দিন প্রতিদিন বিশেষ

 বিহার নির্বাচন বিশেষ

।। ভোট কাটাকাটি নিয়ে কপালে ভাঁজ নীতিশ, তেজস্বীর ।।



কাজল ভট্টাচার্য, কলকাতা, ৭  নভেম্বর 


"অন্ত ভলা তো সব ভলা," বলেছেন নীতিশ কুমার।
সব ভালো যার শেষ ভালো। কিন্তু সেই ভালোর পথে বাধাটা কী? লালুপ্রসাদ যাদব নিজে নির্বাচনী কুরুক্ষেত্রে না থাকলেও, আছেন লালুপুত্র তেজস্বী আর তাঁর রাষ্ট্রীয় জনতা দল। তবে তেজস্বীকে যতটা না ভয়, তারচেয়েও বেশি ভয় লালুপ্রসাদের পুরনো 'এম- ওয়াই' সমীকরণকে। মুসলিম যাদব ভোটব্যাঙ্ক।
সেই ভয় এড়াতেই কি শেষদিনের নির্বাচনী প্রচারের শেষ মুহূর্তে নীতিশ বললেন- ইয়ে মেরা অন্তিম চুনাও হ্যায়? গত পনেরো বছরের সুশাসনের ওপর ভরসা না রাখতে পেরে, শেষ পর্যন্ত আবেগে সুড়সুড়ির চেষ্টা 'সুশাসনবাবু'র।
আবার শেষদফার নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং, দলের সভাপতি জয় প্রকাশ নড্ডার মতো হেভিওয়েটদের প্রচারে নামিয়েও স্বস্তি পায়নি পদ্ম শিবির। উত্তর প্রদেশ থেকে উড়িয়ে আনতে হয়েছিলো মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকেও? তাহলে কি পিতৃসূত্রে পাওয়া তেজস্বীর মুসলিম- যাদব ভোটব্যাঙ্কের জবাবী হামলায় ভোট মেরুকরণের চেষ্টা চালিয়েছিলো বিজেপি?
হতে পারে। তবে সেরকম কোনও ঝুঁকির পথে পা বাড়াতে চাননি নীতিশ কুমার। বরং নাগরিক বিল নিয়ে যোগী আদিত্যনাথ মুখ খুলতেই, তিনি সরাসরি তাঁর কড়া বিরোধ করেন। ঘটনায় স্পষ্ট, এমুহূর্তে সীমান্ত অঞ্চলে কোনও বিতর্ক তৈরি করতে চাইছেন না নীতিশ।
তবে এই রণকৌশলের লাভ কে ঘরে তুললো, তা বোঝা যাবে আগামী দশ তারিখের পরেই।





শনিবার তৃতীয় এবং শেষ দফার ভোটে মতদান হলো উত্তর বিহার, নেপাল পশ্চিমবাংলা ঘেঁষা বিহারের সীমান্ত অঞ্চলের। আগের দু'দফা ভোটে যে জায়গাগুলিতে ভোট নেওয়া হয়েছিল, সে জায়গাগুলির আর্থ- সামাজিক, রাজনৈতিক চরিত্র ছিলো অনেকটাই আলাদা। রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহলের মত, শনিবারের ভোটের নিয়ন্ত্রক লালুপ্রসাদ যাদবের মুসলিম- যাদব ভোটব্যাঙ্ক। সীমান্ত অঞ্চলের যে ২৪টি বিধানসভা কেন্দ্রে ভোট হলো, সেগুলিতে লালুপ্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দলের ব্যাপক প্রভাব। অল্পবিস্তর প্রভাব আছে কংগ্রেসেরও। মুসলিম অধ্যুষিত ওই কেন্দ্রগুলিতে এর আগে রাষ্ট্রীয় জনতা দল অনেকটাই একতরফা ভোট পেলেও, এবার পথের কাঁটা হবে আসাদুদ্দিন ওয়েসির এআইএমআইএম। ওয়েসি যতোই ভোট কাটবে, ততোই সুবিধাজনক অবস্থায় পৌঁছে যাবে এনডিএ, মন্তব্য রাজনৈতিক ওয়াকিবহাল মহলের।

পাঁচবছর আগের নির্বাচনে নেপাল, পশ্চিম বাংলাঘেঁষা সীমান্ত অঞ্চলের ২৪টি আসনের মধ্যে বিজেপি, নীতিশ কুমারের জনতা দল ইউনাইটেড দুই শিবিরই ছ'টি করে আসন কবজা করতে পেরেছিল। তবে গতবার নীতিশ কুমার লালুপ্রসাদের আরজেডি, কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মহাজোটের হয়ে নির্বাচনী ময়দানে নেমেছিলেন। এবার সেই সমীকরণ পালটে নীতিশের সঙ্গী বিজেপি। তাই শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কী দাঁড়ায়, তা নিয়ে চাপা উদ্বেগ ভর করেছে প্রতিটি শিবিরেই।
আসাদুদ্দিন ওয়েসি নামের পথের কাঁটাকে মোটেই হালকা করে দেখছে না মহাজোট। কংগ্রেস তাঁর গায়ে সরাসরি সীলমোহর দেগে দিয়েছে- বিজেপির লোক। ওয়েসির দল আর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘকে বলেছে একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। ওদিকে তেজস্বী যাদবের মন্তব্য, বিজেপি'র বি টিম ওয়েসির দল।

এনডিএ জোটের শরিক বিজেপি'র কাছে চ্যালেঞ্জ মিথিলাঞ্চলের ৩৪ আসন। গত বিধানসভা নির্বাচনে ওই অঞ্চলের পূর্ব আর পশ্চিম চম্পারন জেলার ১১ আসনের মধ্যে মাত্র ছটি পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল বিজেপিকে। দারভাঙ্গা, মধুবনিতেও মুসলিম ভোটারের সংখ্যা নেহাত মন্দ নয়। সীমান্ত অঞ্চলের পাশাপাশি মিথিলাঞ্চলের ভোটব্যাঙ্কে ওয়েসি কতটা থাবা বসাতে পারেন, তার ওপর তৃতীয় দফার ভোটের অনেককিছুই নির্ভর করছে। মোট ১৩টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে ওয়েসি'র এআইএমআইএম। গতবছরের অক্টোবরে উপনির্বাচনে সীমান্ত অঞ্চলের কিষানগঞ্জ বিধানসভা দখল করে, ইতিমধ্যেই বিহার রাজ্য- রাজনীতিতে পা রেখেছেন ওয়েসি। এবার তার নজর আরও প্রসারিত। তার ওপর এই নির্বাচনে ওয়েসির সঙ্গী মায়াবতীর বহুজন সমাজবাদী পার্টি, উপেন্দ্র কুশওয়াহার আরএলএসপি, দেবেন্দ্র যাদবের সমাজবাদী জনতা দল। মোট ছয় শরিকের এই গ্র্যান্ড সেকুলার ডেমোক্রাটিক ফ্রন্ট রক্তচাপ বাড়িয়ে দিয়েছে মহাজোটের।\



ওদিকে চিরাগ পাসোয়ানের নজর সমস্তিপুর জেলার পাঁচ আসন। আরজেডি, জেডিইউ গত বিধানসভায় ভালো ফল করলেও, লোকসভা নির্বাচনে পর্যাপ্ত সংখ্যায় ভোট পেয়েছিল প্রয়াত রামবিলাস পাসোয়ানের লোক জনশক্তি পার্টি। চিরাগের মতোই আশার দোলাচলে দুলছে নীতিশ মন্ত্রিসভার বারো মন্ত্রীর ভাগ্য। আজকের ভোটের ওপরেই নির্ভর করছে রাষ্ট্রীয় জনতা দলের লাভলি আনন্দ, শরদ যাদব কন্যা সুভাষিনী যাদবের মতো হেভিওয়েট প্রার্থীর ভাগ্য।


মোট ২৪৩ আসনের বিহার বিধানসভায় সরকার গড়তে দরকার কমপক্ষে ১২২ আসন। আগের দু'দফায় ১৬৫ আসনের ভোটে লড়াই ছিলো ত্রিমুখী। এনডিএ'র সঙ্গে সরাসরি লড়াই ছিলো মহাজোটের। ওদিকে এনডিএ, মহাজোটকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ময়দানে নেমেছিল লোক জনশক্তি পার্টি। শনিবারের তৃতীয় এবং শেষ দফার লড়াইকে বহুমুখী করে তুলতে সামিল হয়েছে গ্র্যান্ড সেকুলার ডেমোক্রাটিক ফ্রন্ট।

আজ উত্তর বিহার আর সীমান্ত অঞ্চলের ১৫ জেলার যে ৭৮ বিধানসভা কেন্দ্রে ভোট হলো, ২০১৫ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ওই আসনের ৫৪টি দখল করেছিল মহাজোট। যার অনেকগুলিই রাষ্ট্রীয় জনতা দলের দুর্গ বলে পরিচিত। কংগ্রেস, রাষ্ট্রীয় জনতা দলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নীতিশের জনতা দল ইউনাইটেড জয় করেছিল ২৪টি আসন। মোট ২০টি আসন পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে ছিলো লালুপুত্র তেজস্বীর রাষ্ট্রীয় জনতা দল। কংগ্রেসের হাতে এসছিলো ১০টি আসন। অন্যদিকে বিজেপি দখল করে ১৯টি আসন।

এবারের নয়া সমীকরণে ৭৮ বিধানসভায় লড়াই চালালেন মোট এক হাজার দুশো সাতজন প্রার্থী। এরমধ্যে এনডিএ জোট শরিকদল বিজেপি'র ৩৫, জনতা দল ইউনাইটেডের ৩৭, বিকাশশীল ইনসান পার্টির পাঁচ আর হিন্দুস্তান আওয়াম মোর্চার একজন প্রার্থী ছিলেন। এঁদের সঙ্গে লড়াই চললো কংগ্রেসের ২৫ রাষ্ট্রীয় জনতা দলের ৪৬, সিপিআই- এমএল(লেনিনবাদী)- এর পাঁচ আর সিপিআইয়ের দুই প্রার্থী।

বিহারের অন্য অংশের চেয়ে উত্তর বিহার, সীমান্ত অঞ্চলের মেজাজ যে অনেকটাই আলাদা তা বোঝা গেল শেষ দফার ভোটে। আগের দু'দফা ভোট নির্বিঘ্নে হলেও, তৃতীয় দফার ভোটে অশান্তি পুরোপুরি এড়ানো গেলো না। পূর্ণিয়ার ধমদাহা বুথে মতদান চলার সময় ভোটারদের সঙ্গে ব্যাপক ঝামেলা বাঁধে সুরক্ষা বলের। লাঠিচার্জ করেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে, শেষ পর্যন্ত শূন্যে গুলি চালাতে বাধ্য হন সুরক্ষা বলের জওয়ানরা। অররিয়াতেও নিরাপত্তা কর্মীদের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে পড়েন মতদাতারা।
সন্ধ্যা ছ'টা পর্যন্ত ৫৪.৬৩% ভোট পড়েছে বলে খবর। তবে কিছু কেন্দ্রে এখনও ভোট চলছে।



মন্তব্যসমূহ