দিন প্রতিদিন বিশেষ

 হাসির মৃত্যু বিশেষ 

শঙ্করস উইকলি, একরাশ হাসির রহস্যমৃত্যু 





কাজল ভট্টাচার্য , কলকাতা , ৫ নভেম্বরঃ 

(সেদিন কোপ পড়েছিলো 'শঙ্করস উইকলি'র ঘাড়ে। ফ্র্যান্সে 'চার্লি হেবডো'র কার্টুন নিয়ে ঝড় উঠলেও রক্ষাকর্তা খোদ সরকার। জরুরীকালিন অবস্থায় 'শঙ্করস উইকলি'র ঝাঁপ ফেলার পেছনে কে? আঙুল উঠেছিল সরকারের দিকেই। সেই বিতর্ক আগামিদিনেও চলবে।)




সাতাশ বছরের নাগাড়ে দৌড়। তারপর আচমকাই একদিন মুখ থুবড়ে পড়লো 'শঙ্করস উইকলি'। কার্টুন নিয়ে ভারতের একমাত্র সাপ্তাহিক। তার আগেও না, তার পরেও না। 'শঙ্করস উইকলি'কে ছাপিয়ে যাওয়ার মতো দ্বিতীয় কোনও পত্রপত্রিকার আর দেখা পাওয়া গেলো না।

স্রষ্টার হাতেই সৃষ্টির গলা টিপে খুন। অনেকেই কপাল কুঁচকেছিলেন- ব্যাপারটা কী। তাহলে কি পেছনে কলকাঠি নেড়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধি? শঙ্কর নিজেই আচমকা 'শঙ্করস উইকলি'র মৃত্যুর ফতোয়া জারি করেছিলেন, এমনকথা সেদিন কেউ বিশ্বাস করতে রাজি হননি। 


আর বিশ্বাস করবেনই বা কী করে? 'শঙ্করস উইকলি'র যাত্রা শুরু জওহরলাল নেহরুর হাত ধরে। ১৯৪৮ সালের মে মাসে ম্যাগাজিনের প্রথম সংস্করণের, প্রথম কপিটি হাতে নিয়ে উদ্বোধন করেছিলে খোদ পন্ডিত নেহরু। "ডোন্ট স্পেয়ার মি!" "আমাকেও ছেড়ে কথা বলো না," মুচকি হেসে কার্টুনিস্ট শঙ্করকে বলেছিলেন রসিক জওহরলাল নেহরু। তখন তিনি ভারতের এক নাম্বার ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। কথা রেখেছিলেন শঙ্কর। একমাত্র নেহরুকে নিয়েই এঁকে ফেলেছিলেন কমবেশি দেড় হাজার ব্যঙ্গছবি।



তখন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন চলছে। ওদিকে ততদিনে শঙ্করের মগজে জাঁকিয়ে বসেছেন নেহরু। জেলের অন্ধকার কুঠুরিতে বন্দি নেহরু পেপারের পাতা উল্টিয়ে চলেছেন। আর শঙ্করের কার্টুন চোখে পড়লেই তাঁর ঠোঁটে খেলে যাচ্ছে হাসির ঝিলিক। সেই গোপন হাসি নেহরু শেয়ার করতেন কন্যা ইন্দিরার সঙ্গে। পেপারের পাতা থেকে সেই কার্টুনের ছবি কেটে, চিঠির সঙ্গে মেয়ের কাছে পাঠিয়ে দিতেন বাবা।

নেহরু- শঙ্করের এই যুগলবন্দি চলেছিলো নেহরুর মৃত্যুর দশ দিন আগে পর্যন্ত। ১৯৬৪ সালের ১৭ মে। নেহরুকে নিয়ে শেষ কার্টুন আঁকলেন শঙ্কর।


"বিরল মেধার মানুষ শঙ্কর," বলতেন নেহরু। "কোনরকম বদমতলব না। শিল্পীর দক্ষতায় মঞ্চের মানুষদের দুর্বলতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। এটাও দরকার। মাঝেসাঝে আমাদের এই অহঙ্কারের পর্দাটা ছিড়েফুঁড়ে দেওয়া।" মাঝেমধ্যেই নেহরু ধন্যবাদ দিতেন তাঁর সহজাত দুর্বলতা ধরিয়ে দেওয়ার জন্য। তিনিও যে একজন নশ্বর মানুষ একথা মনে করিয়ে দিলে খুশি হতেন। শঙ্করের কথায়, "নেহরু বিশ্বাস করতেন, একজন মানুষও পারফেক্ট না। তা তিনি যতোই শক্তিধর, কেষ্টবিষ্টু হোন না কেন।" 


ছোটবেলার থেকে বাবার রসবোধ, শঙ্করপ্রীতি দেখে বড় হলেও, ইন্দিরা গাঁধির মধ্যে সম্ভবত এক স্ববিরোধিতা কাজ করতো। একদিকে তিনি লিখছেন, "সমাজের মুখোশ টান মেরে ফেলে, সমাজের মুখের সামনে আয়না ধরেন কার্টুনিস্ট।" আবার তিনিই অন্য জায়গায় বলছেন, "নির্দিষ্ট কিছু পরিমাণ অশ্রদ্ধা না থাকলে কার্টুন হয় না।" বাবার পর মেয়েও উঠে এসেছিলো শঙ্করের তুলির টানে। তখন প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে ইন্দিরা গাঁধি।


সব ভালো যার শেষ ভালো। কিন্তু তা হলো না। ২৫ জুন, ১৯৭৫। সারা দেশে জারি হলো 'এমার্জেন্সি'। জরুরিকালীন অবস্থা। মিডিয়ার ঘাড়ে চেপে বসলো জবরদস্ত সেন্সরশিপ। বন্ধ হয়ে গেলো 'শঙ্করস উইকলি'। দিনটা ছিলো অগাস্ট ৩১, ১৯৭৫। 'জরুরি অবস্থা সেদিন সবেমাত্র দু'মাস পেরিয়ে ছ'দিনে পা দিয়েছে। সবাই সন্দেহ করলেন ইন্দিরা গাঁধির চোখ রাঙানিতেই যাত্রাশেষ করলো নেহরুর প্রিয় 'শঙ্করস ডেইলি'। শঙ্কর নিজে কিন্তু অন্যকথা শোনালেন। "এই পদক্ষেপের জন্য আমরা এমার্জেন্সিকে জড়াতেই পারি। কিন্তু সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন চালানোর দায় আর জুতোর ফিতে বাঁধা এক ঘটনা না।" 


১৯৭৫ সালের জুলাই ২৬ তারিখ। শঙ্করকে লেখা এক চিঠিতে ইন্দিরা গাঁধি জানালেন, " বছরের পর বছর পরিশ্রম, তদারকিতে গড়া কোন জিনিস বন্ধ করে দিতে মাত্রাহীন মানসিক বল লাগে।" এব্যাপারে শঙ্করের সিদ্ধান্তই শেষ কথা উল্লেখ করে ইন্দিরা লেখেন, "খুব মিস করবো শঙ্করস উইকলিকে।" 


তবে ইন্দিরা গাঁধি বা শঙ্কর যাই বলুন না কেন, গোটা ব্যাপারটি মেনে নিতে পারেনি কার্টুন রসিকরা। আর এমার্জেন্সি লাগু হওয়ার পরেই সাপ্তাহিক বন্ধ হওয়ার ঘটনায়, স্বাভাবিকভাবেই আঙুল ওঠে শাসক দলের দিকে। কোনও রাখঢাক না করে শঙ্কর ঘনিষ্ঠ এক কার্টুনিস্ট জে বসন্থন এক নামকরা ইংরেজি দৈনিকে লেখেন, নিজের কর্মীদের রাজরোষ থেকে বাঁচাতেই ওই সিদ্ধান্ত নেন শঙ্কর। তাঁর বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধিকে সবকিছু জানিয়েই সাপ্তাহিক বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শঙ্কর। সেই ঘটনার কথা স্বেচ্ছায় বা চাপে পড়ে, চেপে যেতে বাধ্য হয়েছিল মিডিয়া।


তারিখটা ছিল ৩১অগাস্ট, ১৯৭৫। রবিবার বাজারে শেষবারের মতো এলো শঙ্করস উইকলি। সাপ্তাহিকের ভক্তরা পড়লেন তাঁদের প্রিয় কার্টুনিস্ট শঙ্করের লেখা বিদায়ী সম্পাদকীয়- "ডিক্টেটরের হাসার মুরোদ নেই। আর তাই ডিক্টেটরকে দেখে মানুষের হাসাও মানা।" ঠিক কাকে বিঁধতে 'ডিক্টেটর' শব্দটা উচ্চারণ করেছিলেন 'হাসির রাজা'? আজ সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য বেঁচে নেই কেশব শঙ্কর পিল্লাই। দুনিয়া যাঁকে চিনেছিল কার্টুনিস্ট শঙ্কর নামে। 


কার্টুনের ওপর গোঁসার সেই ধারাবাহিকতা দেখা গেছিল তারপরেও। সাল ২০১২। মনমোহন জমানা। প্রয়াত ইন্দিরা গাঁধির পুত্রবধু সনিয়া গাঁধি সেদিন সংসদের সভাকক্ষে টেবিল চাপড়ে সাবাশি দিলেন কপিল সিব্বলকে। সেদিন জরুরিকালীন অবস্থা ঘোষনা ছাড়াই তিনি সেন্সরশিপের কথা বললেন। যাবতীয় পত্র পত্রিকা থেকে কার্টুন তুলে নেওয়ার কথাও বললেন সিব্বল।


ঠিক এদিনের ছবিটাই শঙ্কর শব্দে শব্দে এঁকেছিলেন তাঁর বিদায়ী সম্পাদকীয়তে- ডিক্টেটরদের হাসার মুরোদ নেই। তবে দিন বদলানোর সঙ্কেত দিয়েছিলেন 'হাসির রাজা' শঙ্কর- আদ্যিকালের বদ্যিবুড়োরা না বদলালেও, দিনকাল বদলাবে। শিল্পীর মানসচোখে আগামির স্বপ্ন দেখেছিলেন হাসির বাদশাহ। 


সাপ্তাহিকের শেষ সম্পাদকীয়তে তিনি লিখলেন- "শঙ্করস উইকলি 'চিকিৎসার অযোগ্য' আশাবাদী। আজকের দুনিয়ার হাল যাই হোক না কেন, আগামিতে তা সুখকর, স্বচ্ছন্দ হবে। মানুষের আত্মিক শক্তির কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানবে মৃত্যুর কারবারীদের শক্তি। ফুল ফুটবে জীবনের। মানবতা তার দায়িত্ব পালন করে পূর্ণতায় পৌঁছবে।

অনেকে তাকে ঈশ্বর বলেন। আমরা তাকে মানবজাতির নিয়তি বলি। এই আশাতেই আমরা আপনাদের সৌভাগ্যের কামনা করে 'গুড বাই' জানাই।"


(কৃতজ্ঞতা: দ্য নিউজ মিনিট/ইন্ডিয়া জার্নালিজম রিভিউ/টাইমস অফ ইন্ডিয়া/ দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস/ দ্য হিন্দুস্তান টাইমস)

মন্তব্যসমূহ