রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন

 


আমাদের নিয়মিত সাহিত্য সাধনার দিন প্রতিদিন  


আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিকপত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম । আজ তাঁর ধারাবাহিক থেকে একটু চোখ ফিরিয়ে আবার স্বাদ নিই  ধারাবাহিক উপন্যাসের।এবার থেকে  প্রতি রবিবার প্রকাশিত হবে এক একটি পর্ব। কারণ কিছুই নয় সন্দীপের উপন্যাসের এক একটি অধ্যায় মানে এক একটি গল্প। তাই রবিবাসরীয় একটা সাহিত্যের আড্ডা ভরানো থাক সন্দীপের উপন্যাসে।   

ঝুলবারান্দার নীচে #৩৮




সন্দীপ চক্রবর্তী

মহাপ্রভুকে দর্শন করে বেরিয়ে পড়লাম। নবদ্বীপ আমার চেনা জায়গা। ছোটবেলা থেকে আসছি। এখানকার বিখ্যাত প্রত্যেকটি জায়গাতেই একাধিকবার গেছি। কিন্তু সোনার গৌরাঙ্গের মন্দির হোক বা দেবানন্দ গৌড়ীয় মঠ কিংবা মায়াপুরের ইসকন মন্দির--কোনও কিছুই আমার কাছে পুরনো হয় না। আর যা আমার মনে চিরনবীন হয়ে থাকে তা হল নবদ্বীপের গঙ্গা। বড়ো মায়া এখানকার গঙ্গায়। মহাপ্রভুর জন্মস্থানে এলেই আমি তার শৈশবের লীলাক্ষেত্র গঙ্গায় যাই। হয় ঘাটে চুপচাপ বসে থাকি। নয়তো নৌকোয় চড়ে এলোমেলো ঘুরে বেড়াই। শেষ বিকেলের রাঙা আলোয় গঙ্গার সোহাগি রূপটি দেখতে আমার ভালো লাগে।
এখন যদিও সকাল। তবুও চলেছি সেই গঙ্গার টানেই। শুধু যে নদী দেখব তা নয়, কথা বলব আমার মাঝির সঙ্গেও। ভবাই দাস। নবদ্বীপে এলে ওর কাছে আমি যাই। ওর বাড়িতেও গেছি অনেকবার। আমার এলোমেলো খেয়ালগুলো ও খুব ভালো চেনে। দেখতে পেলেই ডাকে। বিশেষ করে নৌকোয় সওয়ারি না থাকলে। ভবাইয়ের বয়েস চল্লিশ-বিয়াল্লিশের বেশি হবে না। কিন্তু দেখলে মনে হয় অনেক বেশি। ভবাই অসময়ে বুড়ো হয়ে যাচ্ছে ওর ছেলে বিকাশের জন্য। বিকাশের বয়েস মাত্র বারো বছর। জন্মাবধি ওর ডান পা'টা হাঁটুর পর থেকে বাঁকা। ক্রাচ নিয়ে হাঁটে। এখানকার ডাক্তারেরা বলেছেন হাঁটুতে একটা অপারেশন করিয়ে নিলে ভালো হয়ে যাবে বিকাশ। কিন্তু নবদ্বীপে সেই অপারেশনের পরিকাঠামো নেই। কলকাতায় নিয়ে যেতে হবে। এসব খবর গতবার এসেই শুনেছিলাম। অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকিয়ে ভবাই বলেছিল, পোলাডারে দ্যাখলে বড়ো কষ্ট হয় গ দাদা। ক্রাচে ভর দিয়া হয়তো যাওন যায় কিন্তু পৌঁছাইতে বড়ো দেরি হয়। আমাগো বিকাশ যখন পৌঁছাইবে তখন সব শ্যাষ।
সকালে ঘাটে স্নানার্থীদের ভিড়। নৌকোর ঘাট আলাদা। সেখানে যাওয়া মাত্র ভবাই আমাকে দেখতে পেয়ে ডাকল, ইদিকে গ দাদা। এই যে হাত নাড়সি।
জায়গাটা বেশিদূরে নয়। দেখলাম ভবাইয়ের চুল আরও সাদা হয়েছে। কিন্তু মুখের হাসিটি অমলিন। জিজ্ঞাসা করলাম, কেমন আছ ভবাই?
মহাপ্রভুর কৃপায় চইলা যায়। আপনার খবর সব ভালো তো?
ভালোই তো
চলেন। উইঠা পড়েন নৌকায়। ঘাটে খাড়াইয়া কথা কওনে কাম কী! জলে ভাইসতে ভাইসতে কথা হইব।
নৌকোয় উঠে হাত-পা ছড়িয়ে বসলাম। ভবাই নৌকো ছেড়ে দিল। দেশভাগের পর ওর দাদু বরিশালের সাবেক ভিটে ছেড়ে নবদ্বীপে চলে এসেছিলেন। ভবাইয়ের জন্ম এখানেই। কিন্তু বরিশালের ভাষা ও ছাড়তে পারেনি৷ ভবাইয়ের দেখাদেখি ওর বউ চাঁপাও একই টানে কথা বলে। শত অভাবের মধ্যেও দুজনের ভাব খুব। একজন বাজালে অন্যজন বাজে। মাঝখানে বিকাশের ক্রাচটি না থাকলে ওরা হয়তো ওদের টালির চালের ঘরটিতে স্বর্গ নামিয়ে আনতে পারত।
শরতের রোদ্দুরে সোনালি আমেজ। মন কেমন করা হাওয়া মনে করিয়ে দেয় পুজো আসছে। ভবাই বলল, নবদ্বীপে কবে আইলেন গ দাদা?
পরশু
ঘাটে আসেন নাই বুঝি! আপনার লগে দুইডা কথা কইলে মনডা শান্তি পায় কিনা, তাই কই।
আজ আমারও মন ভালো নেই। আমিও শান্তি খুঁজতে এসেছি খেয়াঘাটের এক মাঝির কাছে। কিন্তু এ কথা ভবাইকে বলা যায় না। যার কথা জানার জন্য আমি অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি তার কথাই জিজ্ঞাসা করলাম, বিকাশ কেমন আছে ভবাই?
ভবাই হাসল, মাঝে মাঝে মনে হয় ভালোই আছে পোলাডা। সারাদিন বই পড়ে। ওই যে আপনি একখান বই কিনা দিসিলেন-- বুড়ো আঙলা! ওইখান। জানেন দাদা ও যখন পড়ে আমার খুব ভালো লাগে। আমি তো চাই ও খুব পড়ুক। ল্যাখাপড়া কইরা মানুষ হোক। কিন্তু যখন অর ক্রাচটারে দেহি তখন ডর লাগে। মানুষ হওনের রাস্তা তো বড়ো কম না। ক্রাচে ভর দিয়া ও অতদূর যাইব কেমন কইরা?
আমি গঙ্গার দিকে চেয়ে রইলাম। নদী চিরকাল মানুষকে স্বপ্ন দেখায়। এক জীবন থেকে অন্য জীবনে যাওয়ার স্বপ্ন। এই জন্যেই মানুষ ঘর বাঁধে। সন্তানের বাবা-মা হয়। একদিন সন্তান সেই অন্য জীবনের সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। নদী বয়ে চলে। ভবাইরাও নদীর মতো ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে যায় মোহনার দিকে।
অনেকক্ষণ কেউ কোনও কথা বলিনি। নীরবতা ভাঙল ভবাই, একখান নূতন কথা আইজকাল বিকাশরে কইতে শুনি।
কী বলে বিকাশ?
সেই যে গতবার আপনি এখানকার একখান পোলাপানের পত্রিকায় গল্প ল্যাখলেন, সেই ল্যাখা পইড়াই কথাডা কয়। কয় কি, আমিও বড়ো হইয়া কাকুর মতো হইব।
আমার মতো কী হবে?
বোঝলেন না! ল্যাখক হবে আপনার মতো। ছড়া ল্যাখে আইজকাল। সেসব পইড়া আমি আর অর মা হেসে বাঁচি না। আপনি গ্যালে দেখাবে এহন।
তাকিয়ে রইলাম ভবাইয়ের মুখের দিকে। এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে মন ভরে গেল। বারো বছরের এক কিশোর আমার লেখা পড়ে লেখক হবার স্বপ্ন দেখছে। এর থেকে বড়ো পুরস্কার আমার আর কী হতে পারে। কিন্তু শান্তির ভাবটুকু বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। ভবাইয়ের ভয় আমাকেও পেয়ে বসল। লেখক হবার রাস্তাও তো বড়ো কম না। ক্রাচে ভর দিয়ে হেঁটে বিকাশ অতদূর যেতে পারবে তো? ভয় ভাঙার জন্য প্রসঙ্গ পালটে বললাম, বিকাশের চিকিৎসার কী খবর?
ভবাই ম্রিয়মাণ ভঙ্গীতে হাসল, চিকিৎসা আর কী হইব! বিকাশরে কইলকাতার পিজিতে লইয়া গেসিলাম। অখানকার ডাক্তারও কইলেন, অপারেশন করাইলে আমাগো বিকাশ ভালো হইয়া যাইব। কিন্তু লাখখানেক টাকা খরচা। অত টাকা পাই কোথায়! আগেকার দিনকাল তো আর নাই। আমরা তিন পুরুষের মাঝি। কত ভাইসলাম, কত ভাসাইলাম! কিন্তু দ্যাশ যত এগোয় নদীর ওপর তত চওড়া বিরিজ হয়। পথে পথে গাড়ি দৌড়ায়। মনের মতন ডাঙ্গা পাইলে ভাইসতে চায় কয়জনা? বিকাশের মা কয়, আমার গয়নাগাটি বেইচা দাও। আমি শুধাই, তোমার ক'খান গয়না আছে গ চাঁপারানি? গয়না বেইচলে তোমার গা খালি হইব কিন্তু পোলার পা হইব না।
কথা বলতে বলতে আমরা মাঝগঙ্গায় পৌঁছে গেলাম। নৌকোয় যখন উঠেছিলাম তখন আজকের দিনটিকে ভারী প্রসন্ন বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন এক অদ্ভুত বিষাদ ছড়িয়ে পড়েছে গঙ্গার প্রতিটি ঢেউয়ে। নদীর সঙ্গে মাঝির আবহমান কালের সম্পর্ক। সেইজন্যেই বোধহয় ভবাইয়ের মন খারাপ বলে গঙ্গারও মন খারাপ।
বললাম, ঘাটে চলো ভবাই। বিকাশকে একবার দেখতে যাব।
ভবাইয়ের চোখে আলো ফুটল, যাইবেন! চলেন। অর খুব ভালো লাইগব।
ঘাট থেকে ভবাইয়ের বাড়ি বেশি দূরে নয়। বাড়ি বলতে টিনের চালের দু'খানা ঘর। রান্নাঘর আর বাথরুম বাড়ির পিছনদিকে। বিকাশ ভেতরে ছিল। আমার গলা পেয়ে চলে এল। হাঁ করে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। ওকে দেখতে ভারী সুন্দর। বড়ো বড়ো দুটি চোখের মায়াভরা দৃষ্টি মেলে যখন তাকিয়ে থাকে তখন নিজের মনেই বলে ফেলি, জীবনের কোনও দুঃখ যেন ওকে স্পর্শ করতে না পারে। কিন্তু তা তো হওয়ার নয়। বিকাশকে কাছে টেনে নিয়ে বললাম, কেমন আছিস বাবা?
খুব ভালো আছি গ কাকু। তুমি কেমন আছ?
আমিও ভালোই আছি। তোর বাবা বলছিল, তুই নাকি ছড়া লিখিস!
হ গ লিখি। তুমি দেখবা?
সেইজন্যেই তো এলাম। নিয়ে আয়। দেখি কেমন লিখেছিস।
চাঁপা রান্না করছিল। আমাকে দেখে বলল, ওমা, দাদা আইছেন! এবার কতদিন পর আইলেন। নিতাই ঠাকুরের লগে দেখা হইলে আমি জিগাইতাম, দাদা আসেন নাই? ঠাকুর কইতেন সময় হয় নাই তার আসার। তাইলে এতদিনে আপনার সময় হইল।
তা হল। তোমার খবর সব ভালো তো চাঁপা?
ভালো আর কই! পোলাডার জন্য কষ্ট হয়। অরে লইয়া আমার কত সাধ! কত স্বপ্ন! কিন্তু এক পায়ে আর কত দূর যাওন যায় কন দেহি দাদা!
এত ভাবছ কেন? একটা কোনও ব্যবস্থা হবেই।
কী জানি! হয়তো তাই। কিন্তু আমার ভরসা হয় না। যখন ভাবি এই পৃথিমিতে আমরা নাই কিন্তু আমার বিকাশ আছে তখন ডর লাগে। কে দ্যাখবে অরে! খোঁড়া মাইনষের বয়েস বাড়ে, সে বুড়া হয় কিন্তু বড়ো হয় না।
বিকাশ একটা বাঁধানো খাতা নিয়ে ঘরে ঢুকল। ওর লেখা পড়তে শুরু করলাম। প্রথম লেখাতেই আমার চোখ আটকে গেল।
গাঙফড়িঙের ছানা
উড়তে গিয়ে দেখতে পেল
হারিয়ে গেছে ডানা
কোথায় গেল কোথায় গেল
ফড়িং খুঁজে চলে
স্বপ্ন দেখে ভাসছে ডানা
সমুদ্দুরের জলে
বিকাশের ছড়া পড়তে পড়তে মনে হল এ ছেলে যদি শুধু ছড়া নিয়েই থাকে তা হলেও অনেকদূর যাবে। বারো বছর বয়েসে ছন্দের এমন চমৎকার হাত ভাবাই যায় না। ভাব প্রকাশের স্টাইলটিও অসাধারণ। পড়া শেষ হল একসময়। খাতা ফেরৎ দিয়ে বললাম, খুব ভালো হয়েছে বিকাশ। চালিয়ে যা।
বিকাশ খুশিভরা চোখে একবার ভবাইকে দেখে জিজ্ঞাসা করল, আমি তোমার মতো ল্যাখক হইতে পারুম তো কাকু?
নিশ্চয়ই পারবি। তবে লেখক হতে গেলে কিন্তু অনেক লড়াই করতে হবে।
লড়াই করুম। আমার একটা পা নাই তো কী, আমি কম নাকি?
চাঁপারানি ডুকরে উঠল। ভবাইও দেখলাম চোখ মুছছে। আমি অবাক হয়ে গেলাম। একটা বারো বছরের ছেলে যে লড়াই করতে হবে শুনে ভয় পেল না, সেটা এরা কেউ দেখলই না! যে ছেলে স্বপ্ন দেখে তার ডানা সমুদ্দুরের জলে ভেসে যাচ্ছে সে একদিন সমুদ্রের কাছে যাবেই। আমার চোখে জল এল আনন্দে। বিকাশের পিঠে হাত রেখে বললাম, লেখকের লড়াইয়ে পায়ের কোনও ভূমিকা নেই রে। মনকে শক্ত কর। দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে।
বেলা বাড়ছে। নিতাই ঠাকুর বোধহয় চিন্তা করতে শুরু করেছেন। এবার আমায় যেতে হবে। কিন্তু এখনও একটা কথা বলা হয়নি। আমাকে সামনে রেখে যে বড়ো হচ্ছে, একদিন যে সমুদ্রে যাবে ডানা খুঁজতে তাকে তার চৌকাঠ অবধি এগিয়ে না দিয়ে যাই কী করে!
কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই চাঁপারানি বলল, এতদিন পর আইসছেন, গরিব বুনের বাড়িতে আইজ দুই মুইঠা খাইয়া যান।
হেসে বললাম, আমার বোনের শুধু টাকাপয়সাই যা নেই, আর সবই তো আছে। সুতরাং তাকে গরিব বলা যায় না। বিকাশের অপারেশনটা হয়ে যাক। তারপর একদিন এসে আমি খেয়ে যাব।
ভবাই বিষণ্ণ গলায় বলল, অপারেশন কী কইরা হইব দাদা! আমাগো টাকা কই?
সে ভাবনা তোমায় ভাবতে হবে না ভবাই। আমার এক বন্ধুর এনজিও আছে। টাকা ওরা দেবে। আমি কথা বলব। তুমি শুধু একদিন পিজিতে গিয়ে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলে অপারেশনের ডেটটা ঠিক করো।
ভবাই শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়ল। কাঁদছিল চাঁপাও। আমি জানি এ কান্না আনন্দের। তাই আমি ওদের সান্ত্বনা দিলাম না। এগিয়ে গেলাম বিকাশের কাছে৷ ওর মাথাটা টেনে নিলাম বুকে। বললাম, সমুদ্দুরের কথাটা কখনও ভুলিস না বাবা। ছোটবেলায় স্বপ্নে পাওয়া সমুদ্দুরকে যারা ভুলে যায় তারা কোনওদিন লেখক হতে পারে না।
তোমারও সমুদ্দুর আছে কাকু?
হ্যাঁ রে। তোর পা'টা ঠিক হোক। একদিন নিয়ে যাব তোকে তার কাছে।
বাইরে বেরিয়ে মনে হল আমার কী যেন বদলে গেছে। মন জুড়ে অদ্ভুত এক তৃপ্তি। ছবির জন্য যে দুঃখ আমি জমিয়ে রেখেছিলাম, কখন আঙুলের ফাঁক দিয়ে পড়ে গেছে খেয়াল করিনি। কয়েকটা দিন একটা বৃত্তের মধ্যে আটকে গিয়েছিলাম। ভাগ্যিস বিকাশের সমুদ্দুর ছিল। নয়তো আমার নিজের সমুদ্দুরের খোঁজ পেতে অনেক দেরি হয়ে যেত।
(ক্রমশ)

মন্তব্যসমূহ