রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন বিশেষ

 দিন প্রতিদিন বিশেষ 


  ।। ভার্চুয়াল দুনিয়ার আমি একজন ।।



     
 কাজল ভট্টাচার্য

এখন আর কোনও ফোনকলের অপেক্ষা করি না।
ঘনঘন মোবাইল খুলে আর দেখি না, কারও মেসেজ ঢুকলো কিনা। হোয়াপে না মেসেঞ্জারেও না। ভার্চুয়াল দুনিয়ার সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে আমার বাস্তব জগতের। আকাশবিহার শেষ করে ফানুসও একসময় ফিরে যায় জমিতে। রোমাঞ্চের শেষ আছে। বাস্তব আদি অনন্তের শেষ নেই । সেখানে সবার ঠাই। 

তবু কখনও ভার্চুয়াল দুনিয়া থেকে টুক করে খসে পড়ে একটা মুখ। বছরশেষের অনুপস্থিতি পেরিয়ে ভেসে ওঠে ফেসবুকের মেমোরিতে। তখন আমি কিছু একটা পোস্ট করলেই হলো। তর সইতো না। প্রথম লাইকটা ওর।
- এরমধ্যেই পড়ে ফেললে? এতো সেই স্বামীজির বই পড়াকেও টেক্কা দিলো।
- আরে লাইকটাতো এমনই। তোমার লেখা পড়ে, ছবি দেখে একটু ভাবি। অনেকসময় আরও একবার পড়ি বা ছবিটা দেখি। তারপর মাথার মধ্যে কমেন্টটা খেলে গেলেই লিখে ফেলি। 
এখন আর তার মাথায় কমেন্ট খেলে না।

একেকজন এক একরকম। 
এক্সিবিসন করো না কেন? জানতে চাইতো।
- অতো ছবি নেই বলে।
- ছবি আঁকো না কেন?
- টাকা নেই বলে।
- কতো টাকা লাগবে বলো?
নিজের থেকেই এগিয়ে এসেছিলো। আবার নিজের থেকেই চলেও গেছিলো।

অনেকের সঙ্গেই ছুটিছাটার দিনগুলিতে বেরিয়ে পড়তাম। কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস অ্যাকাডেমিতে জমাট আড্ডা। আবার ময়দানের নিরিবিলিতে কখনও একটু গা ঘেঁষাঘেষি। হাতে হাত ধরে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের নুড়ি বেছানো রাস্তায়। সূয্যিমামা তখন পাটে যেতে বসেছে। পাখিদের প্রত্যাবর্তন। আমাদের উদ্দেশ্যহীন পথ চলা। দুজনেই জানতাম। তবু পথের নেশা আছে, সঙ্গের উষ্ণতা আছে। এভাবেই চলতো। 
দুজনের ছবি পোস্ট করতো। ওপরে জব্বর ক্যাপশন। এনজয়িং টুগেদার। এক সুন্দর সন্ধ্যা। নীচে কমেন্ট- এই দিনগুলি যেন ফিরে ফিরে আসে। এক সুন্দর সন্ধ্যা উপহার দেওয়ার জন্য অনেক শুভেচ্ছা। আজ কী লাগছিলো তোমাকে!
বাড়ি ফিরে রাত গভীরে মেসেজবক্সে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতো- এটা কেন বললে? ওটা কেন করলে?
এই শত কেনর উত্তর খুঁজতে দিশেহারা আমি। অর্জুন আমি। কৃষ্ণ হতে পারিনি।




দলে যেত সঙ্গী। আজ এ আছেতো, কাল অন্য আর একজন। কেন? তার ঠিকঠাক জবাব দেওয়া অসম্ভব। আসলে কোথাও পৌঁছনোর তাগিদ না থাকলে বোধহয় অমনটাই হয়। শুধু ভালো লাগার সম্পর্ক টেকে না।

দু একজনতো আবার নিয়ম করে খোঁজখবর নিতো।
অনলাইন হতে আধঘণ্টা দেরি হলেই রাজ্যের চিন্তা। কীগো, কী ব্যাপার? খেপে খেপে কতো কথা। পরামর্শ স্বাস্থ্য বিষয়ক। মাঝেমাঝেই জানিয়ে দেওয়া, সে আমার জন্য কতো উতলা। 
- খেলে? উত্তরের অপেক্ষা না করেই, বেলা দু'টো বাজে। আর দেরি করো না।
- খাওয়া হয়ে গেছে।
- কী খেলে?
- ডাল রুটি মাছ আলু সয়াবিনের তরকারি।
- দুপুরে একটু ভাত খেলেতো পারো। 
ইচ্ছে হয় ঘাড়টা ধরে জিজ্ঞেস করি- ভাত খেয়ে কোন দেশোদ্ধারের কাজটা করে ফেলেছো সুন্দরী? 
এরপরের প্রশ্ন- কীসের ডাল?
ব্যাস, তড়াং করে মেজাজটা খারাপ হয়ে যেত। গত তিরিশ বছরেরও বেশি হোটেল, হোম ডেলিভারিতে খেয়ে চলেছি। ডালের জাত ধর্ম পরিচয় জানা দরকার আছে বলে মনে হয়নি। তবে ছোলার ডাল হলে চিনতে পারি।
এরপরেই মাছের পরিচয়। বিরক্তির একশেষ। সবশেষে মাঠের বাইরে মাইক্রোফোনের সামনে বসে থাকা বিশেষজ্ঞর মত- রোজ এরকম খেলে শরীর টিকবে নাকি?
ইচ্ছে হয় বলি- তবু এই শরীরটাকেই তো পছন্দ। 

আবার আর একদল ছিল যারা খেয়াল রাখতো আমার পোস্ট। একটু বেসুরো মনে হলেই কতো জিজ্ঞাসা। প্রকাশ্যে কমেন্ট বক্সে। অপ্রকাশ্যে মেসেঞ্জার বা হোয়াপে। বেশিভাগটাই পুরনো ফাটা রেকর্ড বাজানোর মতো একঘেয়ে।

অনেকসময় মেসেজবক্সটা দেখি। সেই ঝাপসা হয়ে আসা মুখগুলি। যাদের সঙ্গে হামেশাই বকবক হতো। কখনও মিনিট পাঁচেক, আবার কখনও আধঘণ্টা। আবার অনেকে ছিল যাদের সঙ্গে কথা হতো একটা নির্দিষ্ট সময়ে। রাতগভীরে। আর ছিল বিদেশের এক বন্ধু। আমাদের থেকে গড়পরতা পাঁচ, ছ'ঘণ্টা পিছিয়ে তার দেশের ঘড়ি। ডিউটি থেকে ফিরে সে যখন কথা শুরু করতো, তখন আমার ঘড়িতে রাত একটা। কথা শেষ হওয়ার ঠিক থাকতো না। কখনও রাত গড়িয়ে ভোর হতো। তবে সেটা হতো সাধারণত সপ্তাহে এক দুদিন। আর বাকী দিনগুলিতে মেসেজ। সেই প্রবাসিনীর ভার্চুয়াল ইমেজ ধরা থাকলো ফেসবুকের পাতায়।



আসলে গোটাটাই 'লভফিভার'। প্রণয়জ্বর। ধাঁ ধাঁ করে পারদ চড়ে। যতই এন্টিবায়োটিক গেলো, ঠেটার মতো পারদ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে। সময় হলেই শুরু হবে পারদ নামা। এই নামার সময়টায় একটা ভোগান্তি। সকালে নামে তো দুপুরে চড়ে। বিকেল নাগাদ কিছুটা নামলেও নামতে পারে। রাতে আবার দুরন্ত। সময়ের পেনিসিলিনে একদিন ফের সব স্বাভাবিক। আর মনে থাকে না সেই প্রণয়ের কথা। জ্বর হয়ে ঘামের বিন্দু বেয়ে নেমে যায়।
সব মুখগুলোই ঝাঁকের কইয়ের মতো। দলবেঁধে আসে, দলবেঁধে যায়। হারিয়ে যায় স্মৃতির উজানে।

তুমিও একদিন হারিয়ে যাবে। আমিও। ফেসবুকের সার্ভারে ধরা থাকবে আমার ফেলে যাওয়া কিছু ছবি। যা কোনদিন কোনও এক্সিবিসনে দেখা গেলো না। বেশকিছু লেখা জমা হয়ে থাকলো আমার ট্যাবের নোটসে, কমপিউটরের ফাইলে। সবগুলি শেষ করা হয়নি। আবার অনেক লেখাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলো পেপারে ম্যাগাজিনে। তার খবর আর কে রাখে! দেশবিদেশের অনেক তারিফ জমা পড়েছিল সেই ভার্চুয়াল জমাখাতায়। প্রচুর লেখা ভেসে বেড়িয়েছে নেট দুনিয়ায়। ছাপাবই হয়ে বেরোয়নি। সবই হারিয়ে গেছে টাইম অ্যান্ড স্পেসে, মহাকালে। এবার আমার পালা।



মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন