দিন প্রতিদিন বিশেষ

  বিহার নির্বাচন বিশেষ 


।। নিজের তেজেই জ্বলে উঠতে চাইছেন তেজস্বী ।।





   কাজল ভট্টাচার্য, কলকাতা, ১ নভেম্বর  :

মহাজোটের মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থীর ভোটপরীক্ষা মঙ্গলবার।

আর ঠিক সে সময়েই বোমা ফাটালেন পাকমন্ত্রী ফয়াদ চৌধরী।
রাষ্ট্রীয় জনতা দল, তিন বামপন্থী দলের মহাজোটের অন্যতম শরিক কংগ্রেসের হয়ে রাহুল গাঁধি ফের প্রশ্ন তুলতেই পারেন- পাকমন্ত্রী ফয়াদ চৌধরী ঠিক এসময়েই পুলওয়ামা নিয়ে মুখ খুললেন কেন? ঠিক যেমনটা 
তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন গত লোকসভা নির্বাচনের আগে।

বিহার নির্বাচনের প্রথম দফায় মুঙ্গেরে দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জনের শোভাযাত্রায় পুলিসের গুলি চালানো নিয়ে কমবেশি চাপের মুখে পড়ে গেছিলো বিজেপি, জেডিইউয়ের এনডিএ জোট। এবার পুলওয়ামার জঙ্গী হামলায় পাক সরকারের যোগের কথা ফয়াদ চৌধরী প্রকাশ্যে আনতেই ছবিটা উল্টে গেছে। ওই ঘটনা বেশ খানিকটা অক্সিজেন জুগিয়েছে বিজেপিকে। আর এবার ভোট বৈতরণী পার করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর মুখই ভরসা এনডিএ জোটের। গত পনেরো বছরের নীতিশ জমানায়, তাঁর নামের জাদু অনেকটাই কমেছে। তার ওপর এবার ভোটের লড়াই বাস্তবিক অর্থেই দুই প্রজন্মের মধ্যে। নয়া প্রজন্মের একদিকে লালু- রাবড়ি পুত্র তেজস্বী, প্রয়াত রামবিলাস পাসোয়ান পুত্র চিরাগ অন্যদিকে মুখ্যমন্ত্রী পদে হ্যাটট্রিক করা নীতিশ কুমার।

কথায় আছে "বাপকা বেটা, সিপাহীকা ঘোড়া, কুছ নেহিতো থোড়া থোড়া!"
কথার উল্টোপথে হাঁটছেন লালুপুত্র তেজস্বী। মরীয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন, নিজের তেজেই তেজস্বী হয়ে উঠতে। বাজি ধরে ময়দানে নেমে পড়েছেন, লালু- রাবড়ির ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে। গোটা ঘটনায় স্পষ্ট, কঠিন সত্যের মুখোমুখি হতে তৈরি তেজস্বী। ঝেড়ে ফেলতে চান এনডিএ'র দেওয়া 'জঙ্গলরাজের যুবরাজ'- এর অপবাদ। আর এব্যাপারে ইতিমধ্যেই অনেকটা পথ এগিয়ে গেছেন বলে স্থানীয় রাজনৈতিক মহলের মত। তেজস্বী যে নিজের স্বয়ংসম্পূর্ণ এক ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে চাইছেন, নীতিশ কুমারের কথাতেও তা স্পষ্ট। তিনি নিয়ম করে নির্বাচনী জনসভায় গলা ফাটাচ্ছেন- আরজেডি'র প্রচারে লালু- রাবড়ির ছবি নেই কেন?

সবদিক থেকেই পিতাকে টপকে যেতে চাইছেন তেজস্বী। শনিবার সতেরটি জনসভা করে লালুর ষোলটি জনসভা করার রেকর্ড ভাঙলেন। এছাড়াও তিনি যোগ দিয়েছিলেন আরও দুটি মিছিলে। তাঁর ডাক পড়ছে কংগ্রেস, বামপন্থীদের নির্বাচনী প্রচারেও। তেজস্বীর এই দাপাদাপিতে রক্তচাপ খানিক উর্ধ্বমুখী হতেই পারে নীতিশ কুমারের। ওদিকে আবার শিবসেনার মুখপাত্র সঞ্জয় রাউত ইতিমধ্যেই বলে দিয়েছেন, "মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে তেজস্বী যাদব বসলে অবাক হবো না।" 

হাতে আর আটচল্লিশ ঘণ্টাও নেই। মঙ্গলবার ভাগ্যপরীক্ষা লালুপ্রসাদ যাদবের দুই পুত্রের। ছোট ছেলে তেজস্বী যাদব এবার মহাজোটের মুখ্যমন্ত্রীর মুখ। তিনি লড়াই চালাবেন বৈশালীর রাঘোপুর থেকে। ঠিক দশবছর আগে বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তেজস্বীর মা রাবড়িদেবীর থেকে ওই আসন ছিনিয়ে নিয়েছিলেন বিজেপির সতীশ কুমার। তার ঠিক পাঁচ বছর পর ওই আসন পুনরুদ্ধার করেন তেজস্বী। এবার ফের শক্তিপরীক্ষায় নামবে সতীশ তেজস্বী।
ওদিকে লালু রাবড়ির বড়ছেলে তেজ প্রতাপ এবার নিজের কেন্দ্র বদল করেছেন। গতবারের নির্বাচন কেন্দ্র বৈশালীর মহুয়া ছেড়ে এবার তিনি সমস্তিপুর জেলার হাসানপুরের প্রার্থী। সেখানে তিনি টক্কর দেবেন দুবারের জনতা দল ইউনাইটেডের বিধায়ক রাজকুমার রায়কে। তবে স্থানীয় রাজনৈতিক মহলের ধারনা, তেজস্বীর তুলনায় তেজ প্রতাপের লড়াই বেশ খানিকটা কঠিন। 


আগামী মঙ্গলবার, বিহারের দ্বিতীয় দফার ভোট। ভোট নেওয়া হবে ১৭ জেলার মোট ৯৪ আসনের জন্য। কংগ্রেসের টিকিটে লড়াইয়ে সামিল হবেন সিনেমা প্রেমীদের অতি পরিচিত মুখ 'বিহারীবাবু' শত্রুঘ্ন সিনহার ছেলে লব সিনহা। তাঁর বিপক্ষে লড়াই চালাবেন বিজেপির নীতিন নবীন। রাজনৈতিক মহল এই লড়াইয়ে নীতিনকেই এগিয়ে রাখছেন। ভারতীয় যুব মোর্চার প্রদেশ সভাপতি নীতিন, গত দুবার ওই আসনে জয়ের মুখ দেখেছিলেন।

দ্বিতীয় দফায় যে আসনগুলিতে নির্বাচন হতে চলেছে, ২০১৫- এর নির্বাচনের হিসেবে তাতে এক নাম্বারে ছিলো লালুপ্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দল। দলের হাতে এসছিলো মোট ৩৩টি আসন। খানিকটা পিছিয়ে নীতিশ কুমারের জনতা দল ইউনাইটেডের দখলে ছিলো ৩০টা। মোট ২০টি আসন নিয়ে এরপরেই ছিল বিজেপি। আর কংগ্রেসকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল মাত্র সাতটি আসন নিয়ে। 
প্রয়াত রামবিলাস পাসোয়ানের লোক জনশক্তি পার্টি এবারেই প্রথম লড়াইয়ে নেমেছে চিরাগ পাসোয়ানের নেতৃত্বে। এবার দেখার, গতবারের দুই আসনের সংখ্যা তিনি ডিঙোতে পারেন কিনা। ওদিকে মাত্র একটি আসন পেয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী লেনিনবাদী)। পড়ে থাকা একটিতে কবজা ছিলো নির্দল প্রার্থীর। তবে এবার নির্ণায়ক হতে পারে ১৮টি কেন্দ্র। গতবার ওই কেন্দ্রগুলিতে জয় পরাজয়ের ফয়সালা হয়েছিল মাত্র পাঁচহাজার ভোটের ফারাকে।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, দ্বিতীয় দফার নির্বাচনী কুরুক্ষেত্রে ২৪টি আসনে সরাসরি মহাযুদ্ধ বাঁধবে নীতিশ কুমার, তেজস্বীর মধ্যে। ২৮ কেন্দ্রে তেজস্বী মুখোমুখী হবেন পদ্ম শিবিরের। আর ১২টি আসনে এনডিএ জোটপ্রার্থীর সঙ্গে লড়াই চালাবে কংগ্রেস।


মঙ্গলবার গতবারের সব পুরনো হিসেবকে তছনছ করে এগিয়ে যেতে চাইবেন নীতিশ কুমার। বড় অদ্ভুতভাবেই ঘোরে রাজনীতির রথের চাকা। এর আগে বিহারের কঠিন মাটিতে পদ্ম শিবিরের জয়রথ গড়ানোর ভরসা ছিলো জনতা দল ইউনাইটেড। আর আজ জেডিইউকে চেপে বসতে হয়েছে বিজেপির রথে। নীতিশের সারথি খোদ নরেন্দ্র মোদি। মাত্র দশবছর আগের ঘটনা, ২০১০এর নির্বাচনে নীতিশের আপত্তিতে বিহারের নির্বাচন প্রচারে জোটসঙ্গী বিজেপির হয়ে রাজ্যে পা রাখতে পারেননি নরেন্দ্র মোদি। একই ছবি দেখা গেছিল তারও পাঁচবছর আগে ২০০৫এর নির্বাচনে। তখন মুখবুজে নীতিশের আপত্তি শিরোধার্য করতে হয়েছিল বিজেপির। যদিও নীতিশ ওই ঘটনা পরে অস্বীকার করেছিলেন। "রাতের ভোজে নরেন্দ্র মোদিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সুশীল মোদি," বলেন নীতিশ। "পরে সুশীল মোদিই ওই অনুষ্ঠান বাতিল করেন। আমাকে সেরেফ সেই খবর জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল।" 
এরপর গত বিধানসভা নির্বাচনে সম্পূর্ণ উল্টো পথে হেঁটেছিলো দুই পুরনো জোটশিবির বিজেপি, জেডিইউ। তবে সেই বিচ্ছেদ ছিলো ক্ষণিকের। এবার ফের কংগ্রেস, আরজেডি'র হাত ছাড়িয়ে নীতিশ ফিরে গেছেন তাঁর পুরনো বিজেপিজোটে।

"বিজেপি প্রকাশ্যে জোট বেঁধেছে জেডিইউ- এর সঙ্গে," বলেছেন আরজেডি'র মুখপাত্র মনোজ কে ঝা। এরপরেই নীতিশকে চাপে রাখতে এনডিএ জোট নিয়ে তিনি তীব্র কটাক্ষ করেছেন- বিজেপি'র অপ্রত্যক্ষ জোট লোক জনশক্তি পার্টির সঙ্গে। আর অদৃশ্য জোট ওয়েসি'র সঙ্গে।" প্রসঙ্গত এআইএমআইএম প্রধান আসাদুদ্দিন ওয়েসি ইতিমধ্যেই জোরগলায় জানিয়েছেন, দশটি আসন তাঁর হাতে আসতে চলেছে। ওয়েসির দল বিহারের ২৪টি আসনে লড়াই চালাচ্ছে।

কথায় আছে "ওল্ড ইজ গোল্ড"। দেখা যাক 'সোনার বিহার' ফিরে পেতে তাঁর পুরনো জোটসঙ্গী মুখ্যমন্ত্রী পদে হ্যাটট্রিক করা, সুশাসনবাবু নীতিশ কুমারকে কতটা এগিয়ে রাখে।।






মন্তব্যসমূহ