দিল্লী কাঁপল কিষান আন্দোলনে

 


। দিল্লি কাঁপালো কৃষক আন্দোলন ।



কাজল ভট্টাচার্য, কলকাতা, ২৬ জানুয়ারি :

লালকেল্লায় উড়লো সংগঠনের পতাকা।
স্বাধীন ভারতে এরকম ঘটনা এই প্রথম। প্রজাতন্ত্র দিবসের দিনে  যে স্তম্ভ থেকে ওই পতাকা ওড়ানো হলো, স্বাধীনতা দিবসের দিন প্রথামাফিক, প্রধানমন্ত্রী ওই স্তম্ভেই দেশের তেরঙ্গা পতাকা ওড়ান।
পুলিসের চোখের সামনেই লালকেল্লার দখল নিলো আন্দোলনকারীরা। আন্দোলনকারীদের মারমুখী মেজাজ আর সংখ্যার বিচার করলে, পুলিস তখন বাস্তবেই অসহায়। বেশ কিছুক্ষণ পর পরিস্থিতির উত্তেজনা খানিকটা কমলে, এক পুলিস কর্মীকেই দেখা গেল সেই সংগঠনের পতাকা নামিয়ে আনতে। 

ওদিকে দিল্লির আইটিওতে তখন এক ভয়াবহ দৃশ্য।
মোড়ের মাথায় ব্যারিকেড করে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিসের দিকে ধেয়ে গেলো নীলরঙা ট্রাক্টর। আচমকাই এই ঘটনা দেখে মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো পুলিস। তারপরেই ধাক্কার থেকে বাঁচতে এক লাফে অন্যদিকে। রাস্তায় গোল চক্কর মেরে ফের পুলিসদের তাড়া করলো সেই ট্রাক্টর। ততক্ষণে তার সঙ্গে জুটেছে আরও একাধিক ট্রাক্টর। 



একসময় গোটা দিল্লিই যেন চলে গিয়েছিল আন্দোলনকারীদের দখলে। যেদিকেই চোখ যায় ট্রাক্টরের সারি। মিছিলের পূর্বশর্ত মেনে কোন ট্রাক্টরেই পাঁচজন ছিলেন না। ছিলেন না নিরস্ত্রও। শর্তমাফিক রাস্তায় না গিয়ে মিছিল অন্য রাস্তায় এগোতেই পুলিসের ব্যারিকেডের মুখে পড়ে। আর তখনই আন্দোলনকারীদের হাতে উঠে এলো খোলা তরোয়াল। লোহার রড। লাঠি চালিয়ে, কাঁদানি গ্যাসের শেল ফাটিয়েও মারমুখী আন্দোলনকারীদের ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছিলো পুলিস। আন্দোলনকারীদের বক্তব্য, পুলিস শেষ মুহূর্তে ট্রাক্টর প্যারেডের গতিপথ পাল্টাতেই বিপত্তির শুরু।



এরপরেই পুলিসের গুলিতে এক আন্দোলনকারীর মৃত্যুর গুজব ছড়ায়। তবে সংবাদমাধ্যমের দাবি, আন্দোলনকারীর মৃত্যু হয়েছে দুরন্ত গতিতে ট্রাক্টর ছুটিয়ে ব্যারিকেডে ধাক্কা মেরে উল্টে যাওয়ার ঘটনায়। মারমুখী কৃষকদের সামাল দিতে পুলিস লাঠি চালানোর পাশাপাশি, কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটায় বলে জানান দিল্লির জয়েন্ট সিপি আলোক কুমার। সংঘর্ষে জখম হয়েছেন আঠারো পুলিসকর্মী। গুজব সামাল দিতে সাময়িক ভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট পরিষেবা।

আশঙ্কা ছিলো এরকম এক ঘটনারই। পুলিস প্রশাসন এব্যাপারে বারেবারে সতর্ক করেছিল কৃষক নেতাদের। জানানো হয়েছিল কৃষক আন্দোলনকে টার্গেট করে পাকিস্তানে সক্রিয় ছিলো ৩০৮টি টুইটর হ্যান্ডেল। কোনও আশঙ্কার কথাতেই কর্ণপাত করেননি কৃষক নেতারা। তাঁদের একরোখা মনোভাবের কাছে শেষ পর্যন্ত মাথা নোয়াতে বাধ্য হয় প্রশাসন। তবে কৃষক সংগঠনগুলি কথা দেয় গণতন্ত্র দিবসের ট্রাক্টর প্যারেডে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা হবে পুলিসের দেওয়া সাঁয়ত্রিশটি শর্তের সবগুলিই। 



কৃষক সংগঠনের নেতারা যাই কথা দিয়ে থাকুন না কেন, শর্তের খেলাপ হয়েছিল গোড়া থেকেই। শর্ত ছিল কোনও ট্রাক্টরেই পাঁচজনের বেশি থাকবে না। আর প্রত্যেকেই হবে পরিচিত মুখ। যাতে ভিড়ের সুযোগ নিয়ে কোনও ষড়যন্ত্রী না ঢুকতে পারে। দায়িত্ব নিয়েছিলেন কৃষক নেতারাও। তবে আশঙ্কা যে একেবারে অমূলক ছিলো না, তার প্রমাণ মেলে। পুলিসের সঙ্গে সংঘর্ষ চলার সময় একসময় কিছু আন্দোলনকারীকে দেখা যায়, এক যুবককে পাকড়াও করে পুলিসের হাতে তুলে দিতে। অভিযোগ, ওই যুবক নাশকতা চালাতে ইন্ধন জোগাচ্ছিল। কিন্তু পুলিসের সঙ্গে কৃষকদের তুমুল সংঘর্ষের ঘটনা ছড়িয়ে পড়তেই উবে যান নেতারা। 



তাহলে কি কৃষক আন্দোলনকে কেউ হাইজ্যাক করেছিল? লাগাম চলে গেছিল অন্য কারুর হাতে? এই সন্দেহ আরও গভীর হয় দুপুর নাগাদ ভারত কিষাণ ইউনিয়নের নেতা রাকেশ টিকায়েতের বক্তব্য জানাজানি হতেই। টিকায়েত জানান, সংঘর্ষের ঘটনায় যাঁরা জড়িয়ে ছিলেন, তাঁদের কেউ আন্দোলনকারী কৃষক না। রাজনীতির লোকজন এই আন্দোলনকে কলঙ্কিত করেছে। তাঁদের চিহ্নিত করা গেছে বলেও দাবি টিকায়েতের। প্রায় একই সুর শোনা যায় আন্দোলনের শরিক স্বরাজ ইন্ডিয়া'র নেতা যোগেন্দ্র যাদবের গলাতেও। তিনি বলেন, "যাদের আন্দোলন থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল, অশান্তির কারণ তারাই।" লালকেল্লায় সংগঠনের পতাকা ওড়ানোর ঘটনায় তাঁর মন্তব্য, "আমার মাথা হেট হলো।"

মোদি সরকারের কৃষি বিল বিরোধিতায় আন্দোলনে নামে মূলত হরিয়ানা, পঞ্জাবের একাধিক কৃষক সংগঠন। পরে ওই আন্দোলন কলেবরে বাড়ে। আন্দোলনের সূচনাতেই কৃষক নেতারা জানিয়েছিলেন, কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক নেই। এরপর প্রায় দু'মাস দিল্লির রাস্তাতে ছাউনি ফেলে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে কৃষকরা তাঁদের সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু এই আন্দোলনের পাশে দাঁড়ানোর অজুহাতে, সরকারকে চাপে ফেলার লাগাতার চেষ্টা চালাতে থাকে মোদিবিরোধী শিবির। রাজনীতির এই সমীকরণকে কাজে লাগিয়েই, আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে চাইছেন না তো কৃষক সংগঠনের নেতারা? ট্রাক্টর প্যারেডে শান্তিরক্ষার প্রতিশ্রুতিতেই কৃষক নেতাদের ট্রাক্টর প্যারেডের অনুমতি দিয়েছিল পুলিস প্রশাসন।

আজকের ঘটনার জন্য দুঃখপ্রকাশ করলেও, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উদাসীনতাকেই দায়ী করেছে বিজেপি বিরোধী শিবির। 

মন্তব্যসমূহ