আজকের বিশেষঃ নবদুর্গা
দেবী দুর্গা
( শান্তিনিকেতনের প্রবীণ আশ্রমিকের কলমে দেবী দুর্গার নয়টি রূপ )
“ এল রে শ্রী দুর্গা
শ্রী আদ্যাশক্তি
মাতৃরূপে পৃথিবীতে।।“
শক্তি ও কল্যানের
আধার দেবী দুর্গা। দুরগতি থেকে রক্ষা করেন যিনি , তিনিই দুর্গা। শরৎকালে সাদা
মেঘের ভেলায় চড়ে দশভূজা দুর্গতিনাশিনী দুর্গা আবির্ভূতা হন। তাঁর দশ প্রহরণে
সর্বদাই বেজে চলে রণ সংগীত । তিনি শিষ্টের পালন ও দুষ্টের দমন করেন।
দুর্গার পুজোকে
মহাপুজো বলা হয়। এই পুজায় কেবল দেবী দুর্গাই সপরিবারে পুজিতা হন না।বিধি অনুসারে
হিন্দু ধর্মের সব সম্প্রদায়েরই দেব দেবীর এই সময় আবাহন ও পুজা হয়। এই মহা পূজার
নাম স্বার্থক করতেই ঋষিরা একটি চালচিত্রের মাধ্যমেই , যেন সব দেব দেবীকে এক জায়গায়
এক জায়গায় হাজির করে ধর্মসমন্বয় ঘটিয়েছেন। যে চালচিত্র দুর্গা প্রতিমার পিছনে
প্রকাশ পায়, তা খুবই তাৎপর্যপুর্ণ বার্তা বহন করে। এটি সর্ব ধর্মসমন্বয়ের প্রতীক। অবক্ষয়ের পথে
বিপর্যস্ত সমাজে সর্বত্র মাতৃভাবনা ও মাতৃভাবের বিকাশেই এই মাতৃ আরাধনার সার্থকতা।
বর্তমানে আমরা যে
দুর্গতিনাশিনী দুর্গার আরাধনা করি সেই দুর্গতিনাশিনী দেবী মহিষাসুরমর্দিনী । তিনি
মহিষাসুরকে বধ করে , দেবতাদের দেব রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন।
শরতের সোনার আলোয়
ত্রিভুবন জননীর আরাধনা আমাদের কাছে সর্ব শ্রেষ্ঠ মহোৎসব। মাতৃমুর্তি যেন সংহতিরই
বিজয়োৎসব । বেদ বন্দিত এই মাতৃশক্তির মহা মাতৃকায় ,বহুনামে , আধ্যাত্মিক নানা রূপে
, নানা বর্ণে , নানা মুর্তিতে, জগত মাতা দুর্গার প্রকাশ। সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা দেবী
দুর্গার নয়টি নামকরণ করেন বা সমষ্টিগত ভাবে নবদুর্গা নামে দেবী দুর্গাকে প্রকাশিত
করেন।
শৈলপুত্রী
নব দুর্গার প্রথম
নাম ‘ শৈলপুত্রী ‘ । তিনি যেহেতু পর্বত কন্যা রূপে জন্ম নেন । তাই দেবীর নামকরণ হয়
শৈল পুত্রী।
ব্রহ্মচারিণী
নবদুর্গার দ্বিতীয় নাম ‘ ব্রহ্মচারিনী’। তিনি তপস্যা ,ত্যাগ
আর বৈরাগ্যের মুর্তিমতী রূপ। তিনি হলেন জ্যোতির্ময়ী। ডান হাতে তাঁর জপমালা, বাম
হাতে কমন্ডুলু ।
চন্দ্রঘন্টা
মা দুর্গার তৃতীয় শক্তিরূপ ‘ চন্দ্রঘন্টা’ । মায়ের মস্তকে
শোভিত হয় ঘন্টার আকারে অর্ধ চন্দ্র ।মায়ের গায়ের রঙ চন্দ্রের মত উজ্জ্বল । এই হলেন
মা দশভুজা। নানা অস্ত্রে সুসজ্জিতা। দেবী সিংহ বাহিনী। মা যে সর্বদাই যুদ্ধ সাজে
সু সজ্জিতা’
কুস্মান্ডা
দেবীর চতুর্থ রূপ ‘ কুস্মান্ডা’। এই দেবী অষ্ট বাহু
সমন্বিতা । সাতটি হাতে যথাক্রমে কমন্ডুলু, ধনুক , বাণ , পদ্মফুল, অমৃতকুম্ভ , চক্র
ও গদা। আর মায়ের অষ্টম হাতে সর্ব সিদ্ধি প্রদানকারী জপমালা।
স্কন্দমাতা
মায়ের পঞ্চম রূপ ‘ স্কন্দমাতা’ । এই রূপে মা চতুর্ভুজা। আর
ক্রোড়ে আছেন স্কন্দ। দেব সেনাপতি কুমার কার্ত্তিক। দক্ষিণের ওপর হাতে তিনি ধরে আছন
পুত্রকে। আর দু হাতে বরাভয় মুদ্রা। ইনি সিংহ বাহনা আর পদ্মাসনা। স্কন্দের মাতা
হওয়ায় , তিনি স্কন্দমাতা।
দেবী কাত্যায়নী
দেবীর ষষ্ট রূপ , ‘ দেবী কাত্যায়নী’। এই দেবী চতুর্ভুজা ও
সিংহ বাহিনী। দেবতাদের মঙ্গলার্থে অসুর বিনাশে জন্য মহর্ষি কাত্যায়নের আশ্রমে
আবির্ভূতা হয়েছিলেন। মহর্ষি কাত্যায়ন এই দেবীর আরাধনা করেছিলেন বলে , দেবী
কাত্যায়নী।
কালরাত্রি
দেবী সপ্তম রূপে, ‘ কালিকা’। গাত্র বর্ণ কালো। ইনি
ত্রিনয়না,চতুর্ভুজা। পিছনে আলুলায়িত কেশরাজি। ইনি একাধারে ভয়ংকরী। অন্য ধারে
কল্যাণকারী ।
মহাগৌরি
দেবীর এই রূপে গৌরবর্ণা। বৃষ বাহিনী চতুর্ভুজা। তাঁর দেহ
,আভরণ , বাহন সবই শুক্ল।
সিদ্ধিদাত্রী
দেবীর নবম ও শেষ রূপ
হচ্ছে ‘ সিদ্ধিদাত্রী’। দেবী চতুর্ভুজা। সিংহ ও পদ্ম আসনে রয়েছেন তিনি। এই দেবী
করুণায় , দুঃসময়ে সংসারে মানুষ মোক্ষলাভের সন্ধান পায়। ভক্ত ও সাধককে দেবী সব সময়
সিদ্ধি দান করেন। তাই তিনি সিদ্ধিদাত্রী।
সৃষ্টি , স্থিতি ,
বিনাশিনী ,শক্তিময়ী দেবীর আরাধনায় আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে সঙ্গে শান্তি – প্রীতি –
সংহতির জন প্লাবন বইতে থাকে। শরতের প্রভাত ও কবির গানে –
“ আমার রাত পোহালো
শারদ প্রাতে –“ মুখরিত হয়ে ওঠে । আবার কবি নজরুলের গানে মায়ের আবাহন সুচিত হয়,
“ দশভুজে দশ প্রহরণ
ধরি ,
আয় মা দশদিক আলো করি,
দশ হাতে আন কল্যান
ভরি, নিশীথ শেষের ঊষা গো।“
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন