১২৫ বছরে নেতাজীর মুর্তি নিয়ে

 

শ্যামবাজারের নেতাজি




কাজল ভট্টাচার্য, কলকাতা, ২৬ জানুয়ারিঃ

- 'একি?' চমকে উঠেছিলেন কবিগুরুর কিঙ্কর, শান্তিনিকেতনের রামকিঙ্কর বেজ।
'দেখো দেখি, নেতাজির নাম শুনেই কেমন লেজ খাড়া করেছে নেতাজির ঘোড়া!'

ঘটনাস্থল শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়। সাল ১৯৭৫। উত্তেজিত হয়ে বলে বসলেন রামকিঙ্কর বেজ। কলকাতার বাতাসে তখন গরমের ছোঁয়া। আর সেই গরমের আভাস রামকিঙ্করের মেজাজেও। তখন চলছে শান্তিনিকেতনের আশ্রম থেকে আসা রামকিঙ্করের কলকাতা সফর। ততদিনে বেশ নামডাক হয়েছে শিল্পীর। তবে শহরের হল্লাগুল্লায় মেজাজ ঠিক থাকে না তাঁর। তার ওপর বড় শহরের বড় বড় শিল্পকর্ম দেখে মেজাজ আরও বিগড়োচ্ছে। কখনও ঢোঁক গিলছেন মুখ থেকে ছিটকে আসা বিশেষন সামাল দিতে। আবার কখনও বেশ রঙ্গ রসিকতাতেও ডুব মারছেন। আসল কথা হলো শিল্পীর মুখটি বড্ড বেশি খোলা। ধার ধারেন না শহুরে ভদ্রতার। বেপরোয়া। মনে যা আসে মুখে বলে দেন। স্পষ্টাস্পষ্টি।



রামকিঙ্কর একমনে দেখে চলেছেন শ্যামবাজারের প্রায় সাড়ে দশ হাতি নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুকে। কখনও ডানদিকে এগোন, কখনও বাঁদিকে। ঠিক যেন নেতাজি প্রদক্ষিন করে চলেছেন ভারতের আধুনিক ঘরানার পথিকৃত ভাস্কর। আত্মস্থ করেছেন ইউরোপিয়ান শিল্পের আধুনিক ধারা। কী বলবেন তিনি, শিল্পী নাগেশ যবলকারের এই শিল্পকর্মটিকে? মূর্তি বলবেন নাকি ভাস্কর্য। শিল্প কোনদিন একমাত্রিক হয় না। এক একজনের কাছে তা ধরা দেয় এক এক রূপে। কারুর পছন্দের শিল্পকর্মটি দেখে নাক কোঁচকান আর একজন। 

'ওটাই তাহলে ঘোড়ার লেজ!' বললেন রামকিঙ্কর। 'কিন্তু ওটা তাহলে অমন আড়াআড়ি কেন?' নিজের মনেই বলে চলেছেন শিল্পী। 'ঘোড়াটা দৌড় মারলে লেজটা কিছুতেই আড়াআড়ি থাকবে না। তারমানে নেতাজির ঘোড়া দাঁড়িয়ে। ছুটছে না।" এধরনের শিল্পকর্মকে রামকিঙ্কর বলতেন, স্ট্যাচু। যা নড়াচড়া করে না। ভঙ্গিমা যাই হোক না কেন, একজায়গাতেই স্থির জগদ্দল পাথরের মতো।

বেজ নেতাজির যে মূর্তি নিয়ে এতো কাটাছেঁড়া করে চলেছেন, শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে তা বসানো হয়েছিল সুভাষ চন্দ্রের তেয়াত্তরতম জন্মদিন ২৩ জানুয়ারি, ১৯৬৯ সালে। ব্রোঞ্জের ষোলো ফুটের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল কলকাতা পুরসভা। তখন কলকাতার মেয়র ছিলেন গোবিন্দচন্দ্র দে। মূর্তি তৈরিতে খরচ হয়েছিল প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা। মুম্বই থেকে বিশাল ওই মূর্তি আনতে হয়েছিল তিন খন্ডে। কিন্তু এত তোড়জোড় করে যে মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হলো, তাকে দেখে মন ভরলো না বাঙালির। রোজ নিয়ম করে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করা হতো। মনের আবেগে ধরে রাখা নেতাজির মানসপ্রতিমার সঙ্গে, বাঙালি মিল খুঁজে পায়নি ব্রোঞ্জের নেতাজির। অনেকেই মনে করতেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল জেমস উট্রামের আদলে গড়া ওই শিল্পকর্মটি আসলে এক অক্ষম অনুকরণ। নেতাজিকে অপমান করা।



ফি-বছর নিয়ম করে জন্মজয়ন্তীতে গলায় মালা ওঠে নেতাজির। গণতন্ত্র দিবস, স্বাধীনতা দিবসেও নেতাজি বন্দনা চলবে শ্যামবাজারের নেতাজির পাদদেশেই। তারপরেই ফের দেশনায়কের ওই মূর্তি হয়ে যাবে পাঁচমাথার পথফলক। পথিক পথের নিশানা ঠিক করবে নেতাজার ঘোড়ার লেজ দেখে। শরীরময় শহরের দূষন নিয়ে অবিচল থাকবেন অশ্বারূঢ় নেতাজি।

সেদিন যেমন নাগেশ যবলকারের নেতাজি পছন্দ হয়নি রামকিঙ্করের, ঠিক তেমনি প্লাস্টার অফ প্যারিসে তৈরি রামকিঙ্করের নেতাজির নমুনা মডেল পছন্দ হয়নি সরকারি কর্তাদের। পত্রপাঠ তা খারিজ করে
শ্যামবাজারের নেতাজি মূর্তির বরাত যায় মহারাষ্ট্রের শিল্পী নাগেশ যবলকারের কাছে। তবে দু'পক্ষের এই পছন্দ না হওয়ায় অবশ্যই বিস্তর ফারাক ছিলো। রামকিঙ্কর বেজ ছিলেন এক আধুনিক ভাস্কর। আর সরকারি পক্ষের কর্তারা ঠিক কতটা শিল্পবোদ্ধা ছিলেন, তা নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তোলাই যায়। সুতরাং কোন শিল্পকর্মটি গ্রহনীয়, আর কোনটি গ্রহনীয় নয়, সেব্যাপারে কার মত শিরোধার্য তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। তবে সেদিন শিল্পের উৎকৃষ্টতা নিয়ে শেষকথা বলেছিলেন সরকারি কর্তারাই।

আসলে মূর্তি আর ভাস্কর্যের ফারাকটা শিল্পরসিকদের কাছে পরিষ্কার হলেও, শহুরে ভদ্রজনের কাছে আজও তা কতটা স্পষ্ট তাতে সন্দেহ আছে। এই ভদ্রসমাজকে নিয়ে চাপে ভুগতেন খোদ রামকিঙ্করও। আর সেকথা স্বীকার করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের দু'বছরের বড় দাদা সোমেন্দ্রনাথের কাছে। 'ভদ্রলোকদের অনেক সময় বুঝতে পারি না। ওখানে সুর খুব কম। অনেকে আলাপ করতে আসে। ঢং ঢাং দেখি। কেউ পণ্ডিত সাজে, কেউ কবি আর্টিস্ট, কেউ ভালমানুষ, কেউ বা দাতাকর্ণ। যাত্রাদলের সঙ সব, মনে মনে হেসে মরি।'

সাল ১৯২৩। কলকাতার প্রথম মেয়র হলেন চিত্তরঞ্জন দাশ। তারপরেই ব্রিটিশ প্রভুদের বদলে জোয়ার এলো দেশের জাতীয়বাদ নেতাদের ভাস্কর্য গড়ার। কৃষ্ণনগর কুমোরটুলির মূর্তি গড়ার দক্ষ কারিগররা কোমর বেঁধে কাজে নেমে পড়লেন। কিন্তু তাঁদের শিল্পকর্মগুলি ভাস্কর্যের ধারপাশে গেলো না। আবার গভর্মেন্ট স্কুল অফ আর্টের শিক্ষিত শিল্পীরা আসার পরে উৎকৃষ্ট শিল্প তৈরি হলো ঠিকই, কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলো না। 

কলকাতার বুকে পাশাপাশি দেখা গেছিল দেশী বিদেশী শিল্পদের তৈরি একাধিক অবয়ব। চোখে পড়েছিল শিল্প নির্মাণে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের মানসিকতায় ফারাকের ছবিটা। "পাশ্চাত্যের ভাস্কররা অবয়ব গড়তেন বাস্তব মানুষটির হুবহু করে। পরিপাটি করে তুলে ধরা হতো তাঁর সাজসজ্জাও," বলেছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রাচ্যের ভাস্করদের সম্পর্কে তাঁর মত, আমাদের শিল্পীরা গুরুত্ব দিতেন তিনি নিজে যেভাবে মানুষটিকে দেখেন, সেভাবে গড়তে। 

অন্যপথে হাঁটলেন বেপরোয়া রামকিঙ্কর বেজ। ভাস্কর্য শিল্পে আমদানি করলেন ইউরোপিয়ান আধুনিকতা, ত্রিমাত্রিকতার কিউবিজম। হুবহু মুখের বদলে তিনি ধরতে চেষ্টা করলেন মুখের বৈশিষ্ট্য। মানুষটির চরিত্র ধরা পড়লো তাঁর মুখের গঠনে। শিল্পী মানুষটিকে কী চোখে দেখেন, তা গুরুত্ব পেলো না। গুরুত্ব পেলো মানুষটির অর্ন্তনিহিত চরিত্র। আমাদের রাজনৈতিক অভিভাবকরা মূর্তির ঘোর ধরা চোখে, আধুনিক ধারার ভাস্কর্য মেনে নিতে পারলেন না। তাই সেদিন শ্যামবাজারের নেতাজির মূর্তির বরাত রামকিঙ্করের কাছে না গিয়ে, চলে গেছিল বোমবের নাগেশ যবলকারের কাছে।

শহরের নেতাদের নেতাজি প্রেমেও সন্দেহের জায়গা আছে। ভবানীপুরের নর্দার্ন পার্কে বসেছিল নেতাজির মূর্তি। সালটা ছিল ১৯৮৬। আর পাঁচটা মূর্তি, ভাস্কর্যের মতোই ঘটলো যত্নের অভাব। সেই অবহেলা ঢাকতে ব্রোঞ্জমূর্তির গায়ে পড়লো কালো রংয়ের পোচ। পরে চেষ্টা করেও সেই কালো পোচ সরানো যায়নি। অগত্যা, কালো ঢাকতে পড়লো সবুজের প্রলেপ। 
নেতাজিকে নিয়ে দিল্লির সরকার বাহাদুর কতটা আন্তরিক, প্রশ্ন তোলা যায় সে ব্যাপারেও। গত চুয়াত্তর বছরের স্বাধীন ভারতে দেশের এই বীর সেনানীর মূর্তি প্রতিষ্ঠা বা জন্ম জয়ন্তীতে যোগ দিতে, নরেন্দ্র মোদি ছাড়া মাত্র একবার নেতাজির শহর কলকাতায় পা পড়েছিল দেশের প্রধানমন্ত্রীর। ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বর। দিল্লি থেকে উড়ে এসছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। উপলক্ষ্য ছিলো রেড রোডে নেতাজির মূর্তির আবরণ উন্মোচন। আর এবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এলেন নেতাজির ১২৫ তম জন্মদিবস পালন উদযাপন করতে।

রাজনীতির কর্তাদের মনে নেতাজির আবেগ ঠিক কতখানি, তার মাপ পরিমাপ করা শিবেরও অসাধ্য। তবে এই বাংলার বুকে এমনও ঘটনা ঘটে যেখানে নেতাজির মূর্তি, ভাস্করের তর্কাতর্কিকে ছাপিয়ে যায় প্রাণের শুদ্ধ আবেগ। বসিরহাটের অটোচালক অজয় কুণ্ডু। জীবনযুদ্ধের এক সেনানী। তিলতিল করে টাকা জমিয়েছিলেন। তাও আড়াই লক্ষ টাকা। সেই সঞ্চয়ের গোটাটা ঢেলে দিলেন স্বপ্নপূরণে। সাল ২০২০ সালের নভেম্বর। ঘোজাডাঙ্গা সীমান্তে ইছামতি সেতুর মুখে প্রতিষ্ঠা করলেন তেরো ফুটের নেতাজির মূর্তি। 

আবার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলে নেতাজিকে নিয়ে সরকারি অনুষ্ঠানে 'জয় শ্রীরাম' শ্লোগান ওঠায় রাজ্য রাজনীতি যখন সরগরম, ঠিক তখনই রামসীতার পাশে পূজিত নেতাজির মূর্তি। ঘটনা জলপাইগুড়ির মাসকলাইবাড়ির পঞ্চমুখী হনুমান মন্দিরের। ১৯৫৩ সালের হৃষিকেশের করপাত্রী মহারাজ মন্দিরে নেতাজির মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর ভাবাবেগে রাম সীতা, নেতাজি একাকার। ভক্তরাও তা মেনে নিয়েছেন কোনও প্রশ্ন না তুলেই।

আজ নেতাজি আবেগে ভাসছে যাবতীয় রাজনৈতিক শিবির। কোন দল নেতাজির কতো বড়ো ভক্ত, তা নিয়ে চলছে প্রতিদ্বন্দিতা। ইতিহাসের পাতা ওল্টালেই ধরা দেয় অতীত। স্পষ্ট হয় নেতাজিকে নিয়ে একাধিক রাজনৈতিক শিবিরের দ্বিচারিতা। 



এই পরিস্থিতির মধ্যেই এক শুভবার্তা দিয়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সুভাষচন্দ্র বসুর স্মৃতিতর্পণে রাজারহাটে মাথা তুলবে মনুমেন্ট। সাধু প্রস্তাব। ব্যয়বহুল এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। কিন্তু যাঁকে স্মরণ করে এত আয়োজন, শহরে তাঁর এক 'মনুমেন্টাল স্কাল্পচার' না থাকলে কেমন বেমানান লাগে। তাই ওই কর্মযজ্ঞের শুরুতেই, বাংলার রাজধানী শহরে প্রতিষ্ঠা হোক নেতাজির এক শিল্পসম্মত ভাস্কর্য। যার সামনে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে বলে উঠবেন একালের কোনও রামকিঙ্কর- বাহ, জম্পেশ কাজ হয়েছেতো! নইলে স্বাধীনতার প্রায় চুয়াত্তর বছর পরেও মনে হয়, বরং ভালো ছিলো ক্লাস ফোরের লাইনটানা খাতার মলাটের সেই নেতাজি। তাতে আর যাই হোক, আবেগের শুদ্ধতা ছিলো।

মন্তব্যসমূহ