।। বিহার টপকে এবার বাংলায় ঢুকে পড়তে চাইছেন ওয়েসি ।।




কাজল ভট্টাচার্য, কলকাতা, নভেম্বর ১৮:


টার্গেট বেঙ্গল।

রাজ্যের দুশো চুরানব্বইটি আসনের কমবেশি নব্বইটির ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক। এমনই হিসেব- কিতেব রাজ্য রাজনীতির বিশেষজ্ঞদের। তার ওপর গোটা রাজ্যে প্রায় সাতাশ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট, পরিসংখ্যান বলছে। এহেন বাংলার দিকে এআইএমআইএম চিফ অসদউদ্দিন ওয়েসির চোখ পড়বে না, ভাবাটাই বোকামি। বিহারে যখন এক লাফে এক থেকে পাঁচে টপকাতে পেরেছেন, তখন বিহার থেকে বাংলাতেই বা টপকাতে পারবেন না কেন? এমনটাই ভাবছেন হায়দরাবাদী অসদউদ্দিন ওয়েসি। তবে মুখে তিনি যতোই অসাম্প্রদায়িক নীতি নৈতিকতার কথা বলুন না কেন, তাঁর নজর রাজ্যের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত মালদহ, মুর্শিদাবাদ আর দিনাজপুরেই।

তলেতলে বাংলার বুকেও যে ওয়েসি প্রস্তুতি চালাচ্ছেন, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তা অজানা ছিলো না। সময় থাকতেই তিনি সরাসরি ওয়েসি বা তাঁর দলের নাম না করে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, হায়দরাবাদের এক সাম্প্রদায়িক দলের কাজকর্ম নিয়ে। মানুষকে বলেছিলেন, ওই দলের প্ররোচনার ফাঁদে পা না দিতে। ওই সাম্প্রদায়িক দলের পেছনে টাকা ঢালছে বিজেপি।

ওদিকে ওয়েসির জবাবী হামলা, বাংলায় বিজেপিকে জায়গা করে দেওয়াই ছিলো সবচেয়ে বড়ো সাম্প্রদায়িক রাজনীতি।



আর বিজেপিতো সেই কবে থেকেই মিশন বাংলায় নেমে পড়েছে। তার উচ্চাশাও আকাশছোঁয়া। রাজ্যের ২০০টি আসন দখল। তবে পদ্ম শিবিরের বিহার জয়ের প্রভাব বাংলায় সেভাবে প্রতিফলিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলেই মত বিজেপির একাংশের। আর যেটুকু প্রভাব পড়বে তা সীমাবদ্ধ থাকবে বিহার ঘেঁষা বাংলার সীমান্ত অঞ্চলেই। কিন্তু ওই অঞ্চলের দিকেই হাত বাড়িয়ে বসে আছেন ওয়েসি। তবে বিহার জয় বাংলার বিজেপি কর্মীদের মানসিক বল, উৎসাহ বাড়িয়েছে। এমনটাই দাবি দলের ওপরতলার। কিন্তু সেই উৎসাহে কি ১৬ থেকে ২০০ আসনে পৌঁছনো আদৌ সম্ভব?



ওদিকে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস সেই কবে থেকে বলে চলেছে, রাজ্যপাল অফিসটাই হয়ে গেছে বিজেপির অফিস। রাজ্যপালও বারবার শাসক দলকে বিঁধছেন রাজ্যের আইন শৃঙ্খলার প্রশ্ন তুলে। তৃণমূল সরকারের অভিযোগ, রাজ্যের বকেয়া টাকাপয়সা না চুকিয়ে দিল্লির সরকার স্তব্ধ করে দিয়েছে উন্নয়ন প্রক্রিয়া। ওয়েসি আর পদ্ম কর্তাদের পাশাপাশি বসিয়ে তৃণমূল শিবিরের অভিযোগ, চেষ্টা চলেছে রাজ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানোর। তবে ২২২ আসন দখলে থাকা তৃণমূলের থেকে বাংলার রাজপাট কেড়ে নেওয়াটা কি সত্যিই এতোটাই ছেলেখেলা?


আশাবাদী বিজেপি। তবে ব্যাপারটা যে আদৌ ছেলেখেলা না, তা বুঝতে ভুল হয়নি। তাই মাথা খাটিয়ে ঘুঁটি সাজাতে মন দিয়েছে পদ্ম শিবির। বাংলাকে পাঁচটি অঞ্চলে ভাগ করে পঞ্চপান্ডবের হাতে দায়িত্ব তুলে দিয়েছে বিজেপি। দল কোনও রাজ্যস্তরের নেতার হাতে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চায়নি। পাঁচ কেন্দ্রীয় নেতা সংগঠনকে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত পৌঁছনোর কাজে তদারকি করবেন। একটুও দেরি না করে, ময়দানে নেমে পড়লেন তাঁরা। তাঁদের রিপোর্ট হাতে পেলেই অবস্থা সরেজমিনে দেখতে বাংলায় আসবেন খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।


ওদিকে আবার বিহার নির্বাচন খানিকটা তাঁতিয়ে দিয়েছে বামপন্থীদের। সিপিআই, সিপিএম শূন্য থেকে উঠে এসছে দুই- দুইয়ে। বাংলায় বরং একা সিপিএমের হাতেই আছে ১৯টি আসন। ওদিকে সিপিআই, ফরওয়ার্ড ব্লক, আরএসপি মিলিয়ে আরও পাঁচটি। বামপন্থী শরিকদের সম্মিলিত ২৪টি আসন থেকে মাত্র একটি কম কংগ্রেসের। তবে বাস্তবতার জমিনে দাঁড়িয়ে এক চরম সত্যের উপলব্ধি হয়েছে কংগ্রেস, বামপন্থী দু'পক্ষেরই। তারা বুঝে গেছে, একক ভাবে নির্বাচনী লড়াইয়ে টক্কর দেওয়ার ক্ষমতা কোনও পক্ষেরই নেই। তবে জোট বেঁধেই বা তারা কতদূর এগোতে পারবে? কী আশা করছে বাংলার আলিমুদ্দিন?


খুব বেশি কিছু নিশ্চয়ই না। তাই এবার ফিরে এসছে সেই কংগ্রেস সিপিএমের হাত ধরাধরির ছবি। বামপন্থী দক্ষিণপন্থীদের হাতে হাত মেলানোর ঘটনায় কোনও অনৈতিকতা দেখতে পাচ্ছেন না অধীর রঞ্জন চৌধুরী বা বিমান বসু। কিন্তু অতীতের সূত্র ধরে আজও তাঁরা তৃণমূল কংগ্রেসকে গলা মিলিয়ে দুষছেন, বিজেপির দোসর বলে। আবার এআইএমআইএমকে বেঁধার সময় কংগ্রেস সিপিএম জোটের সুর মিলে যাচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে। ঘটনায় স্পষ্ট, নির্বাচনী বৈতরণী পেরোতে সংখ্যালঘু ভোটারদের পাশে পেতে চাইছে তিন দলই। আর সেই চাওয়াতেই বাদ সাধতে পারে এআইএমআইএম, এমনটাই আশঙ্কা। তিন শিবিরেরই বক্তব্য, বিজেপির ইশারাতেই ভোট কাটাকাটির খেলায় নামতে চলেছেন ওয়েসি।


ওয়েসির ওপর বহুদিনের রাগ পুষে রেখেছে কংগ্রেস। বিহারের রাজ্য রাজনীতিতে ওয়েসির ঢুকে পড়া কংগ্রেসকে মাত দিয়েই। বাংলার সীমান্ত অঞ্চল বিহারের কিষানগঞ্জ আসনেই অভিষেক হয় হায়দরাবাদী এআইএমআইএমের। ওই আসনটি ছিলো কংগ্রেসের জাভেদ আলমের। তিনি লোকসভায় চলে যাওয়ায় আসনটি শূন্য হয়। এরপরেই এলাকায় কংগ্রেসের যথেষ্ট প্রভাব থাকা সত্ত্বেও, ২০১৯ সালের উপনির্বাচনে বিজেপির সুইটি সিংকে হারিয়ে কিষানগঞ্জ বিধানসভার দখল নেয় এআইএমআইএম প্রার্থী কামরুল হোদা। সদ্যসমাপ্ত বিহার নির্বাচনেও কংগ্রেসের দুটি আসন ছিনিয়ে নেয় ওয়েসির দল।


বাংলায় এবার সেই ওয়েসির মুখোমুখী হতে চলেছেন অধীর রঞ্জন চৌধুরী। গোড়াতেই ওয়েসি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির দিকে - মুর্শিদাবাদে সংখ্যালঘুদের দুর্দশার জবাব দিতে হবে অধীর রঞ্জন চৌধুরীকেই। সাবধানী অধীরও এআইএমআইএমকে 'রাজাকারের দল' বলে দূরে সরিয়ে রাখতে চেষ্টা চালাচ্ছেন ওয়েসিকে। ওদিকে বহু আগেই কংগ্রেসের সেকুলার ভাবমূর্তি নিয়ে মন্তব্য করতে মহারাষ্ট্রের প্রসঙ্গ টেনে এনে ওয়েসি বলেছিলেন, "মহারাষ্ট্রে ক্ষমতার শরিক হতে শিবসেনার কোলে বসেছে কংগ্রেস।"


রাজ্যের সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক নিজেদের অনুকূলে ফিরিয়ে আনতে আবদুল মান্নানকে সঙ্গে নিয়ে অধীর রঞ্জন পৌঁছে গেছিলেন ফুরফুরা শরিফে। সেখানে ত্বহা সিদ্দিকির দেখা না পেয়েই ফিরতে হলো তাঁদের। প্রশ্ন উঠেছে, বাংলার রাজ্য রাজনীতিতে কংগ্রেস সিপিএম জুটির প্রাসঙ্গিকতা আজ ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়ে। সেক্ষেত্রে এআইএমএমের মতো, কংগ্রেস সিপিএম জুটিও রাজ্যের বিজেপি বিরোধী আর সংখ্যালঘু ভোট কাটা ছাড়া বিশেষ কিছু করতে পারবে বলে মনে হয় না। যাতে সরাসরি লোকসান হবে তৃণমূল কংগ্রেসের। আর পরিস্থিতির ফায়দা তুলবে বিজেপি। ঠিক এই পরিস্থিতির জন্যই বিহারে পিছিয়ে পড়তে হয়েছিল রাষ্ট্রীয় জনতা দলকে।

ওদিকে তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যের অতীত নির্বাচনেও বিজেপির বাড়বাড়ন্তের জন্য বারবার আঙুল তুলেছিল সিপিএমের দিকে। অভিযোগ ছিলো, বাম ভোট রামের ভোটবাক্স ভরছে। এদিকে এই পরিস্থিতির মধ্যেই সিপিএমের কপালের ভাঁজ বাড়িয়ে বসলেন দলের এক ওয়ার্ড কোঅর্ডিনেটর রিঙ্কু নস্কর। লাল পতাকা ফেলে তিনি হাতে তুলে নিলেন গেরুয়া পতাকা।


কথায় আছে বড় গাছেই ঝড়ের ঝাপটা বেশি লাগে। সংখ্যাতত্ত্বে বাংলার রাজনীতিতে এখন বড় গাছ বলতে একটাই। তৃণমূল কংগ্রেস। এআইএমআইএম আর বিজেপি'র ঝড় সামলাতে হবে শাসক দলকেই। তবে আদৌ কি ঝড় তুলতে পারবে এআইএমআইএম অথবা বিজেপি? কারণ এআইএমআইএম নির্বাচনী ময়দানে ব্যাট করতে নামছে শূন্য হাতে। অন্যদিকে বিজেপির হাতে মাত্র ১৬টি আসন। তবে চেষ্টার ত্রুটি রাখছে না কোনও পক্ষই।

ইতিমধ্যেই বাংলার ২২ জেলায় এআইএমআইএম দপ্তর খুলে বসেছে বলে জাতীয় সংবাদ চ্যানেলের খবর। দলের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে শলা পরামর্শ করে ডিসেম্বরেই জনসভা শুরু করতে পারেন ওয়েসি। তাঁর উৎসাহে ইন্ধন জোগাতে পারে দিলীপ ঘোষের বক্তব্য। সংখ্যালঘুর দরদী হয়ে বিরোধী শিবিরকে বিঁধতে তিনি ইতিমধ্যেই বলেছেন, "মুসলিম বানিয়ে রেখেছেন। ভারতীয় হতে দেননি।" এই অবস্থার খেসারত দিতেই এআইএমআইএমের বোলবালা বলে মন্তব্য করেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি।



সব মিলিয়ে ইতিমধ্যেই বাংলার নির্বাচনী ঢাকে কাঠি পড়েছে। ব্যস্ততা শুরু হয়েছে যে যার মতো ঘর সাজিয়ে তোলার কাজে। সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক নিয়ে এতো কাড়াকাড়ির মধ্যেও খানিকটা নিশ্চিন্ত পদ্ম শিবির। কারণ তাদের টার্গেট রাজ্যের অবশিষ্ট ৭৩ শতাংশ সংখ্যগুরু ভোটব্যাঙ্ক। বাংলায় গুজরাত মডেল আনার শ্লোগান দিয়েছেন দিলীপ। যার তীব্র বিরোধিতা করে তৃণমূল কংগ্রেসের জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক সাফ বলেছেন, "গুজরাতকে মানুষ চেনে দাঙ্গার নামে। ওই মডেল দিয়ে বাংলা দখল করা অসম্ভব।" ওদিকে রাজনৈতিক শত্রুশিবির মোকাবিলায় তৃণমূল কংগ্রেসের মাস্টারপ্ল্যান কষে চলেছেন পিকে। লড়াই এবার ফুলে ফুলে। জোড়া ফুল বনাম পদ্ম ফুল। বাংলার জমিতে এবার কোন ফুল ফোঁটে সেটাই দেখার।

মন্তব্যসমূহ