এক সন্ধ্যায় লিফটে করে সোজা ছাদের দিকে উঠে গেলো পৃথা। শেষ কবে ছাদে এসছিলো মনে নেই। কিন্তু একি, ছাদের দরজায় তালা মারা ! সিকিউরিটিকে কল করলো। "কমিটির অর্ডারে ছাদে যাওয়া মানা ম্যাম," জানালো সিকিউরিটি। "সোশাল ডিসটেন্সিং। সবাই ছাদে ভিড় জমাচ্ছিল।"


মেজাজটা বিগড়ে গেল। ঘরে এসে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো পৃথা। টিভিটা চালালো। নিউজ চ্যানেল মানেই করোনা। পৃথিবীতে আর কোনও ঘটনা ঘটছে না। পৃথার জীবনেও তাই। নিস্তরঙ্গ দিন। অনেকদিন পর নিজের রং তুলি সব খুঁজে বার করলো পৃথা। কিন্তু খাতা কোথায়? নেই। এদিকে বাইরে যাওয়ার উপায়ও নেই। আবার গিয়েও লাভ নেই। দোকানপাট সব বন্ধ।

অগত্যা ! লিভিং রুমের একটা দেওয়াল বেছে নিলো পৃথা। সেখানেই শুরু হলো ছবি আঁকা। ফ্ল্যাটটা কেনার পরেই ওর ইচ্ছে হয়েছিল, দেওয়ালে ওরলি পেন্টিং করবে। কিন্তু সময় কোথায়? সকাল নটায় বেরিয়ে সাত, সাড়েসাতটায় ঘরে ফেরা। তারপর আর শরীর দেয় নাকি? ছুটির দিনে অফিস না থাকলেও, কাজের অভাব থাকতো না।


লকডাউন সেই ইচ্ছাপূরণের সুযোগ করে দিয়েছিলো। গোটা দেওয়াল ভরে গেছিলো ছবিতে। বেশ খোলতাই হয়েছিলো লিভিং রুমের। এরপর একে একে ফ্ল্যাটের সাজসজ্জার অনেক পরিবর্তন এলো। কিন্তু পরিবর্তন এলো না রোজকার জীবনে। দফায় দফায় বেড়েই চললো লকডাউনের দিন। শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে উঠলো পৃথা। বিন্দুতে সিন্ধু ! তিল তিল করে প্রতি মূহূর্তে জমে ওঠা বিরক্তি, একসময় পাহাড় হয়ে উঠলো। ফ্ল্যাটটাকে মনে হতে লাগলো জেলের কয়েদখানা। রাষ্ট্র তাকে বিনা দোষে, জোর করে আসামী বানিয়ে গারদে পুরে রেখেছে। অসহ্য লাগতে লাগলো তার নিজের হাতে সাজানো সুন্দর ফ্ল্যাটটা।


মুক্তি চাই মুক্তি। আরকিছু না হোক, মায়ের কাছেই চলে যাবে সে। আপাতত সেটাই হবে তার ঠিকানা। একটু হাত-পা ছড়িয়ে থাকা যাবে। তারপর দেখেশুনে একটা টু বিএইচকে ফ্ল্যাট কেনা। সামনে বেশ একটা বড়ো ব্যালকনি। অফিস থেকে হাউস লোন পাওয়ার অসুবিধা নেই। মোটের ওপর এই সিঙ্গল বেডরুম ফ্ল্যাটে আর না। আর তাই আজ অফিস ছুটির পরেই, পৃথার বাপের বাড়ি চলে যাওয়ার কথা।


অনেকদিন পর, ফের খানিকটা রুটিন জীবনে ফেরা। ফের খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে একবুক নিশ্বাস। ফ্রেশ না পলিউটেড অক্সিজেন, আজ আর ওসব বিতর্কে যেতে ইচ্ছা করে না। আজ মুক্তির আনন্দ।


কমপ্লেক্সের মেনগেট থেকে বেরনোর আগে একবার থমকে দাঁড়ালো পৃথা। পেছন ফিরে তাকালো ফ্ল্যাটের দিকে। বরাবরই পৃথার সাধ ছিল, তার একেবারে নিজের একটা ফ্ল্যাট থাকবে। তাই চাকরি পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই এই ছোট ফ্ল্যাটটা কিনেছিলো সে। তখন হাতে তেমন টাকা ছিলো না। অগত্যা এই ওয়ান বিএইচকে ফ্ল্যাট।

"বাই বাই। ভালো থেকো ফ্ল্যাট।" কথাকটা বলেই, মুখ ঘুরিয়ে হাঁটা লাগালো পৃথা। মনেমনে বললো, "তোমাকেও খুব ভালবেসেছিলাম। খুব কষ্ট দিয়েছ তুমি। আর ফিরবো না তোমার কাছে।"

এবার যেভাবেই হোক, একটা একটু বড় ফ্ল্যাট কিনতে হবে। ভাবলো পৃথা। এত ছোট ফ্ল্যাটে বড্ড দমবন্ধ লাগে।



বেশ কাটলো প্রথম দিনের অফিস। ছুটি হতেই বাস ধরতে ছুটলো পৃথা। ছোটাটা ঠিক আগের মতো হলো না। অভ্যাসটা চলে গেছে। ফের কয়েকদিন যাতায়াত করলেই পুরনো ছন্দে ফিরবে। শরীর ভেঙে পড়ছে ক্লান্তিতে। ফ্ল্যাটটা যেন পৃথার আঁচল ধরে টানছে। ইচ্ছে করছে দরজাটা দড়াম করে খুলেই বিছানায় লুটোপুটি খেতে। নিজের সেই বালিশ। নিজের গায়ের গন্ধমাখা বিছানার এলোমেলো চাদর। ওই ঘরেই যেন আর এক পৃথাকে ফেলে এসেছে। যে অপেক্ষা করছে অফিস ফেরতা ক্লান্ত বিধ্বস্ত পৃথার জন্য। এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই, ঘড়ি দেখলো পৃথা। আধঘণ্টার ওপর দাঁড়ানো হয়ে গেলো। বাসের আশা ছেড়ে দিয়ে একটা ক্যাব ডেকে নিলো সে।


মন তোলপাড়। সংঘাত আবেগ আর যুক্তির। মানুষ যাকে জেতাতে চায় তার হয়ে যুক্তির পর যুক্তি সাজায়। পৃথাও তাই করলো। প্রথমেই সে নিজেকে জিজ্ঞেস করলো- এতরাতে হুট করে মায়ের কাছে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? নিজেই প্রশ্নের উত্তর দিলো- না। দাদা-বৌদি বিরক্ত হতে পারে। যদিও মাকে ফোন করে পৃথা আগেই জানিয়েছিল, লকডাউনটা উঠলেই একদিন তোমাকে দেখতে যাব। কিন্তু সেদিনটা যে আজকেই, তা বলা হয়নি।

বাপেরবাড়িতে তার নিজের ঘর, নিজের বিছানা আছে। সেই সঙ্গে আছে মায়ের ঘ্যানঘ্যানানি- এবার একটা সংসার কর। তারপর আছে সবার হাজারগন্ডা প্রশ্নের জবাব দেওয়া। বাথরুম থেকে বেরনোর তাড়া। শাড়ি, জামাকাপড় কিছু রাখা থাকলেও, প্রসাধনীর কিছু নেই। পরে একসময় ফ্ল্যাট থেকে সব গুছিয়ে নিয়ে আসবে, এরকমটাই প্ল্যান ছিল পৃথার।


"রিজেন্ট পার্ক পোস্ট অফিস চলে এসছে। আপনি কোথায় নামবেন ম্যাম?"

পাশের গলিতেই পৃথার বাপের বাড়ি। দোটানার স্পষ্ট সঙ্কেত চোখেমুখে। তবু যেন জোর করে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকলো সে। কিছুতেই উঠবে না। এ লড়াইটা পৃথার নিজের সঙ্গে নিজের। জিতলেও জিত, হারলেও জিত।

- "আমাকে আর একটু এগিয়ে দেবেন?"

- "কোথায় যাবেন বলুন?"

- "নেতাজিনগর বাজার দিয়ে ঢুকেই সামনের ফ্ল্যাটে।"

ক্যাব এগোতেই, একটা ছোট্ট হাসি খেলে গেল পৃথার ঠোঁটে। পেছনে পড়ে রইলো রিজেন্ট পার্ক পোস্ট অফিস। পৃথার বাপের বাড়ি, তার মা। ওই বাড়ির সঙ্গে তার নাড়ির টান। কিন্তু নেতাজি নগরের নিজের ফ্ল্যাটটা তার অভ্যাস। ওই বিছানার সোহাগ না খেলে, ঘুম আসে না।

অভিমানী পৃথা ফিরে গেলো, তার নিজের সাজানো ছোট্ট কয়েদখানার দিকেই।

স্বেচ্ছাবন্দি হওয়ার মজাটাই আলাদা।।

( ক্যানভাস সৌজন্যঃ সংগৃহিত) 

মন্তব্যসমূহ