বৃহত্তর ঝাড়খণ্ড গঠনের লক্ষ্যে ,সোরেনদের পাখির চোখ , ২০২১ এর বাংলা

 

নজরে বাংলা ভাগ, বৃহত্তর ঝাড়খণ্ডের স্বপ্ন মোর্চার



কাজল ভট্টাচার্য, কলকাতা, ৮  জানুয়ারি 


ভোট ভাগাভাগির কারিগররা তো আছেনই। আগামীতে চিন্তা বাড়িয়ে দিতে পারেন রাজ্য ভাগের কারিগররাও।
দলের নামে জাত ধর্ম বর্ণ সব ইতিমধ্যেই টুকরো টুকরো হয়েছে। কিন্তু আগামীতে যে রাজ্যটাকেও টুকরো করার দাবি উঠবে না, এমন গ্যারান্টি কোথায়? সেক্ষেত্রে কিন্তু জাত ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বিপন্নতার শিকার হবে প্রতিটি বঙ্গবাসীর অস্তিত্ব।

কেন এই সন্দেহ? 


বিহার ভাগ করে ঝাড়খণ্ড তৈরির কারিগর ছিলো ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা। সেখানেই থেমে থাকেনি মোর্চার স্বপ্ন। আজও তাদের লক্ষ্য বৃহত্তর ঝাড়খণ্ডের। আর সেই বৃহত্তর ঝাড়খণ্ডের অনেকটা জুড়েই আছে পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসী অধ্যুষিত কয়েকটি জেলা। 
সেই বৃহত্তর ঝাড়খণ্ড বানানোর লড়াইটা থেমে থাকেনি। স্বপ্নপূরণের জন্য জরুরি বঙ্গবাসীর আস্থা অর্জন।বাংলার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সেই আস্থা অর্জনের ব্যাপারটি বারেবারে যাচাই করে নিতে চাইছে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা। এবারেও তার অন্যথা হবে না বলে ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন মোর্চার সাধারণ সম্পাদক সুপ্রিয় ভট্টাচার্য। 

২০০০ সালে রাজ্য ভাগের সেই স্মৃতি আজও টাটকা প্রতিটা বিহারবাসীর মনে। ঘটনার দু'দশক পরেও, মনের সেই দগদগে ক্ষতে প্রলেপ দিতে পারেনি কংগ্রেস, রাষ্ট্রীয় জনতা দলের মহাজোট। ওই মহাজোটের শরিক হয়েই বিহার বিধানসভা নির্বাচনে শক্তিপরীক্ষায় নেমেছিল ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা। বিহারবাসী হায়দরাবাসী আসাদুদ্দিন ওয়েসির মিমকে আশার আলো দেখালেও, মোর্চার বেলায় হয়েছিল উল্টোটাই। সাত আসনে লড়াই চালিয়েও শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছিল মোর্চাকে। একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল পাঁচ বছর আগের বাংলা বিধানসভা নির্বাচনেও। মোট তেইশটি আসনে লড়তে নেমেছিল মোর্চা। কিন্তু সবগুলোতেই কুপোকাত হয়। 

বৃহত্তর ঝাড়খণ্ড তৈরির স্বপ্নপূরণে, বঙ্গ রাজনীতিতে দলের অস্পৃশ্যতা কাটাতে মরীয়া মোর্চাকর্তারা। এক্ষেত্রে তাঁদের কাছে নজির হতে পারে মিমপ্রধান আসাদুদ্দিন ওয়েসির পদক্ষেপ। ওয়েসি যেভাবে ফুরফুরা শরিফের হাত ধরে বঙ্গ রাজনীতিতে জায়গা করে নেওয়ার পদক্ষেপ করেছেন, মোর্চাপ্রধান হেমন্ত সোরেনও একই পথে পা বাড়ানোর রণকৌশল নিতে পারেন। ওয়েসির মতো সোরেনেরও পূঁজি তীব্র বিজেপি বিরোধিতা। সেই পূঁজির জোরেই বঙ্গ রাজনীতিতেও জোটসঙ্গী খুঁজে পেতে পারে মোর্চা।

বঙ্গ রাজনীতিতে পরিচিত হতে চেষ্টা চালাতে কসুর করেননি হেমন্ত সোরেন। 
২০১৯ সালে ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পদে তাঁর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে মোর্চাপ্রধান হেমন্ত সোরেন আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সৌজন্যরক্ষার তাগিদে সোরেনের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে রাঁচীতে হাজির হয়েছিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। আবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে ব্রিগেডে বিজেপি বিরোধীদের সম্মেলন মঞ্চে দেখা গেছিলো হেমন্ত সোরেনকেও। তবে আপাতত বিজেপির মতো তৃণমূল শিবিরকেও শত্রুপক্ষের আসনে বসিয়েছে মোর্চা।




ওদিকে কংগ্রেস, বিজেপির সঙ্গে মোর্চার সখ্যতা জন্মলগ্ন থেকেই। পরে বিজেপির সঙ্গে সম্পর্ক তিক্ত হলেও কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক আজও অটুট। ঝাড়খণ্ডে বর্তমান সোরেন সরকারের অন্যতম শরিক কংগ্রেস। গত বিহার বিধানসভা নির্বাচনেও মোর্চা সামিল হয়েছিলো কংগ্রেস, রাষ্ট্রীয় জনতা দলের মহাজোটে। বামপন্থীদের কাছেও গ্রহণযোগ্যতা আছে মোর্চার। ঝাড়খণ্ডে সোরেন মন্ত্রিসভাকে বাইরে থেকে সমর্থন জানানোর কথাও বলেছিলো সিপিআইএমএল। প্রতিবেশী রাজ্য ঝাড়খণ্ডের রাজনৈতিক সমীকরণের ছাপ বাংলাতেও পড়ে কিনা সেটাই দেখার।

তবে বাংলার নির্বাচনী লড়াই যেমন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে, তাতে জয়ের মুখ দেখতে কোন দল কোন পথে হাঁটবে তা আন্দাজ করা মুশকিল। "মতাদর্শে মিল খুঁজে পেলে মোর্চা তাদের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসতে আগ্রহী হবে।" ইতিমধ্যেই দলের অবস্থান স্পষ্ট করে বলেছেন মোর্চার সাধারণ সম্পাদক সুপ্রিয় ভট্টাচার্য।

বাংলার পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে ইতিমধ্যেই দলের অভিজ্ঞ নেতারা বাংলা সফরে বেরিয়ে পড়েছেন বলে মোর্চার দলীয় সূত্রের খবর। গত বিধানসভা নির্বাচনের মতোই এবারেও মোর্চা দুই বঙ্গেই প্রার্থী দিতে চলেছে। আপাতত মোর্চার লক্ষ্যে আছে বাংলার দলিত, আদিবাসী অধ্যুষিত মোট চল্লিশটি বিধানসভা কেন্দ্র। এই কেন্দ্রগুলির মধ্যে আছে জঙ্গলমহলের চার জেলা বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর। ওই চার জেলার চল্লিশটি বিধানসভা আসনে গত লোকসভা নির্বাচনের প্রেক্ষিতে তিরিশটিতেই এগিয়ে ছিলো বিজেপি। বাদবাকী দশটিতে ছিলো তৃণমূল। এছাড়াও মোর্চার নজরে আছে পশ্চিম বর্ধমান, মালদা, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, আলিপুরদুয়ার, উত্তর দিনাজপুর। আগামী ২৮ জানুয়ারি ঝাড়গ্রামে এক জনসভা করতে আসছেন হেমন্ত সোরেন।


এক রামে রক্ষা নেই, সুগ্রীব দোসর। ঠিক এই অবস্থাই হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজ্যের দলিত, আদিবাসী ভোটব্যাঙ্ক নিয়ে। মতুয়া ভোট নিয়ে আজও তৃণমূল, বিজেপির রশি টানাটানি চলেছে। তারমধ্যেই আবার এক নয়া সমীকরণ হাজির করতে চলেছেন পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকি। দলিত, আদিবাসীদের সঙ্গে একসারিতে মুসলিমদের দাঁড় করিয়ে ভোট বৈতরণী পেরোতে চাইছেন তিনি। 
গত বছর ১১অক্টোবরে ভাঙড়ের এক জনসভায় তিনি নতুন দল গড়ার কথা জানিয়েছিলেন। আব্বাস প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, দল জিতলে পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী হবে একজন দলিত বা আদিবাসী। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হবেন মুসলিম। সম্ভবত চলতি মাসেই নতুন দলের কথা জানা যাবে।

পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকির মতোই বাংলার দলিত, আদিবাসী সমাজকেই পাখির চোখ করেছে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা। কিন্তু ভোটব্যাঙ্কে ভাগ বসানোই মোর্চার মূল লক্ষ্য না। তার আড়ালে থাকবে ঝাড়খণ্ড সীমানা ঘেঁষা বাংলার এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভাগ বসানোর। এই অঞ্চলগুলির মধ্যে রেল শহর খড়গপুরকে বাদ দিলেও আছে পূর্ব মেদিনীপুর। তার পাশাপাশি আছে ঝাড়খণ্ড ঘেঁষা বাংলার পুরুলিয়া, বাঁকুড়া জেলা। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী প্রতি একশোজন পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে ৫.৮ জন আদিবাসী। এই আদিবাসী সমাজকে এককাট্টা করে ঝাড়খণ্ডের ভৌগোলিক সীমানা বাড়িয়ে, এক বৃহত্তর ঝাড়খণ্ড বানানোর স্বপ্নই লক্ষ্য মোর্চার। সেই স্বপ্নপূরণেই বাংলার ক্ষমতা দখলের ভোটযুদ্ধে শরিক হতে চলেছে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা।



মন্তব্যসমূহ