দিন প্রতিদিন বিশেষ

 

দিন প্রতিদিন এর গল্প

।। একা এক পৃথিবীর গপ্পো ।।





(দূরে সরে যাচ্ছি তোমার থেকে আমি। আমার থেকে তুমি। চুপিসারে, সবার অলক্ষ্যে। একা হয়ে যাচ্ছে মানুষ। হারিয়ে যাচ্ছে শূন্যতায়। অনন্তে।) 

কাজল ভট্টাচার্য: 

ডান হাত মেলে আধপাক ঘুরুন। হাত কাউকে ছুঁয়ে গেলো নাকি? 
এবার একইভাবে বাঁহাত মেলে বাকী আধপাক ঘুরুন। কারুর ছোঁয়া পেলেন এবার?
উত্তরটা যদি হয়- না, তাহলে আপনি একা।
ডাইনে বাঁয়ে কেউ নেই। আগে পিছে চারধারে শুধুই শূন্যতা। হাত বাড়ালে হাওয়া কেটে হাত ফিরে আসে তার জায়গায়। কারুর ছোঁয়া পায় না। যেদিকেই চোখ যাক না কেন, শুধুই এক আকাশ শূন্যতা। আর সেই শূন্যতায় ভেসে চলা। একা। একেবারে একা।

সবাই ঘুরে চলেছে। যে পৃথিবীর বুকে আমাদের বাস, সেও পাক খেয়ে চলেছে। রোদে তেঁতে ঘুরে চলেছে সূর্যও। রোজ ভোরবেলায় ঘুম ভাঙায়, তারও নিস্তার নেই। হাসতে হাসতে চাঁদও ঘোরে। নিস্তার নেই কারও। গ্রহ উপগ্রহ তারা নক্ষত্র। টিকতে চাইলে চক্কর মারতেই হবে। নইলে খসে পড়তে হবে। এক অসীম শূন্যে সবাই ভাসছে আর ঘুরছে।

শূন্যতা কখনও জমাট হয় না। তরলও না। বায়বীয়। তাই এক অসীম শূন্যতায় ভাসা। ভাসতে ভাসতেই খড়কুটো আঁকড়ে ধরা। অনেকটা বানের জলে ভেসে যাওয়া চারাগাছের মতো। পারে ঠেকলেই জমি আঁকড়ে ফের বেড়ে ওঠা। ঘর বাঁধার চেষ্টা। জলের তোড়ে সেই ঘরের ভেসে যাওয়া। ফের বেসামাল ভেসে চলা। ভাসতে ভাসতেই, ভাসার কায়দাবাজিটা রপ্ত করে ফেলা। গাইতে গাইতে গায়েনের মতো। 
"শুধু স্রোতে ভাসা!" 
ভাসতে ভাসতেই পৌঁছে যাওয়া সেই আদিতে।


#আদিযাত্রা...




মরু পাহাড় ডিঙিয়ে সেই পথ চলা। একদিন সিন্ধু অববাহিকায় পৌঁছে যাওয়া। কবে পথ চলা শুরু? আজ আর মনে পড়ে না। দেড় হাজার হতে পারে, আবার দু'হাজার হলেও হতে পারে।
সেই আদিতেও তো আমি একা। ঠিক আজকের মতোই তখনও অকম্মার ধাড়ি। নিজের পেট ভরানোর বিদ্যাটাও ছিলো না। যাদের সেই বিদ্যেটা ছিলো, কাঁধে লাঙল তুলে নিয়েছিলো। ধান ফলিয়েছিলো, গম ফলিয়েছিল। ঘর বেঁধেছিল। 
আজ আবার তারাই নেমে এসেছে দিল্লির রাজপথে। তাদের মধ্যে খুঁজে বেড়াই সিন্ধু পারের সেই আদি কৃষকের মুখ। তন্নতন্ন করে খুঁজি। মুখের কাছে মুখ নিয়ে দেখি। খুঁজে পাই না। কালের অনন্ত প্রবাহে হারিয়ে গেছে অনেককিছুই। হারিয়ে গেছে সেই আদি কৃষকও। 

শহর থেকে গ্রামে। গ্রাম থেকে সেই অরণ্যে, ফিরে যাই আমি। আমার অতীতে। আজ বনবাদাড়ে তো কাল অরণ্যে। পাহাড়ের গুহায় কতোই না আঁকিবুকি কেটেছি আমি। এক গুহা কল্পনা। আমার হরফ নেই। রেখা আছে। সেই রেখা সাজিয়েই আমার নাবলা কথা এঁকে গেলাম গুহার গায়। রেখে গেলাম আমার আমিকে। 

মিতালী পাতিয়েছে বনবিথী। তান শুনিয়েছে মল্লিকা। গান শোনাতে পারেনি। মুখে ভাষা নেই বলে। নেচে উঠেছে প্রজাপতি। সোহাগ চাঁদনি রাতের বালুকাবেলার আলিঙ্গনে। গায়ে গা ডুবিয়ে কেটে গেছে কতো রাত। তখন রাতজাগা সিন্ধুর অনন্ত প্রতীক্ষা।


#উৎসবের রাত...




সন্ধ্যা নামলেই চুপিচুপি বেরিয়ে আসা পুরুলিয়ার শাল পলাশের চোখ এড়িয়ে। আলোআঁধারীর মাখামাখিতে অদৃশ্য আমি। মাথা উঁচু করে খাড়া দাঁড়িয়ে জয়চণ্ডী পাহাড়। চাঁদের আলো চেটেপুটে খাচ্ছে পাহাড়ের পাথুড়ে গা। পাথুরে জমির হৃদয় ছেঁচে ধানের খেত। ধানের শিষকে যেন শুইয়েই ছাড়বে মাতাল বাতাস। ধামসা মাদলের দ্রিমি দ্রিমি রহস্য বাড়ায় রাতের। 
"এই রাত তোমার আমার।" 
রাত দুজনের। যোগীর আর ভোগীর। ভোগীরা তখন দূরে, সারসার ছায়ামানুষ। সবার চোখে মহুয়ার রং। জ্যোৎস্নার আলোয় দোল লেগেছে শরীরে। জোড়া সাপের মতো পাক খাওয়া উদ্দাম যৌনতা। তখন যোগীর মতো নিরাসক্ত, পূবাকাশে ঢলে পড়া চাঁদ। 

ফেরার পথে পা চালাই। মন উচাটন। আনমনে আপনমনে। আকাশের দিকে তাকাই। তারাদের খুঁজি। বুঝতে চেষ্টা করি কোথায় এলাম। যাবোই বা কোথায়? উজিয়ে চলি পথ। সূর্যের আলোয় দিকভ্রষ্ট হই। পেছনে পড়ে থাকে সমাজ সংসার। সরে যেতে থাকে দূর থেকে দূরে। অনেক দূরে। ঠান্ডা হাওয়া গায়ে হাত বুলিয়ে যায়। পেটের খিদেটা যেন চাগাড় দিয়ে ওঠে। তারারা তখন গা ঢাকা দিতে শুরু করেছে। ঢুকে পড়ি বনের ভেতর। 
ফলফুল কোনটারই অভাব নেই অরণ্যে। পেট ভরতেই চোখ জড়িয়ে আসে। পৌঁছে গেছি কোনও এক অজানা দেশে। একটুও দেরি না করে চট করে উঠে বসি এক গাছের ডালে। গা এলিয়ে দিই। তলার শুকনো পাতায় খসখস। বুঝতে পারি সাপটারও খিদে পেয়ে গেছে। শুকনো পাতার ওপর দিয়ে নাচতে নাচতে চলেছে শিকার খুঁজতে। সামনের ডালে একটা প্রজাপতি এসে বসে। হাঁ করে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। চিনতে চেষ্টা করে অনাহূত অতিথিকে। দুচোখ জড়িয়ে আসে। পূব আকাশ তখন আলো ঝলমলে।


#অরণ্য যেন ধ্যানমগ্ন যোগী...




ঘুম ভাঙলো ময়ুরের ডাকে। এত সুন্দর পাখিটার ডাক, এত কর্কশ কেন কে জানে? সাপ খায় বলে নাকি, জানি না। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে রোদের ঝিলিক সারা গায়ে। ধ্যানমগ্ন যোগীপুরুষের মতোই অরণ্যের স্তব্ধতা। কোনও একটি পাতাও ফিসফিস করলে শোনা যায়। দিনের তৃতীয় প্রহর মনে হয়। ধীর পায়ে গাছ থেকে নেমে পড়ি। খানিক এগোতেই দেখি একফালি ঢালু জমি। সবুজ ঘাসের ফরাস বেছানো। কোনও গাছপালা নেই। ওপরে ঘন নীল আকাশ। অসীম শূন্যতা। তিনদিক জুড়ে শুধু গাছ আর গাছ। একদিকে প্রায় ফাঁকা। জমির মধ্যে রোদটা পড়লেও তিনদিক ছায়ায় ঘেরা। কী এক আবেশে জড়ায় শরীর।

চোখ খুলতেই দেখি জোনাকিরা ঝুঁকে আছে আমার ওপর। ফাঁকা মাঠে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাই। ওই তো স্বাতী। আরে, কৃত্তিকাটা গেলো কোথায়? বিশাখা অভিমান করেছে। চুপ করে মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে। চোখের ইশারা দিলো শতভিষা- এবার চলো। হাওয়া বললো ভেসে পড়ো। আবার পথে নামলাম। তারারাই পথ দেখালো। হেথা নয় হোথা নয় অন্য কোনখানে। চললাম নতুনের সন্ধানে। পা বাড়ালাম অজানার পথে। 
"বিস্ময়ে তাই জাগে, জাগে আমার প্রাণ!"


#একা এক বিশ্ব...




পাহাড়ের চূড়ায় মেঘের যৌনতা। সাগরের সঙ্গে আকাশের যৌনতা। চাঁদের সঙ্গে তারার যৌনতা। আলোর সঙ্গে আঁধারীর যৌনতা। কলির সঙ্গে প্রজাপতির যৌনতা। সৃষ্টির মহাচক্র। যৌনতার বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠলাম- আমি একা। পাহাড় ফিরিয়ে দিলো আমার কথা। হইহই করে উঠলো বন জঙ্গল অরণ্য। সবাই গলা মেলালো আমরাও একা। সেই একাকীত্ব বুকে আঁকড়ে একটু নীচে নেমে এলো আকাশ। সাগর বুক পেতে বলে, "একাই তো বয়ে চলেছি। নিরবধি অনন্তকাল।" কথা নেই চাঁদের মুখে। টুক করে খসে পড়লো বিশাখা। ঝুঁকে পড়লো বিশাখা কৃত্তিকা সবাই। সবাই বললো, "অন্ধকার আকাশে আমরাও একা।" 
তারায় তারায় বাজে সুর- 
"আমরা সবাই একা
আমাদের এই একার রাজত্বে!"
সোশ্যাল মিডিয়ায় স্টেটাস- সিঙ্গল।

এক জ্যোতিপুঞ্জর থেকেই তৈরি হয়েছিল শূন্যতা। ঘোর অন্ধকারের সেই শূন্যতার গর্ভ পূর্ণ হলেই সৃষ্টি। ঠিক যেমনটা চেয়েছিলেন সেই আদি সৃষ্টিকর্তা, ঋষি প্রজাপতি। শূন্যের গর্ভজাত সসাগরা এই পৃথিবী। তাই পরম স্নেহে সেই শূন্যতা ঘিরে থাকলো পৃথিবীর জন্মাবধি। এক অসীম শূন্যতা। এই শূন্যতাই আদি। অনন্ত। চিরসত্য।
"এক তুমি, তোমা মাঝে আমি একা নির্ভয়ে!"
শূন্যতেই শুরু। শূন্যতেই শেষ। মাঝে একটুকরো একাযাপন, নামজীবন।

( ক্যানভাস সৌজন্যঃ সংগৃহিত )


মন্তব্যসমূহ