রবিবাসরীয় সাহিত্য সাধনা

 ছোট গল্প 


  ।। পাখি কাল আসবে তো ।।




   কাজল ভট্টাচার্য 

মন এবার হারিয়ে যেতে চায়।
বন্ধ ফ্ল্যাটের চার দেওয়ালে পড়ে থাকুক খোলস।
কালোমেঘের ঘোমটা একটানে সরিয়ে এখন মাঝেমাঝেই উঁকি দেয় ঘন নীল আকাশ। রাসবিহারীতে দাঁড়িয়ে একদিন ওই আকাশ দেখেছিলাম দুচোখ ভরে। এবারেও দেখলাম। কিন্তু দু- চার বছর আগের সেই আকাশটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। আজ সে আটকে আছে শুধু ফেসবুকের পাতাতেই। মেসেঞ্জার, হোয়াপে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। বুঝতে পারলাম, এই দু'চার বছরে অনেককিছুই বদলেছে। দেখার চোখটাও বদলে গেছে ভীষনভাবে। আসলে চোখ তো দেখে না। দেখে মন।

ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাউন্ডুলে মেঘের ঘোরাঘুরি। করোনা আতঙ্ক তাদের ঘরবন্দি করতে পারেনি। সময় হতেই দিব্য বেরিয়ে পড়েছে তারা গায়ে বাতাস লাগিয়ে। ঠিক ওই দুর্গা ঠাকুরের পেছনে ঝোলানো আকাশের ছবির মতো। রোদের আলোতেও সোনারং। কলকাতা শহরটা কংক্রিটের জঙ্গল হলেও, আজও কাশের ছন্দ চোখে পড়ে বাইপাসের ধারে। আপনমনে তারা বাতাসের সোহাগে দোল খায়। 'দে দোল দে দোল ওরে দে দোল!'
ওই আকাশ, ওই কাশের দোলা এখন যেন ভীষন হাতছানি দেয়। কানেকানে বলে- "আর কতো? এবার চলে আয় দেখি আমাদের দেশে। যখন ইচ্ছা ঘুরবি। ভেসে বেড়াবি। দোল খাবি। রবীঠাকুরের গান গাইবি- "আজ চাঁদের আলোয়/ মিলায় আমার দুঃখসুখের সকল অবসান।" চলে আয়। এখানে একটুও মনখারাপ নেই।"

আর মন বসে না আঁকায়। লেখায়। মাঝেমাঝেই অলস হয়ে গড়াগড়ি খায় মন। বিছানায় পড়ে পুরনো শরীর। চাগাবার চেষ্টা করি। কাজ হয় না। প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়- "মনের কাজ কী? ওই রাজ্যের লেখা আর আঁকার রসদ জুগিয়ে চাওয়া।" সে কিছুতেই বোঝে না, সব ভোলানো ব্যস্ততার কথা। তবু ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে তো জীবন উঁকি মেরেই যায়। বেজে ওঠে বিষাদের সুর। শেষবর্ষা শরত শুরুর নিঃসঙ্গ দুপুরের এক অনন্ত শূন্যতা।




কাঁচ জানলার ওপারে এসে বসে এক পাখি। ছোট্ট, গোলগাল। নামধাম কিছুই জানি না। কীভাবে সময় বোঝে কে জানে? দুটো বাজলেই হলো। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ওর হাজির হওয়া চাই। বন্ধ জানলার এপারে আমি, ওপারে সেই পাখি। একদৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে হয়, কতদিন ধরে খুঁজে আমার দেখা পেয়েছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর, জানলা ঠোকড়ায়। কিচির মিচির করে কতকিছু বলে।
আমিও বলি- "আয় ঘরে আয়।" দুজনে দুজনার ভাষায়। বাকীটুকু চোখে চোখে। দু'একবার জানলা খুলে দিতে গিয়ে দেখেছি, ও পালিয়ে যায়। ঠিক ভরসা করে উঠতে পারে না আমাকে।
আসলে পৃথিবীর অনেককিছুই বন্ধ জানলার ওপারে থাকাই ভালো। দেখা যায়। ছোঁয়া যায় না। ইশারায় কথাবার্তাও হতে পারে। মাঝের কাঁচ সরে গেলেই বিপদ। বেরিয়ে পড়তে পারে নখ দাঁত। জীবন ওই ছোট্ট পাখিকেও সেকথা শিখিয়ে দিয়েছে। তবু বেশ কিছুক্ষণ সময় কেটে যায় ওই পাখির সঙ্গে।

ভাবি, ওই পাখিটাও কি একা? আর এতদিনে ও বুঝে গেছে আমিও একা। তাই কি রোজ আমার সঙ্গে খানিকটা সময় কাটিয়ে যায়? একদিন পাখি আর এলো না। বসে রইলাম ওর অপেক্ষায়। ততদিনে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে পাখির জন্য অপেক্ষা করা। ঘড়ি দেখি। আড়াইটা বেজে গেছে। পেছনের দরজা খুলে দেখি, ওর দলের কাউকে দেখা যায় নাকি। তিনটে বাজার পর আশা ছেড়ে দিলাম পাখির। হঠাতই মনে হলো, পাখিদেরও কি করোনা হয়? শুনিনি তো এখনও। পোষ্যকিছু জীবজন্তুর মধ্যেও উপসর্গ দেখা গেছে বলে শুনেছি। তবে কোথাও পাখির কথা বলা হয়নি। তাহলে কি জ্বরজারি? সিজন চেঞ্জের সময় বলে কথা। মোট কথা মনটা কেমন যেন করে উঠলো। মনে মনে বললাম, পাখি তুমি যার আকাশেই থাকো, ভালো থেকো।

একা থাকার সুবিধাও অনেক, অসুবিধাও অনেক। কাজ করার যেমন অঢেল সময়, তেমনি অঢেল সময় অকাজেরও। আজেবাজে চিন্তা। যেমন আজ মাথায় ভর করলো পাখির চিন্তা। জীবনের যে অধ্যায় ভুলে থাকার জন্য এত ব্যস্ততা, সেই অধ্যায় আবার সুযোগমতো ভেসে ওঠে। আর ক্রমশ তলিয়ে যেতে থাকি আমি। সেই তলানোতে মুক্তির স্বাদ। ভয় পেয়ে যাই ওই স্বাদ চাখতে। সক্রেটিসের মতো নির্বিকার হয়ে হেমলকের স্বাদ চেখে, মুক্তপুরুষ হওয়ার স্পর্ধা নেই আমার। সূর্যের আলো আমার বড়ো প্রিয়। মানুষ ছাড়া থাকতে বড্ড ভয়।
সক্রেটিসের মতো প্রখর আত্মসম্মান নেই আমার। পালাতে রাজি হলেন না অন্ধকার কারাগার থেকে। তাহলেই ইতিহাস সক্রেটিসের গায়ে দেগে দিতো 'পলাতক'- এর সিলমোহর। হাত কি একটুও কেঁপেছিলো জহ্লাদের হাত থেকে হেমলকের পাত্র তুলে নিতে? প্রস্তুত হলেন সক্রেটিস আলো ছেড়ে অন্ধকারের দুনিয়ায় চলে যেতে।

লজ্জায় মুখ ঢেকেছিল জল্লাদ। বিষের শেষ বিন্দুটুকু গলায় ঢেলে দিয়েছিলেন সক্রেটিস। পায়চারি করেছিলেন যতক্ষণ না ওই মারাত্মক বিষ সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। তারপরেই শুয়ে পড়লেন সাদা চাদরে আপাদমস্তক ঢেকে। কয়েক মুহূর্ত পরেই চাদর সরিয়ে মুখ বের করলেন তিনি। মাথার পাশে বসা শিষ্যকে বললেন সক্রেটিস- এক প্রতিবেশির কাছ থেকে একটা মুরগি ধার করেছিলাম। সেটা শোধ করে দিয়ো।

আমারও ধার আছে ওই পাখির কাছে। অনেকগুলি দুপুর। সব শোধ করে দেবো।
সব ভাবনার শেষে ফের মন জিজ্ঞেস করলো- পাখি কাল আসবে তো?


মন্তব্যসমূহ