কাম ব্যাক মহারাজের , সম্পুর্ণ সুস্থ তিনি , নিজেই জানালেন সেকথা ,"আই অ্যাম রেডি টু ফ্লাই সুন।"

 



।। বাপী বাড়ি গেলো ।।


কাজল ভট্টাচার্য, কলকাতা,  
 ৭  জানুয়ারি

কোনও চাপ নেই। হাসপাতাল থেকে বেরিয়েই ভক্তদের দিকে হাতনেড়ে সেকথা বুঝিয়ে দিলেন বাঙালির মহারাজ।
বাপী বাড়ি গেলো। আর যাওয়ার আগে চাপ বাড়িয়ে দিয়ে গেলো হাতেগোনা কিছু মানুষের। সৌরভ গাঙ্গুলিকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে দেখে, নিশ্চিতভাবেই চাপ কমলো অরাজনৈতিক বাংলার। অন্যদিকে চাপ বাড়লো রাজনৈতিক বাংলার। তারওপর আবার হাসপাতাল থেকে বেরিয়েই সৌরভ বললেন, "আই অ্যাম রেডি টু ফ্লাই সুন।"

সৌরভের অসুস্থতার খবর পেয়েই এক জল্পনার চাপের ফানুস উড়িয়ে দিয়েছিলেন হাতেগোনা কিছু রাজনীতির খেলোয়াড়। আবার সেই চাপের ফানুস ছেঁদা করে দিয়েছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মতো অভিজ্ঞ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তবু জল্পনা কল্পনা চলছিলোই। এমনকি সৌরভের অসুস্থতাকে অজুহাত করে সাবধানী চেষ্টা চলছিলো, তাঁকে রাজনীতির দুনিয়া থেকে সরিয়ে রাখার। তবে মজার ব্যাপার, তিন সত্যি করে রাজনীতিতে নামার কথা মহারাজ সরাসরি অস্বীকার না করলেও, রাজনীতির খাতায় নাম লেখাতে চলেছেন এমন কোনও স্পষ্ট ইঙ্গিতও তিনি দেননি।


দোষেগুণে মেলানো এক আপাদমস্তক বাঙালি সৌরভ গাঙ্গুলি। টিভির অনুষ্ঠানে সৌরভ ঘনিষ্ঠ অনেকের মুখেই এই কদিন সেরকম নানা কথা শোনা গেছে। সেলিব্রেটি হয়েও আর দশজন নিপাট বাঙালির মতোই ডাক্তার, নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষার ধার ধারতেন না 'দাদা'। শরীর ফিট রাখতে ঘরেই স্বাস্থ্যচর্চা সেরে নিতেন। কোনও বাড়াবাড়ি বা অতি সক্রিয়তা ছিলো না শরীর, সুস্থতা নিয়ে। ভোজনরসিক। স্টুয়ের বদলে ভালবাসেন পাঁঠার মাংস, বিরিয়ানি। ভেতো বাঙালি।

তবু বাঙালির চোখে তিনি আইকন। ক্রিকেটের ময়দানে খেলোয়াড়, ক্যাপ্টেনসিতেও নজরকাড়া পারফরম্যান্স। আবার ক্রিকেট বোর্ডের প্রশাসক হিসেবেও তেমনি সফল। যে কোনও চ্যালেঞ্জ নিতে হামেশাই তৈরি। ক্রিকেটের ময়দান ছেড়ে টিভি অ্যাঙ্করিংয়েও ফের সুপার ডুপার হিট। নিজের ঢাক নিজে অনবরত পিটিয়েও রাজনীতিবিদরা যে কাজটা করে উঠতে পারেন না, ঠিক সে কাজটাই অনায়াসে করে দেখিয়েছেন সৌরভ। নিজের হয়ে গলা ফাটাতে হয়নি তাঁকে। মার্কসবাদ, উন্নয়ন অথবা সবকা বিকাশ, কোনও ব্যাপারেই আজ পর্যন্ত মুখ খুলতে দেখা যায়নি তাঁকে। অথচ তাঁর বিশ্বস্ততা নিয়ে মানুষের মনে কোনও প্রশ্ন নেই।

পূঁজি বলতে সৌরভের একান্তই ব্যক্তিগত করিশমা। তাঁর যোগ্যতার মাপকাঠি। আর সেই মাপকাঠিতেই সৌরভ হয়ে গেছেন বাংলার মুকুটহীন মহারাজ। যে কোনও দলের কাছেই তিনি হয়ে উঠতে পারেন তুরুপের তাস। স্বাভাবিকভাবেই প্রতিটি রাজনৈতিক দলই সৌরভকে নিজের শিবিরে টানতে চাইতেই পারে। এই সম্ভাবনার কথা মনে রেখেই, সৌরভের সঙ্গে রাজনীতির যোগাযোগ নিয়ে বারেবারেই চায়ের কাপে ঝড় তুলেছে বাঙালি। কয়েকজন বামপন্থী নেতার সঙ্গে সৌরভের ঘনিষ্ঠতা নিয়েও একসময় অনেক গুজব ছড়িয়েছিল। কিছুদিন আগে নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে যান সৌরভ। এরপরেই হাওয়ায় খবর ভাসে, সৌরভ তৃণমূলে যোগ দিচ্ছেন। তবে এবার চায়ের কাপের সেই ঝড় বেশ খানিকটা গতি বাড়িয়েছিলো রাজনীতিবিদরা মুখ খোলায়।


ক্রিকেট বোর্ডে সৌরভের সভাপতি হওয়া নিয়েও অনেকে রাজনীতির ছায়া দেখেছিলেন। বিশেষত বোর্ডের সম্পাদক কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর ছেলে জয় শাহ হওয়ায়, সহজেই সৌরভের সঙ্গে নাম জড়িয়ে যায় বিজেপির। এরপরেই ওই জল্পনায় ইন্ধন জোগায় রাজ্যপালের সঙ্গে মহারাজের দেখা করতে যাওয়া। দিল্লির অনুষ্ঠানে সৌরভ, অমিত শাহর যোগ দেওয়ার খবরে অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন, বিজেপিতে নাম লেখাতে চলেছেন মহারাজ। সেই জল্পনা কল্পনারই শিকার হতে দেখা গিয়েছিল অশোক ভট্টাচার্য, সৌগত রায়ের মতো প্রবীণ রাজনীতিবিদদেরও। তাঁরা ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন, সৌরভকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে। অথচ অশোকবাবুর দল হোক বা সৌগতবাবুর দল, দুই শিবিরেই কিন্তু রাজনীতির বাইরের দুনিয়ার লোকজনকে জায়গা করে দেওয়ার একাধিক নজির আছে। 

আচমকাই হৃদস্পন্দন বেসুরো হয়েছিল বাংলার মহারাজের। শনিবার ভর্তি হয়েছিলেন হাসপাতালে। বুধবারেই হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার কথা ছিলো সৌরভ গাঙ্গুলির। শেষ পর্যন্ত তা না হওয়াতে অনেকের চোখেই সন্দেহের ছায়া। মন উদ্বিগ্ন। বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ দেবী শেট্টি অবশ্য তার আগেই মানুষকে নিশ্চিন্ত করেছিলেন। চাপের তত্ত্ব উড়িয়ে শেট্টি বলেন, "সৌরভ চাইলে ব্যাট হাতে মাঠে নামবেন। এমনকি প্লেন ওড়াতেও চাপ নেই।" গোটা ঘটনায় পরিষ্কার, খুব শিগগিরিই তাঁর পুরনো ছন্দে ফিরতে চলেছেন সৌরভ।


বৃহস্পতিবার কামব্যাক। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলেন মহারাজ। হাত তুলে ভক্তদের বরাভয় দিলেন, তিনি তৈরি ফের মাঠে নেমে পড়তে। "আই অ্যাম রেডি টু ফ্লাই সুন।" ফের নিজের আকাশে উড়তে তৈরি 'দাদা'। চাপমুক্ত সৌরভ, চাপমুক্ত বাঙালি। চাপ কমলো ভারতের। তবে সৌরভের চাপমুক্ত হওয়ার খবরে অন্য কারও চাপ বাড়লে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

একেবারে স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে সৌরভের হয়ে ব্যাট করতে তড়িঘড়ি নেমে পড়েছিলেন সিপিএম নেতা অশোক ভট্টাচার্য। নিউটনের দক্ষতায় আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন চাপের তত্ত্ব। এমনকি ডিফেন্সে খেলতে গিয়ে আরও বলেছিলেন, "আমি চাই না ও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হোক।" কিন্তু হাসপাতালের সাজঘর থেকে বেরিয়েই সৌরভ বোল্ড আউট করলেন অশোক ভট্টাচার্যকে। স্পষ্ট ইঙ্গিত দিলেন, কোনও চাপ নেই। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরাও সৌরভের আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনায় কোনও মানসিক চাপের কথা স্বীকার করেননি। বরং তাঁদের মুখে বারবার শোনা গেছে মহারাজের পারিবারিক সূত্রে হৃদরোগের সমস্যা থাকার কথা।

"তার ওপর চাপ তৈরি করা হচ্ছিলো," বলেছিলেন অশোক ভট্টাচার্য। আর এই চাপ যে রাজনৈতিক, তা স্পষ্ট করতে তিনি বলেন, "রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য কেউ কেউ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে ব্যবহার করেছেন।" অশোক ভট্টাচার্য সরাসরি কারুর নাম মুখে না আনলেও, তাঁর ইঙ্গিত বুঝতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু সৌরভকে কে চাপ দিলো? 
কোনও রাখঢাক না করে সে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছেন বর্ষীয়ান তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়। তিনি বলেন, "ওকে যারা বিজেপিতে যাওয়ার জন্য চাপ দিয়েছে, তারা অন্যায় করেছে।"

এব্যাপারে ব্যতিক্রমি সুব্রত মুখোপাধ্যায়। টিম ইন্ডিয়ার প্রাক্তন ক্যাপ্টেনের যে চাপ নেওয়ার ক্ষমতা অসীম, সেকথাই সবাইকে মনে করিয়ে দিলেন তিনি। সরাসরি যাবতীয় চাপতত্ত্বকে উড়িয়ে রাজনীতির পোড় খাওয়া সৈনিক সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, "সৌরভ অনেক শক্ত মনের ছেলে। এসব নিয়ে ও চিন্তিত হবে না।"


মন্তব্যসমূহ