দিন প্রতিদিন বিশেষ

দীপান্বিতার  আরাধনা 


উত্তর কলকাতার প্রামানিক ঘাট রোডের মা ব্রহ্মময়ী কালীকে 

ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ মাসি বলে ডাকতেন




( প্রামানিক ঘাট রোডের দে বাড়ির মা ব্রহ্মময়ীকে মাসি বলে ডাকতেন রামকৃষ্ণ। নানা অজানা কথা স্মৃতি চারণায় লিখলেন শান্তিনিকেতনের প্রবীনা আশ্রমিক সুমিত্রা খাঁ ( দে ) )

বাংলার প্রামানিক (দে) বংশের দুই ঠিকানার দয়াল পুরুষ শ্রী দূর্গাপ্রসাদ আর শ্রী রামগোপাল মহাশয়ের প্রচেষ্টায় এই শিব কালী মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়, যা পরবর্তী সময়ে ব্রহ্মময়ী কালী নামে খ্যাত।



১৮৫২ সালে ( বাংলার ১২৫৯ ) মাঘী পূর্ণিমায় এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা । প্রবেশ পথের দু পাশে চারটি শিব মন্দির। দুটি ছোট ও দুটি বড়। তারপর মা ভবতারিনীর মূল মন্দির।

দক্ষিণেশ্বরের রানী রাসমনি কালী বাড়ি প্রতিষ্ঠার তিন বছর আগে শ্রী শ্রী ব্রহ্মময়ী কালী বাড়ির প্রতিষ্ঠা। একই ভাস্কর এই দুই মূর্তি খোদাই করেছিলেন। দাইহাট নিবাসী নবীন ভাস্কর এই দুই মায়ের দুপ দেন। ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ দক্ষিনেশ্বরের মাকে ‘মা’ বলে ডাকতেন । আর মা ব্রহ্মময়ীকে ‘ মাসি’ বলে ডাকতেন।

জনসাধারণের চোখে ব্রহ্মময়ী কালী বাড়ি হল আমাদের চোখে , আমাদের কালীবাড়ি যা আমাদের পূর্ব পুরুষরাই প্রতিষ্ঠা করেন। যেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক ছোট বেলার মধুর স্মৃতি। আমার ঠাকুমার ( সরসী বালা দে ) নানান কর্মকান্ড  মনে পড়ে। আমাদের কালীবাড়ির নানান গল্প ঠাকুমার কাছেই শোনা । প্রামানিক ঘাট রোডস্থ আমাদের বাড়ির নীচের তলায় একটি ঘরে মা ব্রহ্মময়ীর মুর্তি খোদাই হয়। শুনেছি যতদিন না মায়ের পুর্ণ রূপ পেয়েছে , ততদিন মায়ের ভক্ত বন্ধ ঘরের দরজার সামনে বারান্দায় ,সামনে বা রাস্তায় ধন্যা দিয়ে পড়েছিলেন। আজ ঐ বাড়িতে বসবাস করেন মায়ের সেই ভক্তের বংশধরেরা।

ছোটবালায় ঠাকুমার কাছেই শোনা গল্প , আজো যেন সব চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে ওঠে। ভেসে ওঠে কালীপুজোর দিন সারাদিন কত ধুমধাম করে পুজো হত , সেই সব স্মৃতি ।অবাক চোখে তখন পাঁঠা বলি দেখতাম। পাঁঠাকে স্নান করিয়ে ফুলের মালা পরিয়ে , পুরোহিত মশাই  মন্ত্রোচ্চারণ করে পাঁঠাকে বলির উদ্দেশ্যে নিবেদন করার পর ঢাক-ঢোল – কাঁসি বেজে উঠত। আর পাঁঠার , ব্যা- ব্যা ... করুণ শব্দের সুরে চারিদিকটা কেমন যেন হয়ে উঠত। পাঁঠাকে নিবেদন করার শেষ। সে এক বিরল দৃশ্যের মুখোমুখি হতে হত আমাদের। আজো মনে পড়লে শিহরণ জাগে।

পুজো শেষ হলে হলে রাতে ঠাকুমাকে দেখতাম মন্দিরের দালানের নীচে বাবু হয়ে বসতেন। মাথায় আর দু’হাতে ধুনি জ্বালানো অবস্থায় থাকতেন । সে ও এক অপূর্ব দৃশ্য! আজও চোখে ভাসে। সংসারের মঙ্গলের জন্য প্রতি বছরই কালীপূজোর রাত্রে ঠাকুমা এভাবে অনেকক্ষণ চোখ বুজে থাকতেন। তাঁর মাথা ও দুই হাতের চেটোতে মালসায় আগুন জ্বলতো। সেও এক বিরল দৃশ্য! এরপর ঠাকুমাকে ধরে ,তুলে নিয়ে আসতাম বাড়িতে । তারপর ঠাকুমার সারাদিনের নির্জলা উপবাস ভঙ্গ হত।



আজো ভাবলে বিস্ময় জাগে , প্রামানিক ঘাট রোডস্থ এই ব্রহ্মময়ী কালিবাড়িতে ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেব প্রায়ই আসতেন। আমাদের বাড়ির সামনে দিয়েই মন্দিরে যেতেন, তিনি এই মা ব্রহ্মময়ীকে মাসি বলেই ডেকে একবার দেখা করে যেতেন।

এই কালী বাড়ির কাছেই রামকৃষ্ণ মহাশ্মশান । যে পুণ্যভূমিতে রামকৃষ্ণ দেবকে দাহ করা হয়। ঠাকুমার কাছে এও শুনেছি , সারদা মায়ের শব্দেহ আমাদের বাড়ির সামনে দিয়েই নিয়ে যাওয়া হয় । ঠাকুমাও চাক্ষুষ দর্শন করেন , হাতে হোগলাপাকের বালা পরিহিতা , রানীর সাজে সেজে ,এই বাড়ির সামনে দিয়েই শেষ যাত্রায় যায়। দুটি নৌকা জুড়ে সারদামাকে আমাদের ঘাটের ওপর পাড়ে ,বেলুড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই তাঁকে দাহ করা হয়। এই পাড় থেকে আমার ঠাকুমা মায়ের সেই বিলীন হয়ে যাওয়া দর্শন করেন। ঐ দাহের স্থানেই গড়ে ওঠে মায়ের মন্দির। আজ সেই স্থানটি সবার কাছে শ্রদ্ধা জানাবার একটি পীঠস্থান।

ব্রহ্মময়ী মা আজো আমাদের আমাদের সকলের বাসনা পূর্ন করেন। আজো আমাদের কালীবাড়িতে ঠাকুমা , বাবা ও মায়ের কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। বাবার শরীর সুস্থতার জন্য এই মায়ের কাছে আমার মা একদিন বুক চিড়ে রক্ত দিয়েছেন। বাবাও ব্রহ্মময়ী মায়ের কৃপায় মৃত্যু মুখ থেকে  ফিরে এসেছিলেন।

এই কালীবাড়িতে প্রায়ই মায়ের নামগান হোত। কালীকির্তনে ভরে উঠতো কালিবাড়ির চারিপাশ। এই কালী কীর্তন সঞ্চালনা করতেন আমার বাবা, শ্রী গৌর হরি দে । তিনি ছিলেন শ্রদ্ধেয় কৃষ্ণচন্দ্র দে’র ছাত্র। ঐ আসরে আমিও গলা মেলাতাম।

“ মা তুমি কেউ জানে না

তোমায় জানা লোকে বলছে নানা” ...।“

আমাদের কালীবাড়ি তথা ব্রহ্মময়ী কালীর অনেক তথ্য নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও আমার চোখে, ঠাকুমার থেকে শোনা , আমাদের কালীবাড়ির স্মৃতিচারণ করলাম।

আজো গাইতে ইচ্ছা করে সেই দিনের মত , বাবার সাথে গলা মিলিয়ে –

“ দে মা শ্যামা চরণ দুটি,

আমার সাধন ভজন সব ছুটে যায়

ভবের লেঠায় পাইমা ছুটি।“   


মন্তব্যসমূহ