রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন

 

আমাদের নিয়মিত সাহিত্য সাধনার দিন প্রতিদিন  




আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিকপত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম । আজ তাঁর ধারাবাহিক থেকে একটু চোখ ফিরিয়ে আবার স্বাদ নিই  ধারাবাহিক উপন্যাসের।এবার থেকে  প্রতি রবিবার প্রকাশিত হবে এক একটি পর্ব। কারণ কিছুই নয় সন্দীপের উপন্যাসের এক একটি অধ্যায় মানে এক একটি গল্প। তাই রবিবাসরীয় একটা সাহিত্যের আড্ডা ভরানো থাক সন্দীপের উপন্যাসে।   


ঝুলবারান্দার নীচে #৩৫



সন্দীপ চক্রবর্তী

সদাশিবদা ফিরলেন না দেখে আমার মন কেমন যেন চুপ করে গেল। ভাবলাম যাই, একবার দেখি। কোথায় গেল মানুষটা। পরে মনে হল, না থাক। সদাশিবদা একজন আর্টিস্ট। জীবনের দান মাথায় ছুঁইয়ে আপন করে নিতে জানেন। নিজেকে আবিষ্কারের এই যন্ত্রণাও একদিন তার নিজস্ব হয়ে যাবে।
ফিরে এলাম নিজের ঘরটিতে। আজ সকলেই ক্লান্ত। রাতের খাওয়ার ডাক এসে গেল তাড়াতাড়ি৷ সবাই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়তে চায়। একটা বেশ বড়ো ঘরে খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। ডাইনিং টেবিলে আমি আর রজত পাশাপাশি। রজত বলল, ছবির সঙ্গে কথা হল?
ধুর ও সেদিন ঠাট্টা করছিল। আমার সঙ্গে ওর কী কথা থাকতে পারে?
তুই ওকে চিনিস না সন্দীপ। লেখকদের ওপর ওর বরাবরের দুর্বলতা। বিশেষ করে তোর ওপর। যদি বলি, শি লাভস ইউ, একমাত্র তা হলেই বোধহয় সত্যিটা বলা হয়।
অবাক হয়ে বললাম, আবার তুই তোর সেই বিখ্যাত লেগপুলিং শুরু করলি! যাত্রিকের অফিসে দেখার আগে ও তো আমাকে চিনতই না।
চিনত। তোর সব বই ওর পড়া। একবার নয় বহুবার পড়া। গত বছর আমাকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিল, আমি তোকে চিনি কিনা। তখন আমি কিছুই জানতাম না। বলেছিলাম চিনি। তুই আমার কলেজের বন্ধু। তারপর ও আমায় সব কথা বলে। ভালোবাসার কথাও। তাই বলছি, সাবধানে থাকিস।
দীর্ঘ দুই দশকের লেখক জীবনে বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। এমনকী প্রেমপত্রও পেয়েছি কয়েকবার। কলেজে পড়া একটি মেয়ে একবার চিঠির সঙ্গে গোলাপের পাপড়ি পাঠিয়েছিল। আর একবার এক বিবাহিত মহিলা প্রস্তাব দিয়েছিলেন লং ড্রাইভে যাওয়ার। এর বাইরেও আরও অনেক ঘটনা আছে। আমি তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের বোঝার চেষ্টা করেছি। এখন তারা জানেন একজন লেখক তার লেখায় যতই রোম্যান্টিক হোন, ব্যক্তিগত জীবনে তেমন নাও হতে পারেন। তাই বললাম, এটা এমন কিছু সিরিয়াস ব্যাপার নয় রজত। গল্প-উপন্যাস পড়ে লেখকের প্রতি এরকম মোহ অনেকেরই জন্মায়। আবার কেটেও যায়। কিন্তু একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না, তুই বারবার আমাকে সাবধানে থাকতে বলছিস কেন?
কারণ শি ইজ হাংরি। হাংরি ফর লাভ। ওর ভালোবাসা কেমন জানিস? যার কোনও পরিণতি নেই। ছবি বিয়েতে বিশ্বাস করে না। ওর কাছে ভালোবাসা মানে শুধুই শরীর। সমস্যাটা সেখানেই। তুই ওকে অ্যাকসেপ্ট করতে পারবি না। আর ও তোকে আঁচড়ে-কামড়ে শেষ করে দেবে।
মনে হল রজত বোধহয় আমাকে এখনও সেই কলেজে পড়া ছেলেটা ভাবছে। ওর অবশ্য দোষ নেই। ও তো আর জানে না যে আমার কাছে মোহর আছে। তরল আলতা কিনে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি আছে। আমাকে শেষ করা অত সহজ নয়। হেসে বললাম, তুই নিশ্চিন্ত থাক রজত। ছবির ফ্যান্টাসি যদি আমাকে নিয়ে হয় তা হলে তা একদিন শেষ হবেই। । তবে এসব কথা কলকাতাতেই তোর আমাকে বলা উচিত ছিল৷ তা হলে হয়তো আমি আসতামই না।
আমি ইচ্ছে করেই বলিনি। কারণ তুই ছাড়া ওর ফ্যান্টাসি আর কেউ ভাঙতে পারবে না। আমি চেষ্টা করেছিলাম। হয়নি। ওকে বোঝাতেই পারিনি তোর কাছে ভালোবাসা মানে সমর্পণ। শরীর নয়। ও কী বলে জানিস? বলে, সন্দীপদা আপাদমস্তক রোম্যান্টিক। মানে মৌমাছি। আর আমি তাজা গোলাপ৷ ফুল কখনও মৌমাছিকে ঘরসংসারের ফাঁদে ফেলে বেঁধে রাখে না। উই আর মেড ফর ইচ আদার।
রোমান্সের এমন ব্যাখ্যা আগে কখনও শুনিনি। কিন্তু আমি কিছু বললাম না। বলে কোনও লাভও নেই। ছবি যদি সত্যিই আসে তো যা বলার ওকেই আমি বলব। যেটুকু বোঝার ওর কাছ থেকেই বুঝব।
আমার কিছু বলার মতো না থাকলেও রজতের ছিল। কেউ যাতে শুনতে না পায় এমনই ভঙ্গিতে ও বলল, তোর কাছে আমার একটাই অনুরোধ সন্দীপ। মেয়েটা ট্যালেন্টেড। এখনই স্টারের মর্যাদা পায়। লেগে থাকলে একদিন হয়তো সুপারস্টারও হয়ে যাবে। যাতে ও ডিফোকাসড না হয়ে যায় সেটা শুধু দেখিস।
রজত প্রোডিউসার। ছবি হিরোইন। ওর ভাগ্য ওকে লিপিকা ঘোষের ভবিতব্যের দিকে নিয়ে যায়নি দেখে মনটা খুশিতে ভরে গেল। রজতের প্রতি আমার শ্রদ্ধাও বেড়ে গেল। পেশাদারি সম্পর্কে আজকাল কে আর এমন সহমর্মী হয়ে উঠতে পারে! বললাম, তুই নিশ্চিন্ত থাক। আমি আছি তো।
জীবন আমাকে আরও একবার দুরূহ বাঁকের সামনে এনে ফেলল। একদিন বসন্ত কবিরাজ মোহরকে স্বপ্ন দেখানোর ভার দিয়েছিলেন আমার হাতে। সে দায়িত্ব আমি পালন করতে পেরেছি কিনা মোহর বলতে পারবে। আমি শুধু এইটুকু বলতে পারি, সেদিনের মোহর আর আজকের মোহর এক নয়। কিন্তু আজ রজত যে দায়িত্ব দিল তার ভারও কি কম? আমি কি পারব মোহরের মতো ছবিকেও ওর ঠাকুরঘরে পৌঁছে দিতে? আমি মানুষ দেখতে বেরিয়েছি। মানুষের ডাক উপেক্ষা করতে আমি পারি না। ছবি আমাকে নিয়ে ফ্যান্টাসির জগৎ তৈরি করেছে। ভালোবাসার ফ্যান্টাসি। সুতরাং ভালোবেসেই আমাকে ওর ভালোবাসায় আঘাত করতে হবে। বলতে হবে, ছবি খেলনা নিয়ে মেতে থেকো না। খেলায় মাতো। দেখবে, একদিন কেউ--সত্যিকারের কেউ তোমার খেলার এবং খেলাঘরের সঙ্গী হবে। প্রত্যেকের জন্যই কেউ না কেউ আসে ছবি। শুধু তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। সে এলে তার ডাক চিনতে হয়। তারপর মনের দরজা খুলে দিতে হয়। রাজাধিরাজ সে। তার মাথায় সোনার মুকুট। কিন্তু তোমার সামনে দাঁড়িয়ে সে মুকুট খুলে ফেলবে। নতজানু হবে কাঙালের মতো। ভালোবাসার নারীর কাছে সব পুরুষকেই কাঙাল হতে হয়। তোমার জন্য যে কাঙাল হতে পারবে, জানবে, সেই তোমার প্রেমিক। আমি নই।
ফরাসে শুয়ে শুয়ে ছবির কথাই ভাবছিলাম। কী বলব! কীভাবে বলব! ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। সংবিৎ ফিরল ছবির ডাকে, সন্দীপদা আলো জ্বেলেই ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?
মনে হয়েছিল ছবি আজই আসবে। কারণ আজকের মতো নিরিবিলি রাত ও রোজ পাবে না। সুতরাং আমি মনে মনে তৈরিই ছিলাম। তবে অন্য একটা ব্যাপার আমাকে বিস্মিত করল। একদিনেই আমাকে আপনি থেকে তুমিতে নামিয়ে ফেলেছে ছবি। ওর দিক থেকে দেখলে এটা খুবই স্বাভাবিক। ভালোবাসার পৃথিবীতে আপনি-আজ্ঞের দূরত্ব চলে না। বললাম, আমি ঘুমোইনি। কিছু বলবে?
বলতে তো চাই। কিন্তু তুমি যদি দরজা বন্ধ করে রাখো তা হলে কী করে বলি!
দরজা খোলা। চলে এসো।
ছবি ভেতরে এল। ওকে দেখে একটা অদ্ভুত অস্বস্তি হল। রাতপোশাকেই রাত দুটোর সময় আমার কাছে চলে এসেছে ছবি। হাউসকোটটা পর্যন্ত চাপায়নি। ঘরের আলোটা কম পাওয়ারের। তবু সেই আলোতেই চকচক করছে ওর গম রঙা ত্বক। রাতপোশাকের সামান্য আড়াল উপেক্ষা করে উপচে পড়ছে ওর মাদকতাময় শরীর। ভারী দুটি বুকের মাঝখানে সরু ও গভীর খাদটি বিপজ্জনক ভাবে হাঁ করে আছে৷ ডান হাতে ধরা বিয়ারের মগটি একপাশে রেখে ছবি ফরাসে পা ছড়িয়ে বসল। মনে হল আগুন লাগল ছোট্ট ঘরটাতে৷ এই আগুনকে যদি বশে রাখা না যায় তা হলে সে সারা পৃথিবীকে ছারখার করে দেবে। আর সেই বশীকরণের কাজটা করতে হবে আমাকেই।
কী হল! ভয় পেলে নাকি? জিজ্ঞাসা করল ছবি।
আমি নিস্পৃহ। নিরুত্তাপ। বললাম, ভয় আমি পাই না ছবি। শুধু অবাক হই। জীবন আমাকে শুধু বিস্মিত করে।
ছবি বিয়ারে চুমুক দিয়ে বলল, উঁহু। তুমি শুধু অবাক হও না, অবাক করতেও পারো। তোমার লেখা আমাকে অবাক করে। তোমার সব কবিতা আমার পড়া। মুখস্থ বলতে পারো। কত বছর ধরে পড়ছি। কিন্তু যখনই পড়ি নতুন করে অবাক হই। আর তোমার ওই রংপেন্সিল গল্পটা--- পড়ে আমি সারারাত কেঁদেছিলাম। তোমার নায়ক আনন্দময় যেমন তার বউ আর মেয়েকে নিয়ে ফ্যান্টাসি বানিয়েছিল, আমিও তোমাকে নিয়ে বানিয়েছি। বিয়ে-ফিয়েতে আমার কোনও বিশ্বাস নেই। কল্পনায় আমি তোমাকে আদর করি। তোমার সঙ্গে সেক্স করি। সে যে কী আনন্দ আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না। আমার সারা শরীর ভিজে যায়। আমি নদীর মতো বয়ে যাই৷
আমাকে কল্পনা করে তুমি নদী হয়ে যাও শুনে খুব খুশি হলাম। কিন্তু রাত অনেক হল। এবার ঘরে যাও। বাকি কথা কাল হবে।
না সন্দীপদা। আমার হাতে সময় কম। আমাকে যা বলার আজ-- এখনই বলতে হবে। তুমি আমাকে হয়তো খারাপ মেয়ে ভাবছ। বেহায়া ভাবছ। ভাবো, তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। কথাটা আমায় আজই বলতে হবে৷
কী এমন কথা যা তোমাকে আজই বলতে হবে?
আই লাভ ইউ সন্দীপদা৷ খুব খুব ভালোবাসি তোমায়। তোমার জন্য যদি মরতে বলো আমি নির্দ্বিধায় মরে যাব৷ কিন্তু তোমাকে ছাড়তে পারব না। আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো না। বাট সো হোয়াট! আমি তো বাসি। সেটাই যথেষ্ট। আর সেই জোরেই বলছি, তোমাকে আমার চাই। তোমার কোনও আপত্তি আমি শুনব না। আমার চাই মানে চাই। এরপর আর কোনও কথা হবে না।
জীবনে বহু বিচিত্র মানুষ দেখেছি। কিন্তু ছবির মতো মানুষ খুব বেশি দেখিনি। ক্রমাগত আত্মরতি বোধহয় মানুষকে এরকম উন্মাদ করে দেয়। যখন আয়নায় সে নিজেকে ছাড়া আর কিছু দেখতে পায় না। কিছুক্ষণ চিন্তা করলাম। তারপর মনস্থির করে হাত রাখলাম ওর কাঁধে। বললাম, তোমার আবেগকে আমি শ্রদ্ধা করি ছবি। কিন্তু আজ আর কোনও কথা নয়। তুমি ঘরে যাও। কাল আমি আবার তোমার সঙ্গে কথা বলব।
বলবে তো?
বলব।
ছবি দেওয়াল ধরে উঠে দাঁড়াল। তারপর টলতে টলতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
(ক্রমশ)

মন্তব্যসমূহ