দিন প্রতিদিন বিশেষ

বিহার নির্বাচন ফলাফল




।। হেরেও রাজা পুরুর মতো সমীহ আদায় করে নিলেন তেজস্বী ।।





কাজল ভট্টাচার্য, কলকাতা,  ১১: নভেম্বর


প্রশ্ন দুটোই।
এক, এটাই তাহলে নীতিশ কুমারের শেষ ভোট লড়াই ছিলো তো? 
দুই, ইভিএম, এমভিএম হয়ে যাওয়াতেই কি মহাজোটের ভরাডুবি? প্রশ্ন রাহুল গাঁধির কাছে। মাত্র কয়েকদিন আগের কথা। তিনি ইভিএম-এর নতুন নাম দিয়েছিলেন- এমভিএম। মোদি ভোটিং মেশিন। 
ওদিকে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর মতগণনায় এনডিএ এগোতেই কংগ্রেস, রাষ্ট্রীয় জনতা দল অভিযোগ তুললো নীতিশ প্রশাসনের চাপে মতগণনার নামে লোকতন্ত্রের হত্যা করা হচ্ছে।

ভোটের ফলাফল যাই হোক না কেন, রাজনীতির এই কেষ্টবিষ্টুদের কুরুক্ষেত্রে, যে নামটা নীরবে উঠে এলো তা হলো তেজস্বী যাদব। বিহারের নব প্রজন্মের তরুন তুর্কি। দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর পুত্র হয়েও, মা বাবার নামের ওপর ভরসা রাখেননি তিনি। নিজের বুদ্ধি বিবেচনায় ঘুঁটি সাজিয়েছিলেন। বিহারকে বার করে আনতে চেয়েছিলেন তিন দশক পুরনো মন্ডল কমিশনের হ্যাংওভার থেকে। সময় আর বিহারের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষিতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাঁর শ্লোগান ছিল- কামাই, পড়াই, দাওয়াই আর সিঁচাই। রোজগার, শিক্ষা, ওষুধ আর চাষবাস। পিতৃসূত্রে পাওয়া যাদব- মুসলিম, ওবিসি ভোটব্যাঙ্কের মধ্যে নিজেকে আটকে না রেখে, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বৃহত্তর বিহারবাসীর কাছে পৌঁছতে চেয়েছিলেন তেজস্বী। নজর ছিলো বিজেপির উচ্চবর্ণের, অভিজাত শ্রেনির ভোটে ভাগ বসানো।

একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কড়া লড়াই দিয়েছেন তেজস্বী। এমনকি যেমন দ্রুত গতিতে তাঁর রাজনৈতিক উত্থান হলো, শেষ পর্যন্ত তা চাপে ফেলে দিয়েছিলো বিহারের গত পনেরোর বছরের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারকেও। প্রচারের একেবারে শেষ পর্বে এসে আর কোনও রাজনৈতিক কচকচানি না। সহানুভূতিতে আস্থা রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন নীতিশ। জানিয়ে দিয়েছিলেন, এবারই তাঁর শেষ ভোটের লড়াই। 

ওদিকে রাহুলের হম্বিতম্বিই সার। বিজেপি, রাষ্ট্রীয় জনতা দল, জনতা দল ইউনাইটেডের লড়াইয়ের আশপাশেও ঘেঁষতে পারলো না কংগ্রেস। বাস্তবে কংগ্রেস ইদানীং কালে যখনই কোনও আঞ্চলিক দলের সঙ্গে জোট বেঁধে নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমেছে, তখনই সেই জোটের ভরাডুবি হয়েছে। অতীতের কিছু ভোটের ফলাফলেই তা প্রমাণিত। 
এবারের ভোটে তেজস্বীর কিছু হারানোর ছিলো না। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে নীতিশ যেদিন মহাজোটের সরকার ভেঙ্গে বিজেপি শিবিরে ফিরেছিলেন, সেদিনই সবকিছু হারিয়ে এক নতুন দৌড় শুরু করেছিলেন তেজস্বী। আর তাঁর দৌড়ে যে নীতিশ সমেত এনডিএ শিবিরের পায়ের তলার জমিও কেঁপে উঠতে পারে, তার সাক্ষাত প্রমাণ মিললো এবারের বিধানসভা নির্বাচনে।

সোমবার পাটনায় জনতা দল ইউনাইটেডের দপ্তরে ভর করেছিলো নীরবতা। অধিকাংশ মিডিয়ার রাজনৈতিক মৌসম বিজ্ঞানীদের পূর্বাভাস ছিলো চরম হারের মুখ দেখবেন নীতিশ তথা এনডিএ। তাদের পূর্বাভাসে শনিবার ভোট শেষ হওয়ার পরেই মেঘ জমেছিল নীতিশ শিবিরে। অন্যদিকে উৎসাহের বাতাসে গা ভাসিয়েছিল তেজস্বী শিবির। কিন্তু মঙ্গলবার ভোটগণনা শুরু হতেই পূর্বাভাস ধুয়েমুছে সাফ। মেঘ কেটে গেলো এনডিএ পরিবারের। হাসি ফুটলো সবার মুখে। এমনকি সেই হাসির শরিক হলো রাষ্ট্রীয় জনতা দল শিবিরও।


মোট ৫৫টি কেন্দ্রের মতগণনা যতো এগলো, ততোই স্পষ্ট হয়ে উঠলো ভোটছবিটা। সব দলকে ছাপিয়ে উঠলো বিজেপি আর রাষ্ট্রীয় জনতা দল। চললো এনডিএ মহাজোটের কড়া টক্কর। ওদিকে পিছিয়ে পড়লো জনতা দল ইউনাইটেড। ভোটের ফল কতক্ষণে? কারুর আর তর সয় না। ওদিকে অবস্থা বেগতিক দেখে রাত হতে না হতেই রাষ্ট্রীয় জনতা দল অভিযোগ করলো, নীতিশ প্রশাসনের চাপেই ভোটগণনা চলছে ধীরগতিতে। তার আগেই দুপুরে কমিশনের তরফ থেকে জানানো হয়েছিল, ভোটগণনা চলছে স্বাভাবিক গতিতেই। তবে ফলাফল ঘোষনায় এবার কিছু দেরি হবে। কারণ এবার ভোট হয়েছে করোনা প্রোটোকল মেনে। তাই ৬৫ হাজার থেকে বেড়ে পোলিং সেন্টারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল এক লক্ষ ছাব্বিশ হাজার। রাজ্য জুড়ে তিন দফায় ভোট পড়েছিল প্রায় চার কোটি ষোল লক্ষ।

কিছুক্ষণ পরেই ফের কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুললেন রাষ্ট্রীয় জনতা দলের মুখপাত্র মনোজ ঝা। এবার গলা মেলালো কংগ্রেসও। দলের বিজয়ী প্রার্থীদের সার্টিফেকেট ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে। পরে জেতার কথা অস্বীকার করছে কমিশন। দাবি করা হলো বেশকিছু কেন্দ্রে পুনর্গণনার। রাত নটা নাগাদ রাষ্ট্রীয় জনতা দল মোট ১১৯ প্রার্থীর নাম টুইট করে জানালো, তাঁরা জিতে গেলেও সার্টিফিকেট দেওয়া হয়নি। 'লোকতন্ত্রের হত্যা'র অভিযোগে ধর্নায় বসলো তেজস্বীর সমর্থকরা।

ওদিকে মোদির টুইটবার্তা- বিহার বিশ্বকে লোকতন্ত্রের পাঠ পড়ালো। ভোটগণনা শেষ হতে না হতেই আবেগে ভাসলো এনডিএ শিবির। তখনও আনুষ্ঠানিক ভাবে জয়ের ঘোষনা হয়নি। তবে মতগণনায় স্পষ্ট, ১২৪টি আসন দখল করে বিহার ফের এনডিএ'র দখলে। মোট ৭৩টি আসন দখল করে এক নম্বরে থাকলো বিজেপি। জনতা দল ইউনাইটেডকে সন্তুষ্ট হতে হলো ৪৩টি আসনেই। অন্য দুই শরিক এইচএএম, ভিআইপি পেলো চারটি করে মোট আটটি আসন। 

ওদিকে মহাজোট থেমে গেলো ১১১ তেই। রাষ্ট্রীয় জনতা দলের হাতে গেলো ৭৬টি বিধানসভা কেন্দ্র। কংগ্রেসের ইজ্জত রক্ষা হলো ১৯টি আসনে। অন্য ১৬টি আসন দখল করলো বামপন্থীরা। মোট ২৪৩ আসনের বিহার বিধানসভায় বাদবাকী আটটি কবজা করলো অন্যান্যরা। 




পরিসংখ্যান বলছে বিহার বিধানসভার ম্যাজিক ফিগার ১২২ এনডিএ'র হাতের মুঠোয়। আসন দখলের হিসেবে জনতা দল ইউনাইটেড পিছিয়ে থাকলেও বিজেপি'র বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন নীতিশ কুমার। বিজেপির বার্তা আর মাঝরাতের উৎসবে ফিরে এলো হারিয়ে যাওয়া নীতিশ কুমারের মুখের হাসি। পাশাপাশি তাঁর 'সব ভালো যার শেষ ভালো'র ডাকে সাড়া দিয়ে বিহারবাসীও ক্ষমতা ফিরিয়ে দিলো তাদের পনেরো বছরের পুরনো সুশাসনবাবুর হাতেই।



মন্তব্যসমূহ