দিন প্রতিদিন বিশেষ

  বয়েস বাড়তে দিও না 



।। আশির খোকা আশির খুকু, আশিতেও আসিও ।।


(বয়সের ভার কেই বা বইতে চায়? শরীরে বয়সের ছাপ এড়াতে কতোই না কেরামতি। আর ওই কেরামতি করতে গিয়েই তাঁরা হয়ে যান লোকহাসানো ধেড়ে খোকা খুকু। এবার তাঁদের মুশকিল আসান দাওয়াইয়ের সন্ধান দিলেন কাজল ভট্টাচার্য)



আজ বেঁচে থাকলে লাফ দিয়ে উঠতেন রাজা যযাতি।

বিপাকে পড়তে হতো না রাজপুত্র পুরুকে। বাবার আবদার মেটাতে বাবার বয়সের ভার নিজের শরীরে নিয়ে 'অকালবৃদ্ধ' হতে হতো না সন্তানকে। বরং বাবা যযাতিকে নিয়ে তুরন্ত পৌঁছে যেতেন ইজরায়েলে। সেদিন শুক্রাচার্য যেটা পারেননি আজ ঠিক সেটাই করে দেখাতেন, প্রোফেসর শাই এফ্রেতি আর তাঁর সতীর্থ আমীর হাডান্যি জুটি। তাঁদের চিকিৎসার আধুনিক কেরামতিতে মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হতো রাজা যযাতির। শরীর থেকে জড়া, বয়সের ছাপছোপ ছেঁটে ফেলতে পারতেন বিনা ছুরি কাঁচিতেই। আবার পুরুর তরতাজা শরীর থাকতো ঠিক যেমনটি ছিলো তেমনটিই।


ঘড়ির কাঁটা এঁকে যাবে মুখের বলিরেখা। সময় আদর করে উপহার দিয়ে যাবে জোড়া থুতনির বাহার। বয়সের ছাপ পড়বে সর্বাঙ্গে। সময়কে থামায় কার সাধ্য? হারবার্ট জর্জ ওয়েলসের 'টাইম মেশিন' আজও বিজ্ঞানের কল্পনায়। তবে ঘড়ির কাঁটা ঘোরে ঘুড়ুক। সময় চলে যায় যাক। তবে আপনি চাইলেই শরীরে সময়ের ছায়া পড়বে না। বরং আপনার শরীর ফিরে পেতে পারে সেই হারিয়ে যাওয়া যৌবনের জেল্লা। বিজ্ঞানের ভাষাতেই বলি, 'বায়োলজিক্যাল এজিং প্রসেস'- এর মুখ ঘুরিয়ে দেবেন ইজরায়েলি গবেষক চিকিৎসকরা। আপাতত যা খবর, ধেড়ে থেকে কচি হতে কোন ট্যাবলেট ক্যাপসুলও গিলতে হবে না। শুধু আপনার ছত্রিশ বা ছাপ্পান্ন ইঞ্চির বুকভরে টানতে হবে প্রাণবায়ু। তাজা নির্ভেজাল অক্সিজেনে ভরা ফুসফুসই বাকী খেলটা খেলবে।



আপনি চাইলেই বয়স বাড়বে শুধু শরীরের। আর তা ধরা থাকবে ক্যালেন্ডারের পাতায়। শরীরকে আর বইতে হবে না সেই বয়সের ভার। কোনও ভেলকিবাজি না। ঈশ্বরের করুণাও না। একেবারে নির্ভেজাল অক্সিজেনের মতোই খাঁটি বিজ্ঞান। তবে যেহেতু নিদান প্রকৃতিদত্ত অক্সিজেন, তাই প্রকৃতির কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়েই প্রকৃতি বিরুদ্ধ কাজটি করতে পারেন।

এই চিকিৎসার গালভরা নাম 'হাইপারবেরিক অক্সিজেন ট্রিটমেন্ট'।


বয়সের ধার, ভার দুইই কমবে।

বয়সের ভার গায়েব হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই, উধাও হয়ে যাবে বয়সজনিত রোগ ব্যাধিগুলোকেও। এমনটাই দাবি তেল আভিভ ইউনিভার্সিটি আর শামির মেডিক্যাল সেন্টারের জোট 'দ্য স্টাডি'র। এই চিকিৎসার জন্য দরকার এক বিশেষ ধরনের চেম্বার। চেম্বারের ভেতরে যে বায়ুচাপ থাকে, তা স্বাভাবিকের চেয়ে দেড় থেকে তিনগুন বেশি। সেখানে তাজা নির্ভেজাল অক্সিজেনের শ্বাস নিয়ে ফুসফুস ভরিয়ে ফেললেই ধাপে ধাপে জড়ামুক্তি। রক্তে বেড়ে যাবে বিশুদ্ধ অক্সিজেনের মাত্রা। আর সেই প্রাণবায়ুই মেরামতি করে ফেলবে শরীরের ভেতর ক্ষতিগ্রস্ত কোষের। চাঙ্গা হয়ে উঠবে শরীর। শুরু করবে স্বাভাবিক ছন্দে কাজকর্ম করা।


এরমধ্যেই পঁয়ত্রিশ জনের ওপর এই পরীক্ষা চালানো হয়েছে। তাদের সবারই বয়স চৌষট্টির ওপর। সপ্তাহে পাঁচ দিন সেই বিশেষ চেম্বারে তাঁদের 'হাইপারবেরিক অক্সিজেন ট্রিটমেন্ট' চলে। একেকজনকে পাক্কা নব্বই মিনিট করে চিকিৎসা দেওয়া হয়। নাগাড়ে তিনমাস এই চিকিৎসা করার পরেই গবেষক চিকিৎসক জুটি তাঁদের গবেষনার কথা জানান। আর তার যাবতীয় খুঁটিনাটির কথা নভেম্বর ১৮ সংখ্যায় মানুষের সামনে নিয়ে আসে 'এজিং ম্যাগাজিন'।

"কোষজনিত কারণে বয়স বাড়ার শরীরী এই প্রক্রিয়ার অভিমুখ উল্টো দিকে ঘোরানো সম্ভব।" গবেষনায় সেরকমই দেখা গেছে বলে 'দ্য জেরুজালেম পোস্ট'কে বলেন তেল আভিভ ইউনিভভার্সিটির প্রোফেসর শাই এফ্রেতি। তাঁর দাবি, উচ্চচাপের অক্সিজেন নিয়ন্ত্রণ করেই এই অত্যাশ্চার্য ঘটনাটি সম্ভব হয়েছে। উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া গেছে বয়সবৃদ্ধি আর বয়সজনিত রোগভোগের দুই প্রক্রিয়াকেই।


চিকিৎসার মূল রহস্যটি কী?

শাই এফ্রেতি বলেন, "দুনিয়ার গবেষকরা ওষুধপত্র সংক্রান্ত বিজ্ঞান আর পরিবেশের মদতে টেলোমেয়র দীর্ঘায়ত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু আমরা সেই কাজটাই করতে পেরেছি 'হাইপারবেরিক অক্সিজেন ট্রিটমেন্ট'- এ। মুখ ঘুরিয়ে দিতে পেরেছি কোষ- আণবিক (সেলুলার- মলিকিউলার) স্তরে বয়স বাড়ার প্রক্রিয়াকে।"


ওদিকে শাইয়ের সতীর্থ শামীর মেডিক্যাল সেন্টারের চিফ মেডিক্যাল রিসার্চ অফিসার আমির হাডান্যির বক্তব্য, লাইফ স্টাইল সংশোধন বা নিয়মিত কসরতের ওপর জোর দিলে, তা টেলোমেয়র সঙ্কুচিত করতে অযথা চাপ বাড়ায়। সে জায়গায় অনেক বেশি মসৃণভাবে কাজ করে হাইপারবেরিক অক্সিজেন ট্রিটমেন্ট।

হাডান্যির দাবি, মাত্র তিন মাস এই চিকিৎসা চালালে টেলোমেয়রকে যতটা দীর্ঘায়ত করে, তা অন্য কোনভাবে সম্ভব না।

তবে শরীর ঠিক কতটা বদলাবে তা নির্ভর করবে সেলুলার স্তরের ওপর। পঁচিশ বছর আগে শরীরের সেলুলার স্তরের সমতুল্য হবে শরীরের পরিবর্তন। আমরা শুধু সেই ক্ষয়কে ধীরগতি করে দিচ্ছি তা নয়। পিছিয়ে চলেছি অতীতে।"


টেলোমেয়ার বস্তুটি কী?

ক্রোমোজম জীবকোষের প্রতিটি কেন্দ্রে অবস্থিত অতি সূক্ষ্ম তন্তু যা জিন বহন করে। আর এই ক্রোমোজমের প্রান্তীয় মেরুকে বলা হয় টেলোমেয়র। প্রতিবার কোষ বিভাজনের সময় এই টেলোমেয়র ক্ষয়ে ছোট হয়ে যায়। এই ক্ষয়ে যাওয়া টেলোমেয়র আর স্বাভাবিক ছন্দে কাজকর্ম না করা কোষের জমা হওয়ার অভিমুখ ঘুরিয়ে দেওয়া যেতে পারে।


টেলোমেয়ার সঙ্কোচনের প্রকৃতিদত্ত প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় শারীরবৃত্তের 'হোলি গ্রেইল' (holy grail)।

'হোলি গ্রেইল' কথাটা এসছে যিশুর শেষ ভোজ থেকে। যে পাত্রটিতে যিশু শেষবারের মতো খাবার খেয়েছিলেন, তাকেই 'হোলি গ্রেইল' বলা হয়। আর ওই কথার সাঙ্কেতিক অর্থ আধ্যাত্মিক পূর্ণতা। যা নির্দিষ্ট কোনও ব্যক্তির সঙ্গে সংযোগ ঘটায় আধ্যাত্মবাদের। টেলোমেয়র সঙ্কোচনের মানে শরীরের পূর্ণ বয়সের দিকে এগিয়ে চলা। যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি মৃত্যু। সম্ভবত সেকথা মনে রেখেই টেলোমেয়র সঙ্কোচনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে 'হোলি গ্রেইল' শব্দবন্ধকে।



'হাইপারবেরিক অক্সিজেন থেরাপি' প্রথম ব্যবহার করে আমেরিকা। গত শতাব্দীর শুরুতেই মৃত্যুর মুখ থেকে ফ্লু রোগীদের জীবনে ফিরিয়ে আনতে, চিকিৎসক অরভিল কানিংহাম তাজা বিশুদ্ধ অক্সিজেন ব্যবহার করেন। এছাড়াও গভীর, পচনশীল ক্ষত দ্রুত সারিয়ে ভরাট করতেও হাইপারবেরিক অক্সিজেন থেরাপি দারুণ কাজ করে।


কথায় বলে, প্রয়োজনই আবিষ্কারের জননী।

কলির যযাতির সংখ্যাও নেহাত কম না। বাঙালিকেও আর বলতে হবে না- আশিতে আসিও না। বয়স ঝরাতে দরকার পড়বে না পুকুরের কনকনে জলে ডুব মারার। মাস তিনেক নিয়ম করে এক বিশেষ চেম্বারে আরামে বসে, বুকভরা তাজা অক্সিজেন নিলেই আশির শরীরে ভর করবে আঠারো।


(সৌজন্য স্বীকার: আলজাজিরা)

মন্তব্যসমূহ