করোনা পরবর্তী নিউ নর্মালে সবাই রাস্তায় , কতটা নিরাপদ আমরা ?

 দিন প্রতিদিন বিশেষঃ

   ।। কোথায় চলেছে মিছিল ।।




কাজল ভট্টাচার্য, কলকাতা, ৩১  ডিসেম্বর:

(একদিকে নতুন করে করোনার হানা। আদালতের হুঁশিয়ারি, নিউ ইয়ারের ভিড়ে রাশ টানতে হবে। ওদিকে লাখো লোকের রোড শো করতে ব্যস্ত নেতারা। কপালের ভাঁজ ফের গভীর চিকিৎসকদের। বছর ঘোরে। ক্যালেন্ডার পাল্টায়। রাজনীতির ছবিটা একই থাকে।)

নিউ ইয়ারের অনুষ্ঠানে যাওয়া মানা।
বাঙালির বর্ষবরণের দিনটাও কেটেছিলো ঘরে বসেই। 
তবে মিটিং মিছিলে যেতেই পারেন। দেশসেবাই যখন ব্রত, তখন ওই ঝুঁকিটা স্বচ্ছন্দে নেওয়া যেতেই পারে। রাজ্যের সংস্কৃতির বক্তারাও সেরকমটাই চাইছেন। সোনার বাংলায় আত্মবলিদানের নজিরতো খুব কম নেই। এই সেদিনও বাঙালী শহিদ হয়েছিল। করোনা রোগীদের ঘরে ফিরিয়ে দিতে গিয়ে, অনেক চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরাই আর নিজেদের ঘরে ফিরতে পারেননি। 

...ভিড় টানার টক্কর!

শুভেন্দু অধিকারী বলতেই পারেন, গোটা নন্দীগ্রাম উঠে আসবে। অনুব্রত মণ্ডল ছাতি ঠুকে দাবি করতেই পারেন, আড়াই বলেছিলাম। তিন লাখ লোক এসছিল। তর্ক চলতেই পারে কে বাইরে থেকে লোক জড়ো করেছিল, আর কে ঘরের লোক ডেকে রাস্তা ভরিয়েছিল। তবে ঘরের হোক অথবা বাইরের, সবাই দেশের অতি সাধারণ নিরীহ নাগরিক। বিশিষ্টরা সাধারণত ওই জনপ্লাবনে সামিল হন না। তাঁদের জায়গা আলাদা। মঞ্চও আলাদা। 


একেকটা মিছিল মানেই অজস্র মাথার সারী। মাস্ক থাকলে শাঁক ফোকা, নেতার নামের উলুধ্বনি জয়ধ্বনিতে আকাশ বাতাস কাঁপানো চলবে কি করে? জনসমুদ্রের ঢেউয়ে সওয়ার নেতারা ভাসতে ভাসতে পৌঁছে যান মঞ্চে। পদ্মশিবিরে ঢুকে পড়লেই পাপস্খলন। সব ধুয়েমুছে সাফ। এমনটাই বলেন তৃণমূল কর্তারা। "বুকের পাটা থাকলে তবেই তৃণমূল করা যায়।" এরকমটাই দাবি করেন তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ঠিকই বলেন, ওই ভরসাতেই তো অমিত শাহ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রোড শোয়ে মানুষের ঢল নামে। 



দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, এমনকি শুভেন্দু অধিকারীর মিটিং মিছিলে যেতেও নিষেধ নেই। আর পিঠে যখন সরকার বাহাদুরের প্রশ্রয়ের হাত, তা সে কেন্দ্রের হোক বা রাজ্যের, তখন কোভিডের সাধ্য কী কাউকে ছোঁয়! এমনই আত্মবিশ্বাস। একবার নেতাদের ডাক পেলেই হলো, কাতারে কাতারে মানুষ হাজির।

কিন্তু কারুর ডাক পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকে না কোভিড ভাইরাস। চলাফেরা ঘোরাঘুরি ছড়িয়ে পড়ায় তারা আগাপাশতলা স্বাধীন, স্বতন্ত্র। এর আগেও সে চুপিসারে দমদম বিমানবন্দর ছুঁয়ে পা ফেলেছিলো কলকাতায়। এবারেও তাই।

...ম্যায় তো সাহব বন গয়া!

সেবারেও লন্ডন থেকে এক আমলাপুত্রের সন্তানের গায়ে চেপে কলকাতায় ঢুকে পড়েছিল করোনা ভাইরাস। দিনটা ছিলো রবিবার (15মার্চ)। নবান্নে কর্মরত ওই আমলার দায়িত্ব জ্ঞানহীনতার ঘটনার খবর কানে যেতেই চটে গেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেছিলেন, "এটা আমি সমর্থন করি না।" এরপরেই ডিসেম্বরের ২০ তারিখ। সেই লন্ডন থেকে এবারেও। করোনার নয়া স্ট্রেন সংস্করণ নিয়ে ফিরলেন আরও এক মহানগরবাসী। গোটা দেশে ইতিমধ্যেই এরকম রোগির সংখ্যা কুড়ি। আগামীতে এই সংখ্যা বাড়বে বৈ কমবে না।


মার্চ আর ডিসেম্বরের মধ্যেকার এই সময়টা কাটলো লকআউটের কালাকানুনে। সেই ২৩ মার্চ বিকেল পাঁচটা থেকে অগাস্ট মাসেও সপ্তাহে দুদিনের লকডাউন দেখেছে বাংলা। ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত করোনার ছোবলে প্রাণ গেছে ন'হাজার ছশো পঁচিশজন বঙ্গবাসীর। আজও সেই করোনার ছায়া বিদায় হয়নি। তারমধ্যেই আবার শক্তি বাড়িয়ে নতুন করে হানাদারি কোভিড ভাইরাসের।

ওই ঘটনার কথা মনে রেখেই ডাক্তারবাবুরা ফাটা রেকর্ড বাজিয়েই চলেছেন- "ওগো, আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।" কিন্তু নেতা মন্ত্রীর মুখের অমৃত ভাষন ছেড়ে ডাক্তারবাবুর প্যানপ্যানানি শোনা, কখনোই বাঙালির সংস্কৃতিতে ছিলো না। অথচ এই করোনা রোগিদের ঘরে ফিরিয়ে দিতে গিয়ে, নিজেদের আর ঘরে ফেরা হয়নি বেশকিছু চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীর। গত সেপ্টেম্বরের ১৬ তারিখে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী অশ্বিনী কুমার চৌবেকে এক তথ্য দেয়। ওই তথ্যে জানানো হয়, করোনা রোগির চিকিৎসা করতে গিয়ে দেশে ৩৮২জন মৃত ডাক্তারের মধ্যে ২৭জন বাংলার। অন্য এক তথ্যে সংখ্যাটা ৫১। এর সঙ্গে যোগ হবে যে নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা করোনাযুদ্ধে মারা গেছেন, তাঁদের সংখ্যাটাও। এঁদের করোনা শহিদ বললে নিশ্চয়ই কারুর আপত্তি থাকবে না।


...নেতা যখন শাসক!

দিকে দলের এই নেতারাই যখন মিছিল শেষে শাসকের কুর্সিতে বসেন, তখন তাঁদের ভিন্ন রূপ। সরকারের থেকে আজও করোনা সংক্রান্ত প্রচার প্রসার সবই চলেছে। এখনও মোবাইলে কল করলেই সেই সতর্কবাণী। সোশ্যাল ডিসটেন্সিং থেকে নিয়ে মুখে মাস্ক, স্যানিটাইজর ঘষার পরামর্শ। আবেদন নিবেদনে কাজ না হলে, কোথাও কোথাও জরিমানার ব্যবস্থাও আছে। 


এই বিধিনিষেধের মধ্যেও করোনা জুজুর ভয় কমতে শুরু করেছিল। জীবন ফিরছিল স্বাভাবিক ছন্দে। বড়দিনের রাতে দেখা গেছিল সেই 'নিউ নর্মাল' ছবিটাই। তবে সেই দৃশ্য থেকে শিউড়ে উঠেছিলেন অনেক স্বাস্থ্য সচেতন মানুষজন। নিউ ইয়ার যাপনেও রাশ টানলো কলকাতা হাইকোর্ট। মঙ্গলবার রাজ্যের মুখ্য সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিবকে আদালতের নির্দেশ, রাস্তায় করোনাবিধি মেনে মানুষের বেরনো নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি, জমায়েত করা চলবে না। উৎসব অনুষ্ঠানে বিধিনিষেধ থাকলে মিটিং মিছিলে তা থাকবে না কোন যুক্তিতে? নাকি নেতাদের রণহুঙ্কারে ভয় পেয়ে করোনা ভাইরাসও পিছু হটে।

কিন্তু শাসক নেতা হয়েই ডিগবাজি খান। আর তাঁর পেছন পেছন চলে মানুষের সারি। সব দেখেশুনে চোখের সামনে ভেসে ওঠে হ্যামিলনের সেই বাঁশিওয়ালার ছবি। আগে আগে বাঁশিওয়ালা, পেছন পেছন সার সার মানুষ। দু'হাজার কুড়ি থেকে তাঁরা সবাই পা বাড়িয়েছেন দু'হাজার একুশের দিকে। 
ভয় একটাই, নেতার ভূমিকা সামাল দিতে লেজেগোবরে না হন শাসক।







মন্তব্যসমূহ