রবিবাসরীয় সাহিত্য সাধনা

 আমাদের নিয়মিত সাহিত্য সাধনার দিন প্রতিদিন  


আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিকপত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম । আজ তাঁর ধারাবাহিক থেকে একটু চোখ ফিরিয়ে আবার স্বাদ নিই  ধারাবাহিক উপন্যাসের।এবার থেকে  প্রতি রবিবার প্রকাশিত হবে এক একটি পর্ব। কারণ কিছুই নয় সন্দীপের উপন্যাসের এক একটি অধ্যায় মানে এক একটি গল্প। তাই রবিবাসরীয় একটা সাহিত্যের আড্ডা ভরানো থাক সন্দীপের উপন্যাসে।   

ঝুলবারান্দার নীচে #৩৯



Image may contain: 1 person, closeup



সন্দীপ চক্রবর্তী

নবদ্বীপে থাকার মেয়াদ ফুরিয়ে গেল। আজ দুপুরের ট্রেনে কলকাতায় ফিরব। ছোটবেলায় বাবা-মা' সঙ্গে যখন দেওঘর-শিমুলতলা-রাজগীর বা পুরীতে বেড়াতে যেতাম তখন ফেরার দিনে মন ভারী হয়ে থাকত। যেহেতু আমি বড়ো হতে পারিনি কিংবা বলা ভালো, আমার মধ্যে যে ছেলেটা আজও লাট্টুর গায়ে লেত্তির পাক দিতে দিতে নিজের সঙ্গে কথা বলে, সে আমাকে বড়ো হতে দেয়নি-- তাই কোনও জায়গা থেকে চলে যাবার সময় এখনও আমার মন খারাপ হয়। যদিও জানি ফিরতে চাইলে ফিরে আসা যায়। আমি ফিরেও আসব। কিন্তু আজ যাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি আমার ফিরে আসার দিনে সে কি আজকের মতো থাকবে? হয়তো সময় তাকে পালটে দেবে। আমার সঙ্গে তার যখন দেখা হবে সে তখন নতুন মানুষ।
আশ্রমের বাগানে তমালগাছের নীচে বসে এসব কথাই ভাবছিলাম। নিতাই ঠাকুর দেখতে পেয়ে আমার কাছে এলেন, কী ব্যাপার! একা বসে কী ভাবছেন?
আপনি তো সবই জানেন।
অ। মন খারাপ। তা, কাল তো আপনি বললেন পার্বণের সময় আবার আসবেন। দু'সপ্তাহ পর পুজো, তারপর আর দু'টো মাস। দেখতে দেখতে কেটে যাবে মশাই। তবে হ্যাঁ, আমার একটা দাবি আছে৷
দাবি! বেশ শুনি আপনার কী দাবি।
পরের বার কিন্তু হাতে সময় নিয়ে আসবেন। এবারের মতো বুড়ি ছুঁয়ে পালিয়ে গেলে চলবে না। বোঝেন না কেন, আপনি এলে আমারও খুব ভালো লাগে আর চলে যাবার সময় মন খারাপ হয়ে যায়।
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম নিতাই ঠাকুরের মুখের দিকে। অদ্ভুত মানুষ। আমার মন খারাপ বলে সান্ত্বনা দিতে এসেছিলেন, কথায় কথায় নিজের মন খারাপের কথা বলে ফেললেন।
আমার ট্রেন দেড়টায়। স্নান-খাওয়া সেরে দুলারির সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। দুলারি বলল, একবার চুনার চলিয়ে না বাবুজী। পাঁচ সাল প্যাহেলে গেয়ে থে। গুরুজী আভি ভি আপ কে বারে মে বাতে করতে রহতে হ্যায়।
গুরুজী মানে মিশিরজী। মদনলাল মিশির। দুলারিদের গ্রামের গোপাল মন্দিরের পুরোহিত। ভারী সজ্জন মানুষ। বিশটা গাঁয়ের মানুষ দেবতাজ্ঞানে শ্রদ্ধা করে কিন্তু মিশিরজী কারও প্রণাম নেন না। প্রণাম করতে গেলে বলেন, ম্যায় সেবক হুঁ বেটা। সেবকোঁ কো প্রণাম নেহী কিয়া যাতা। মেরা প্রভু কো প্রণাম করো।
দুলারিকে বললাম, গুরুজী কো মেরা নমন কহেনা। অন্দর সে বুলাওয়া আয়া তো হাম জরুর যায়েঙ্গে।
পথ আবার আমাকে ফিরিয়ে আনল। মাঝে মাঝে যখন আড়াল থেকে নিজেকে দেখি তখন বেশ অবাক হয়ে যাই। এত জায়গায় যাই। এত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়। তবুও আমার মানুষ দেখার নেশা কাটে না। একজন মানুষ মানে একটি পৃথিবী। তার সেই অচেনা পৃথিবীর বাতাসে নিঃশ্বাস না নিতে পারলে মনে হয় যেন চেনা মানুষের ভিড়ে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছি। অনেক কিছু হারিয়েও ফেলছি। তখন নিজেকে ভারী অচেনা লাগে৷
নবদ্বীপ থেকে ফেরার পর প্রায় দিন দশেক কেটে গেল। কাজের চাপ বেশি ছিল। তাই একটা বিশেষ কাজ করা হয়ে ওঠেনি। পুজোর সময় বাড়িতে থাকলে আমি আদিত্যদাদের বাড়িতে একবার যাই। ওদের বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়। বিশাল ঠাকুরদালানে মূর্তি গড়েপূর্ণকাকা। মৃৎশিল্পী পূর্ণচন্দ্র পাল। ছোটবেলায় স্কুল থেকে ফিরেই চলে যেতাম। অবাক বিস্ময়ে দেখতাম মূর্তি গড়া। পূর্ণকাকা তখন আমার চোখে জাদুকর। প্রতিমার ভুরু আঁকতে আঁকতে পূর্ণকাকা জিজ্ঞাসা করত, বল তো, দুর্গার কোন হাতে কী অস্ত্র থাকে? আমি গুলিয়ে ফেলতাম। পূর্ণকাকা রাগ করত, তোর মন কোথায় থাকে শুনি? প্রত্যেক বছর বলি, তবুও মনে রাখতে পারিস না! কাল কাগজ পেনসিল নিয়ে আসবি। লিখে নিয়ে যাবি।-- না, আমি কোনওদিনই কাগজ পেনসিল নিয়ে যাইনি। কারণ দুর্গার কোন হাতে কী অস্ত্র আছে জানার থেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাদুকরের মনোযোগ আকর্ষণ করা ছিল আমার কাছে বেশি জরুরি। সাধারণত পূর্ণকাকা বেশি কথা বলত না। সারাদিন একাগ্রমনে কাজ করে যেত। আমি বেশি কথা বললে বলত, কে আছিস আমার লাঠিটা দিয়ে যা তো। একজনের পিঠে ভাঙতে হবে। তাই প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেবার কথা ভাবতেও পারতাম না। কারণে-অকারণে বেশি কথাও বলতাম। পুরস্কার যখন তিরস্কারের হাত ধরেই আসবে তখন এ ছাড়া আর উপায় কী!
চতুর্থীর বিকেলে আদিত্যদাদের বাড়িতে গেলাম। ওদের পূর্বপুরুষ এখানকার জমিদার ছিলেন। জমিদার পরিবার নানা টুকরো-টাকরায় ভেঙে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেলেও, বাড়িটি এখনও পর্যন্ত অটুট।
চওড়া বারান্দায় আর্মচেয়ারে বসে আদিত্যদা বই পড়ছিল। আমায় দেখে হেসে বলল, এসে গেছিস! ভেরি গুড। ক'দিন থেকেই পূর্ণকাকা তোর কথা বলছে। তবে খুব ভালো দিনে এসেছিস। একটু পরেই প্রতিমার চক্ষুদান হবে। দেখবি তো?
দেখব না মানে! এখনই চলো।
আদিত্যদাদের পরিবারের সকলকেই চিনি। চক্ষুদান দেখতে সবাই জড়ো হয়েছে ঠাকুরদালানে। কুশলবিনিময় সেরে এগিয়ে গেলাম মূর্তির কাছে। পূর্ণকাকা রং তৈরি করছে। বয়েস হয়েছে বলে গত কয়েক বছর ধরে মূর্তি গড়ার কাজ করে পূর্ণকাকার ছেলে অধীর। পূর্ণকাকা শুধু চক্ষুদান করে। এই সময় কথা বলা বারণ। শিল্পীর মনঃসংযোগে বিঘ্ন ঘটাতে পারে, এমন কোনও কিছুই করা যাবে না। পূর্ণকাকার কড়া নির্দেশ। যদি কেউ অমান্য করে তার কপালে দুঃখ আছে। একবার আমার ছোটবেলার বন্ধু অপুর নাকে সুড়সুড়ি লাগায় হেঁচে ফেলেছিল। সেবার আর চক্ষুদান দেখা হয়নি অপুর। ওকে নির্বাসিত করেছিলেন পূর্ণকাকা।
রং তৈরি হয়ে গেল। পূর্ণকাকা জয় মা দুর্গা বলে চোখ আঁকতে শুরু করলেন। এ বাড়ির প্রতিমার চোখ কেমন হয় জানি। কিন্তু আঁকা যখন শেষ হল দেবীর চোখের দিকে তাকিয়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম। এ তো আমার চেনা দুর্গা নয়! এ যেন অন্য কেউ! তবে অন্য কেউ হয়েও অচেনা নয়। আমি তাকে চিনি। আশ্চর্য হই এই ভেবে, পূর্ণকাকা কী করে চিনল! সে তো তার সাদা থানের গণ্ডী পেরিয়ে কোথাও যায় না।
আদিত্যদা উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, অপূর্ব! ঠিক এরকমটাই আমি চাইছিলাম। এতদিন তো শক্তিরূপিণীর পুজো করলাম, এবার মাতৃরূপের পুজো হোক। জয় মা! -- বলেই আদিত্যদা আমার দিকে ফিরল, কী রে! মায়ের চোখ ভালো হয়েছে?
বললাম, পূর্ণকাকার কাজ কখনও খারাপ হয় না আদিত্যদা। তবে এবার পূর্ণকাকা শুধু চোখ আঁকেনি, চোখের দৃষ্টিটাও এঁকেছে। না জানি কার জন্য পথ চেয়ে আছে এই দুর্গা। সে কবে আসবে কে জানে!
আদিত্যদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পূর্ণকাকার কাছে গেলাম। দেরি করে আসার জন্য বকা খেলাম। ইচ্ছে হল জিজ্ঞাসা করি, মোহরকে তুমি চেনো পূর্ণকাকা?--কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না। ঘটনাটা একটা সমাপতন হয়েই থেকে যাক।
চলে আসার সময় আর একবার দেখলাম মা দুর্গাকে। মনে হল মোহর চেয়ে আছে আমার মুখের দিকে। আর জিজ্ঞাসা করছে, পুজোয় মৌরিপুরে আসবেন তো?
(আগামী পর্বে সমাপ্য)

Comments




মন্তব্যসমূহ